ধর্ম ডেস্ক : ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ভূমিকায় যদিও পুরুষকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে, তবে নারীশিক্ষা, নারীর অগ্রযাত্রা, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে তাদের অবদান রাখার ক্ষেত্রে ইসলামে কোনো বাধা নেই। মুসলিম ইতিহাস ও সভ্যতায় নারীর অমর কীর্তিগুলো অত্যন্ত সে সাক্ষ্যই দেয়, বিশেষত ধর্মীয় ও সাধারণ শিক্ষার বিস্তারে মুসলিম নারীর অবদান অনস্বীকার্য। নিম্নে শিক্ষাক্ষেত্রে পথিকৃৎ কয়েকজন মুসলিম নারীর পরিচয় তুলে ধরা হলো।
১. ফাতেমা আল ফিহরি : অনেকেই হয়তো জেনে আশ্চর্য হবেন যে পৃথিবীর সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় মুসলমানদের হাতেই স্থাপিত হয়েছিল এবং তা করেছিলেন একজন মুসলিম নারী।
মহীয়সী সেই নারীর নাম ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ আল ফিহরি। তিনি ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে মরক্কোর ফেজ শহরে কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। যেখানে ধর্মীয় বিষয়গুলোর পাশাপাশি সাহিত্য, দর্শন, গণিত ও সমসাময়িক বিষয়গুলোর পাঠদান করা হতো। ফাতেমা আল ফিহরির পরিবার আমির ইয়াহইয়া বিন মুহাম্মদ বিন ইদরিসের সময় কারাউইনে এসেছিল।
পিতা ও স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ তিনি শিক্ষা বিস্তারে ব্যয় করেন।
২. সিত্তুশ শাম ফাতেমা খাতুন : ফাতেমা খাতুন বিনতে নাজমুদ্দিন আবুশ শোকর আইয়ুব (রহ.)। সিত্তুশ শাম তাঁর উপাধি। তিনি জুমুররুদ খাতুন নামেও পরিচিত।
তিনি ছিলেন সুলতান সালাহুদ্দিন (রহ.)-এর বোন এবং হেমসের শাসক নাসিরুদ্দিনের স্ত্রী। জ্ঞান ও সাহিত্য চর্চা, আলেম ও গুণীজনদের পৃষ্ঠপোষকতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও মুক্তহস্তে দানের জন্য তিনি ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন। সিত্তুশ শাম (রহ.) জনকল্যাণমূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
আলেম-ওলামাদের সাধারণ পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি তিনি দুটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। যার একটি হলো মাদরাসাতুশ শামিয়া আল বারানিয়্যা (১১৮৬ খ্রি.)।
এই মাদারাসায় তিনি যুগের শ্রেষ্ঠ আলেমদের একত্র করেন। তাঁদের নিয়োগের অন্যতম শর্ত ছিল তাঁরা অন্য কোথাও পাঠদান করতে পারবেন না, সর্বদা ছাত্রদের নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। তিনি এই মাদরাসার জন্য বিপুল পরিমাণ সম্পদ ওয়াকফ করেন।
দ্বিতীয়টি হলো মাদরাসাতুশ শামিয়া আল জাওয়ানিয়া। এটা আগে ফাতেমা খাতুন (রহ.)-এর বাড়ি ছিল। এই মাদরাসার জন্যও তিনি বিপুল পরিমাণ সম্পদ ওয়াকফ করে দেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় এটি দামেস্কের সর্ববৃহৎ মাদরাসায় পরিণত হয়। বিখ্যাত ফকিহ ও মুহাদ্দিস আল্লামা তকি উদ্দিন ইবনুস সলাহ (রহ.)-কে এই মাদরাসার পরিচালক নিযুক্ত করা হয়।
৩. সুলতানা রাজিয়া : সুলতানা রাজিয়া ছিলেন সুলতান ইলমুৎমিশের কন্যা। প্রজাহিতৈষী হিসেবে তিনি ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তিনি তাঁর সংক্ষিপ্ত শাসনামলে অসংখ্য মাদরাসা, মক্তব, পাঠাগার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। পুরনো দিল্লিতে এখনো যার কিছু নিদর্শন টিকে আছে।
৪. আদির কারিমা : জিহাতুস সলাহ আদির কারিমা ছিলেন ইয়েমেনের শাসক আলী দাউদের মা। ছেলের অনুপস্থিতিতে তিনি ১৪ মাস রাষ্ট্রের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং বিশৃঙ্খলার হাত থেকে রক্ষা করেন। তিনি ইয়েমেনে একাধিক মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। যার মধ্যে আছে, জুবাইদ শহরের মাদরাসায়ে ইসলাহিয়া। এ ছাড়া মুসাল্লাব ও সালামায় আরো দুটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিটি মাদরাসার জন্য বিপুল পরিমাণ স্থাবর সম্পদ ওয়াকফ করেন।
৫. তাতার হাজ্জাজিয়্যা : তিনি ছিলেন মালিক নাসির মুহাম্মদ বিন কালাউনের মেয়ে। তিনি ১৩৬০ খ্রিস্টাব্দে মাদরাসায়ে হাজ্জাজিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। এর অধীনে একটি মসজিদ, গ্রন্থাগার ও এতিমখানা পরিচালিত হতো। এতিমখানার শিক্ষার্থীদের খাবার, পোশাকসহ যাবতীয় খরচ বহন করা হতো। এ ছাড়া তিনি কায়রোতে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিপুল পরিমাণ সম্পদ ওয়াকফ করেন।
৬. খাওয়ান্দ বারাকাহ : উম্মুস সুলতান বারাকাহ ছিলেন মিসরের শাসক মালিক আশরাফ শাবান বিন হুসাইনের মা। তিনি ১৩৭০ খ্রিস্টাব্দে মাদরাসা উম্মুস সুলতান প্রতিষ্ঠা করেন। মাদরাসার সামনে পথচারীদের জন্য তিনি একটি পানির কূপ খনন করেন। এই মাদরাসার প্রাঙ্গণের তাঁর ছেলে মালিক আশরাফকে দাফন করা হয়।
৭. নায়েলা খাতুন : তিনি ছিলেন ইরাকে নিযুক্ত উসমানীয় প্রশাসক মুরাদ আফেন্দির স্ত্রী। স্বামী মারা যাওয়ার পর নায়েলা খাতুন তাঁর বাড়িটি দ্বিনি শিক্ষার জন্য ওয়াকফ করে দেন এবং সেখানে মাদরাসায়ে মুরাদিয়্যা প্রতিষ্ঠিত হয়। মাদরাসার অধীনে একটি মসজিদও পরিচালিত হতো। বাড়ি ছাড়াও তিনি মাদরাসার জন্য আরো কিছু সম্পদ দান করে যান।
৮. নানা আসমা : তিনি ছিলেন একজন আলেমা, ফকিহ, কবি ও ধর্মীয় দীক্ষাগুরু। নানা আসমা (রহ.) আফ্রিকার বিখ্যাত আলেম উসমান বিন ফুদি (রহ.)-এর নাতনি। ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম। পশ্চিম আফ্রিকায় নারীশিক্ষা ও ধর্মীয় জাগরণের পথিকৃৎ তিনি। নানা আসমা (রহ.) অল্প বয়স থেকে নারীদের জন্য পাঠচক্র, তাদের লেখালেখিসহ প্রতিভা বিকাশের উদ্যোগ নেন। তিনি শুধু নারীদের ধর্মীয় শিক্ষার বিস্তার করেননি, বরং তিনি নারীদের ধর্মীয় অনুশাসনের ভেতর থেকে কর্মমুখী ও স্বনির্ভর হতে শিখিয়েছেন। আফ্রিকায় তাঁর নামে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও একাধিক সংগঠন রয়েছে।
৯. ফাতেমা বিনতে ইসমাইল : তিনি ছিলেন মিসরে নিযুক্ত উসমানীয় শাসক ইসমাইল পাশার কন্যা। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান অতুলনীয়। ১৯০৯ সালে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন নির্মাণের জন্য রাজপ্রাসাদের পাশে ছয় একর জমি দান করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য একটি মিসরীয় বদ্বীপের ৬৭৪ একর জমি দান করেন। ভবন নির্মাণের সময় নিজের গহনা বিক্রি করে তৎকালীন যুগে ১৮ হাজার মিসরীয় পাউন্ড প্রদান করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগারে নিজের সংগৃহীত বইগুলো দান করেন। যার মধ্যে রাজা ও রাজপুত্রের উপহার দেওয়া দুর্লভ অনেক বইও ছিল। এ ছাড়া ১৯১৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সময় ব্যক্তিগত তহবিল থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ দান করেন।
পর্নোগ্রাফি আসক্তি থেকে মুক্তি লাভে ইসলামের সহজ কয়েকটি উপায়
১০. রানি ইফফাত : আধুনিক যুগের মুসলিম নারীদের ভেতর সৌদি আরবের প্রয়াত বাদশাহ ফয়সালের স্ত্রী রানি ইফফাত অন্যতম। তিনি সৌদি আরবে নারীশিক্ষার বিস্তারে অনন্য অবদান রাখেন। তিনি তায়েফে দেশটির ইতিহাসে প্রথম নারী শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করেন। প্রথমে ক্ষুদ্র আকারে যাত্রা শুরু করলেও ১৯৫৫ সালে বাদশাহ ফয়সালের অনুমতিতে বড় পরিসরে তা শুরু করা হয়। তথ্যঋণ : রাসিফ ডটনেট
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।