কোভিডের সেই অন্ধকার দিনগুলো মনে আছে? যখন হাসপাতালের করিডরে অক্সিজেনের জন্য হাহাকার, চিকিৎসা বিলের বোঝা আর অনিশ্চয়তার ভয় কাঁধে চেপে বসেছিল। শাহিনা আক্তারের মতো কত পরিবার তখন টাকার অভাবে প্রিয়জনের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারেনি। অথচ, একটি সঠিক ইনসুরেন্স পলিসিই পারত সেই দুঃসহ মুহূর্তে তাদের পাশে দাঁড়াতে, আর্থিক ধ্বংসস্তূপ থেকে রক্ষা করতে। আজ, আপনার জন্য সেই ইনসুরেন্স পলিসি বাছাই করার টিপস নিয়ে হাজির হয়েছি – যেন ভবিষ্যতের অনাকাঙ্ক্ষিত ঝড়েও আপনার স্বপ্নের নৌকা ডুবতে না পারে।
ইনসুরেন্স পলিসি বাছাই করার টিপস: কেন এই গাইড আপনার জন্য জরুরি?
জীবন বীমা, স্বাস্থ্য বীমা, মোটর বীমা – বাজারে নানা রকম পলিসির ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। বাংলাদেশ ইন্সুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (BIDA) ২০২৩ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে মাত্র ১৫% প্রাপ্তবয়স্কের জীবন বীমা কভারেজ রয়েছে, আর স্বাস্থ্য বীমার হার আরও কম। অথচ, হাসপাতালে ভর্তির গড় খরচ প্রতি বছর ১০% হারে বাড়ছে (সানেম রিসার্চ, ২০২২)। ইনসুরেন্স পলিসি বাছাই করার টিপস জানা মানে শুধু একটি কাগজ কেনা নয়; এটা আপনার পরিবারের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার চাবিকাঠি নিজের হাতে নেওয়া।
জীবন বীমা নাকি স্বাস্থ্য বীমা? কোনটা আপনার জন্য জরুরি?
আপনার জীবনের পরিস্থিতিই সিদ্ধান্ত নেবে:
সব বীমার প্রয়োজন এক নয়। একজন তরুণ প্রফেশনালের চাহিদা আর একজন পরিবারের প্রধান বা অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তির চাহিদা আলাদা।
জীবন বীমা (লাইফ ইন্সুরেন্স):
- কার জন্য: পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, যাদের উপর পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা নির্ভর করে। ঋণ (হোম লোন, কার লোন) থাকলে তা পরিশোধের নিশ্চয়তা দেয়।
- ফোকাস: মৃত্যুঝুঁকি কভারেজ। নমিনিকে এককালীন বা মাসিক আর্থিক সুবিধা প্রদান।
- প্রকার: টার্ম ইন্সুরেন্স (সস্তা, বিশুদ্ধ কভার), এন্ডোমেন্ট প্ল্যান (সেভিংস + কভার), হোল লাইফ পলিসি (আজীবন কভার + বোনাস), ইউএলআইপি (ইনভেস্টমেন্ট + ইন্সুরেন্স – ঝুঁকিযুক্ত)।
- কী দেখবেন: কভারেজ অ্যামাউন্ট (Sum Assured) আপনার বার্ষিক আয়ের কমপক্ষে ১০-১৫ গুণ হওয়া উচিত (আইডিআরএ সুপারিশ)। প্রিমিয়াম পরিশোধের মেয়াদ (Term)।
- স্বাস্থ্য বীমা (হেলথ ইন্সুরেন্স):
- কার জন্য: সবাই। অসুস্থতা বা দুর্ঘটনা যে কারও জীবনে যেকোনো সময় আঘাত হানতে পারে। ক্রমবর্ধমান চিকিৎসা খরচের মুখে এটি একটি শক্তিশালী আর্থিক ঢাল।
- ফোকাস: হাসপাতালে ভর্তির খরচ (রুম রেন্ট, সার্জারি, ডাক্তার ফি, মেডিসিন), ক্রিটিক্যাল ইলনেস কভার (ক্যান্সার, হার্ট অ্যাটাক), ডে-কেয়ার প্রসিডিওর।
- কী দেখবেন: বার্ষিক কভার লিমিট (কমপক্ষে ৫-১০ লাখ টাকা, শহুরে জীবনযাপনে আরও বেশি), সাব-লিমিট (রুম রেন্ট, অপারেশন খরচে ক্যাপ আছে কি না?), ক্যাশলেস হাসপাতাল নেটওয়ার্ক, প্রি-একজিস্টিং ডিজিজ কভার (কত বছর পর শুরু হয়?), ক্লেইম সেটেলমেন্ট রেশিও (৯০%+ ভালো)।
বাস্তব উদাহরণ: ঢাকার বসুন্ধরায় কর্মরত সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার রিয়াদ (৩২) একটি টার্ম ইন্সুরেন্স নিয়েছেন ১ কোটি টাকা কভারেজে, কারণ তার আছে একটি ছোট শিশু ও গৃহঋণ। পাশাপাশি, তার স্ত্রী সীমা (২৮) একটি ভালো হেলথ পলিসি নিয়েছেন ১০ লাখ বার্ষিক কভারেজে, কারণ পরিবারে ডায়াবেটিসের ইতিহাস রয়েছে।
বীমা পলিসি নির্বাচনের ১০টি স্বর্ণালি নিয়ম: আপনার গাইডলাইন
এই টিপসগুলো শুধু তত্ত্ব নয়, অভিজ্ঞ বীমা উপদেষ্টা ও গ্রাহকদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে তৈরি:
প্রয়োজন বিশ্লেষণ করুন (নিড অ্যাসেসমেন্ট): “সবাই নিচ্ছ তাই আমিও নিলাম” – এই মানসিকতা বিপজ্জনক। লিখে ফেলুন:
- কার সুরক্ষা দরকার? (আপনি, স্ত্রী/স্বামী, সন্তান, বাবা-মা?)
- কী ধরনের ঝুঁকি মোকাবেলা করতে চান? (অকাল মৃত্যু, দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতা, দুর্ঘটনা, সম্পদের ক্ষতি?)
- আর্থিক লক্ষ্য কী? (ঋণ শোধ, সন্তানের শিক্ষা, অবসর সঞ্চয়?)
- কত টাকা প্রিমিয়াম দিতে পারবেন মাসে/বছরে?
বাজেট ঠিক করুন: ইনসুরেন্স পলিসি বাছাই করার টিপস এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। আপনার আয়ের ৫%-১৫% বীমা প্রিমিয়ামে বরাদ্দ রাখার চেষ্টা করুন। প্রিমিয়াম এমন হওয়া উচিত যা দীর্ঘমেয়াদে পরিশোধ করতে আপনার সংসার চালানোতে সমস্যা না হয়। “পলিসি ল্যাপ্স” হওয়ার চেয়ে ছোট কভারেজে শুরু করাও ভালো।
কভারেজ অ্যামাউন্ট নিয়ে আপস নয়: প্রিমিয়াম কমানোর লোভে কভারেজ কমাবেন না। জীবন বীমায় কভারেজ হওয়া চাই আপনার দায়িত্ব (ঋণ + সন্তানের ভবিষ্যৎ ব্যয় + ১০-১৫ বছর পারিবারিক ব্যয়) কভার করার মতো। স্বাস্থ্য বীমায় ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে হার্টের বাইপাস সার্জারি ৫-৭ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে – আপনার কভারেজ কি তা সামাল দিতে পারবে?
পলিসি টার্ম ও প্রিমিয়াম পেমেন্ট টার্ম বুঝুন:
- পলিসি টার্ম: কত বছর কভারেজ পাবেন? (টার্ম ইন্সুরেন্সে ৫-৪০ বছর, হোল লাইফে আজীবন)।
- প্রিমিয়াম পেমেন্ট টার্ম: কত বছর প্রিমিয়াম দিতে হবে? (কিছু পলিসিতে প্রিমিয়াম দেয়ার মেয়াদ পলিসি টার্মের চেয়ে কম হতে পারে, যেমন ১৫ বছরে প্রিমিয়াম দিয়ে ২৫ বছর কভারেজ)।
ক্লেইম সেটেলমেন্ট রেশিও (CSR) দেখুন: এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইনসুরেন্স পলিসি বাছাই করার টিপস গুলোর একটি। কোম্পানির CSR দেখে নিন। আইডিআরএ (ইন্সুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটি অব বাংলাদেশ) এর ওয়েবসাইটে এই তথ্য পাবেন। CSR 90% এর কম হলে সতর্ক হোন। এটি নির্দেশ করে কোম্পানি কত দ্রুত ও বিনা ঝামেলায় ক্লেইম মঞ্জুর করে। 95%+ CSR মানে কোম্পানির গ্রাহকসেবা ও আর্থিক সচ্ছলতা ভালো।
কোম্পানির আর্থিক সচ্ছলতা ও রেপুটেশন চেক করুন: শুধু নামীদামী বা বড় অফিস মানেই ভালো কোম্পানি নয়। আইডিআরএ কর্তৃক প্রকাশিত তাদের আর্থিক অবস্থা (Solvency Margin), বাজার শেয়ার এবং গ্রাহক অভিযোগের হার দেখুন। দীর্ঘমেয়াদী পলিসির ক্ষেত্রে কোম্পানির স্থায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পলিসি ডকুমেন্ট ভালো করে পড়ুন (বিশেষ করে ক্ষুদ্র ছাপ!):
- কভার করা ঝুঁকি (Covered Perils): ঠিক কী কী ক্ষেত্রে ক্লেইম পাবেন?
- কভার না করা ঝুঁকি (Exclusions): কোন কোন ক্ষেত্রে ক্লেইম দেওয়া হবে না? (যেমন: মদ্যপ অবস্থায় দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা, প্রাক-বিদ্যমান রোগ প্রথম কয়েক বছরে ইত্যাদি)।
- ওয়েটিং পিরিয়ড: বিশেষ করে স্বাস্থ্য বীমায়, নির্দিষ্ট কিছু অসুখ (যেমন হার্নিয়া, কাটা-ছেঁড়া, প্রি-একজিস্টিং ডিজিজ) প্রথম ৩০ দিন, ১ বছর বা ৪ বছর কভার হয় না।
- কুলিং-অফ পিরিয়ড: পলিসি কিনে ১৫-৩০ দিনের মধ্যে আপনি বিনা কারণ দেখিয়ে বাতিল করে পুরো টাকা ফেরত পেতে পারেন।
রিডার্সশিপ অপশন ও বেনিফিট বুঝুন: জীবন বীমায়, পলিসির মালিকানা (Ownership), টাকা কে পাবে (Beneficiary), এবং প্রিমিয়াম দিতে না পারলে কী অপশন আছে (ল্যাপ্স, পেইড-আপ ভ্যালু, লোন) – এগুলো জেনে নিন। স্বাস্থ্য বীমায়, রিনিউয়াল বেনিফিট (No Claim Bonus), রেস্টোরেশন বেনিফিট, ডে-কেয়ার কভার ইত্যাদি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিন।
অভিজ্ঞ ও বিশ্বস্ত উপদেষ্টার সন্ধান করুন: একজন ভালো এজেন্ট বা উপদেষ্টা শুধু পলিসি বিক্রি করেন না, তিনি আপনার আর্থিক পরামর্শদাতা। তিনি আপনার প্রয়োজন বুঝে সঠিক পণ্য সুপারিশ করবেন, ক্লেইম প্রক্রিয়ায় সাহায্য করবেন। তার লাইসেন্স নম্বর চেক করুন (আইডিআরএ ওয়েবসাইটে ভেরিফাই করা যায়)।
- নিয়মিত রিভিউ করুন: জীবনের ধাপ বদলায় – বিয়ে, সন্তান জন্ম, বাড়ি কেনা, চাকরি পরিবর্তন, আয় বৃদ্ধি। প্রতি ২-৩ বছর পর পর বা বড় জীবনের পরিবর্তনে আপনার বীমা কভারেজ রিভিউ করুন। যথেষ্ট কিনা? নতুন কোন ঝুঁকি যোগ হয়েছে?
বীমা কোম্পানি নির্বাচনের গোপন কৌশল: শুধু নামে প্রলুব্ধ হবেন না
কোম্পানি বাছাই ইনসুরেন্স পলিসি বাছাই করার টিপস এর অন্যতম চ্যালেঞ্জিং ধাপ। লক্ষ্য রাখুন:
- আইডিআরএ রেটিং: আইডিআরএ বীমা কোম্পানিগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য ও ব্যবস্থাপনার উপর ভিত্তি করে রেটিং দেয়। A বা A+ রেটেড কোম্পানি নির্বাচন করাই উত্তম। আইডিআরএ ওয়েবসাইটে সর্বশেষ রেটিং পাওয়া যাবে।
- ক্লেইম সেটেলমেন্ট রেশিও (আবারও!): এটি বার বার উল্লেখ করার কারণ হলো এর গুরুত্ব। উচ্চ CSR মানে দ্রুত, সহজে ও কম কাগজপত্রে ক্লেইম মিলবে।
- নেটওয়ার্ক হাসপাতাল (স্বাস্থ্য বীমার জন্য): আপনার পছন্দের বা নিকটবর্তী ভালো হাসপাতালগুলো কি কোম্পানির নেটওয়ার্কে আছে? ক্যাশলেস সুবিধা পাবেন?
- গ্রাহক সেবার খ্যাতি: অনলাইন রিভিউ, পরিচিতজনদের অভিজ্ঞতা, কোম্পানির কাস্টমার কেয়ার ইউনিটের প্রতিক্রিয়া দেখুন। ক্লেইমের সময়ই কোম্পানির আসল চেহারা বোঝা যায়।
- পণ্যের বৈচিত্র্য ও নমনীয়তা: কোম্পানিটি আপনার বিশেষ প্রয়োজন (যেমন: উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ পেশা, বিদেশে ভ্রমণ) মেটানোর জন্য নানা রাইডার বা অ্যাড-অন সুবিধা দেয় কি না?
তুলনা টেবিল (সামান্য ধারণার জন্য): (নির্দিষ্ট কোম্পানির নাম উল্লেখ না করে)
বৈশিষ্ট্য | কোম্পানি ‘ক’ | কোম্পানি ‘খ’ | কোম্পানি ‘গ’ | আপনার চেকলিস্ট |
---|---|---|---|---|
আইডিআরএ রেটিং (২০২৩) | A+ | A | A | A বা A+ |
গড় CSR (শেষ ৩ বছর) | ৯৬% | ৯২% | ৮৯% | ৯০%+ |
প্রধান শহরে নেটওয়ার্ক হাসপাতাল | ১০০+ | ৮০+ | ৬০+ | আপনার এলাকায়? |
অনলাইন ক্লেইম সাবমিশন | হ্যাঁ | হ্যাঁ | না | হ্যাঁ |
মোবাইল অ্যাপ সুবিধা | উন্নত | মৌলিক | নেই | গুরুত্বপূর্ণ |
(দ্রষ্টব্য: এটি একটি উদাহরণমূলক টেবিল। বাস্তবে প্রতিটি কোম্পানির জন্য নির্দিষ্ট ডেটা সংগ্রহ করুন)
প্রিমিয়াম বনাম কভারেজ: সঠিক ব্যালেন্স কিভাবে করবেন?
এটি ইনসুরেন্স পলিসি বাছাই করার টিপস এর সবচেয়ে সূক্ষ্ম বিষয়। প্রিমিয়াম কমাতে গিয়ে যেন প্রয়োজনীয় কভারেজ না কাটছাঁট হয়, আবার কভারেজ বাড়াতে গিয়ে প্রিমিয়াম এমন না হয় যা দিতে গিয়ে অন্যান্য জরুরি খরচ বাদ পড়ে।
- টার্ম ইন্সুরেন্সের জাদু: সর্বোচ্চ কভারেজ, সর্বনিম্ন প্রিমিয়াম পেতে চাইলে টার্ম ইন্সুরেন্সই সেরা বিকল্প। একজন ৩০ বছর বয়সী সুস্থ পুরুষ ১ কোটি টাকার কভারেজের জন্য মাসে মাত্র ৫০০-৮০০ টাকা প্রিমিয়াম দিতে পারেন (অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সরাসরি কেনার ক্ষেত্রে আরও কম)।
- স্বাস্থ্য বীমায় ডিডাক্টিবল: প্রিমিয়াম কমাতে চাইলে উচ্চ ডিডাক্টিবল (Deductible) বেছে নিতে পারেন। এর মানে হল একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ খরচ (যেমন ৫০০০ টাকা) আপনাকেই বহন করতে হবে, তারপরই বীমা কভার শুরু হবে। যারা কম হাসপাতালে ভর্তি হন তাদের জন্য ভালো অপশন।
- কভারেজ বাড়ানোর উপায়: প্রিমিয়াম সামান্য বাড়িয়ে ক্রিটিক্যাল ইলনেস রাইডার, পার্সোনাল অ্যাক্সিডেন্ট কভার, হাসপাতাল ক্যাশ বেনিফিট ইত্যাদি যুক্ত করতে পারেন। এগুলো কঠিন সময়ে অতিরিক্ত সুরক্ষা দেয়।
- গ্রুপ পলিসির সুবিধা: অফিস থেকে যদি গ্রুপ হেলথ বা লাইফ ইন্সুরেন্স থাকে, সেটা ভালো। তবে এটি যথেষ্ট নয়। ব্যক্তিগত পলিসি নিন, কারণ চাকরি পরিবর্তন করলে গ্রুপ কভারেজ চলে যেতে পারে।
অনলাইন বনাম অফলাইন: বীমা কেনার সেরা উপায় কোনটি?
ইনসুরেন্স পলিসি বাছাই করার টিপস এখন ডিজিটাল যুগে এসে পৌঁছেছে। দুটোরই সুবিধা-অসুবিধা আছে:
অনলাইন প্ল্যাটফর্ম (Policybazaar BD, Shonchoy, Bima Bazar):
- সুবিধা: দ্রুত তুলনা, প্রিমিয়ামে স্বচ্ছতা (কমিশন কম), সহজে একাধিক কোটেশন, ২৪/৭ এক্সেস, ডিজিটাল ডকুমেন্টেশন, প্রায়ই এক্সক্লুসিভ ডিসকাউন্ট।
- সীমাবদ্ধতা: জটিল পণ্য (যেমন: এন্ডোমেন্ট, ইউএলআইপি) বোঝা কঠিন হতে পারে, ব্যক্তিগতকৃত পরামর্শের অভাব, ক্লেইমের সময় হ্যান্ডহোল্ডিং কম থাকতে পারে।
- সেরা কখন: টার্ম ইন্সুরেন্স, ট্রাভেল ইন্সুরেন্স, বাইক/কার ইন্সুরেন্সের জন্য দারুণ।
- অফলাইন (এজেন্ট/কোম্পানি শাখা):
- সুবিধা: মুখোমুখি আলোচনা, জটিল পণ্যের বিশদ ব্যাখ্যা, দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক, ক্লেইম প্রক্রিয়ায় সরাসরি সাহায্য, কাগজপত্রে হাতেকলমে সাহায্য।
- সীমাবদ্ধতা: তুলনা করতে সময় লাগে, প্রিমিয়ামে এজেন্ট কমিশন যোগ হতে পারে, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কাজ করতে হয়।
- সেরা কখন: হোল লাইফ, এন্ডোমেন্ট, ইউএলআইপি, বা আপনার স্বাস্থ্যের জটিল ইতিহাস থাকলে যেখানে ব্যক্তিগতকৃত সুপারিশ দরকার।
হাইব্রিড অ্যাপ্রোচ: অনলাইনে রিসার্চ করে তুলনা করুন, প্রিমিয়াম চেক করুন। তারপর একজন লাইসেন্সপ্রাপ্ত উপদেষ্টার সাথে বসে আপনার চাহিদা নিয়ে আলোচনা করুন এবং তারপর কেনাকাটি করুন। এতে তথ্য ও ব্যক্তিগত পরামর্শ দুটোরই সুবিধা পাবেন।
জেনে রাখুন (FAQs)
প্রশ্ন: বীমা পলিসি কেনার সঠিক বয়স কত?
উত্তর: যত তাড়াতাড়ি, তত ভালো! সাধারণত চাকরিতে প্রবেশের পর (২২-২৫ বছর) বা আর্থিক দায়িত্ব নেওয়ার সাথে সাথেই শুরু করা উচিত। তরুণ বয়সে প্রিমিয়াম কম হয়, মেডিকেল টেস্টে পাস করা সহজ। দেরি করলে প্রিমিয়াম বাড়ে, স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে কভারেজ না মিলতে পারে।প্রশ্ন: টার্ম ইন্সুরেন্স না লাইফ ইন্সুরেন্স (যেমন: এন্ডোমেন্ট) – কোনটা বেছে নেব?
উত্তর: যদি শুধু মৃত্যুঝুঁকির সুরক্ষা ও সর্বোচ্চ কভারেজ চান এবং কম প্রিমিয়াম দিতে চান, তবে টার্ম ইন্সুরেন্স সেরা। যদি সুরক্ষার পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময় পর (যেমন: সন্তানের উচ্চশিক্ষার সময়) একটি বড় টাকা ফেরত চান (ম্যাচিউরিটি বেনিফিট), তবে এন্ডোমেন্ট পলিসি নিতে পারেন, যদিও এর প্রিমিয়াম টার্ম ইন্সুরেন্সের চেয়ে অনেক বেশি।প্রশ্ন: স্বাস্থ্য বীমায় “প্রি-একজিস্টিং ডিজিজ” (PED) বলতে কী বোঝায়?
উত্তর: পলিসি কেনার আগেই আপনার যে সকল অসুখ বা স্বাস্থ্য সমস্যা ছিল (যেমন: ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাঁপানি, আর্থ্রাইটিস), সেগুলোই প্রি-একজিস্টিং ডিজিজ। বেশিরভাগ পলিসিতে PED এর জন্য ২-৪ বছরের ওয়েটিং পিরিয়ড থাকে। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে PED এর কারণে হাসপাতালে ভর্তি হলে ক্লেইম দেওয়া হবে না (জরুরি কিছু ক্ষেত্র ছাড়া)। PED ডিক্লেয়ার করা বাধ্যতামূলক।প্রশ্ন: একাধিক বীমা পলিসি নেওয়া কি ঠিক?
উত্তর: হ্যাঁ, বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকির জন্য একাধিক পলিসি নেওয়া যুক্তিসঙ্গত। যেমন: একটি টার্ম লাইফ ইন্সুরেন্স + একটি হেলথ ইন্সুরেন্স + গাড়ির জন্য মোটর ইন্সুরেন্স। তবে একই ধরনের একাধিক পলিসি (যেমন: একাধিক হেলথ পলিসি) সাধারণত কভারেজ দ্বিগুণ করে না; এক্ষেত্রে “কন্ট্রিবিউটরি ক্লেইম” নিয়ম প্রযোজ্য হতে পারে। প্রয়োজন ও আর্থিক সামর্থ্য দেখে নিন।- প্রশ্ন: বীমা কোম্পানি যদি ক্লেইম দিতে অস্বীকার করে, তখন কী করব?
উত্তর: প্রথমে লিখিতভাবে কোম্পানির অভিযোগ বিভাগে যোগাযোগ করুন। কারণ জানতে চান। প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্ট জমা দিয়েছেন কিনা নিশ্চিত হোন। সাড়া না পেলে বা সন্তুষ্ট না হলে, আইডিআরএ-এর গ্রাহক সুরক্ষা সেল/অভিযোগ বিভাগে (http://www.idra.org.bd) লিখিত অভিযোগ দাখিল করুন। আইডিআরএ মধ্যস্থতা করে নিষ্পত্তির চেষ্টা করবে।
আপনার জীবনের অনিশ্চয়তাকে জয় করার হাতিয়ার এখন আপনার হাতেই। এই ইনসুরেন্স পলিসি বাছাই করার টিপস শুধু তথ্য নয়, এটা আপনার প্রিয় মানুষগুলোর মুখে হাসি রাখার একটি রোডম্যাপ। মনে রাখবেন, সঠিক বীমা পলিসি কোন বিলাসিতা নয়, আধুনিক জীবনের এক অপরিহার্য স্তম্ভ। প্রতিদিনের ছোট ছোট খরচ জমানোর চেয়ে, যে ঝড় কখন আসবে তারই জন্য প্রস্তুতি নেওয়া অনেক বেশি জরুরি। আজই সময় নিন, আপনার প্রয়োজন বিশ্লেষণ করুন, উপরের গাইডলাইন মেনে তুলনা করুন এবং একজন লাইসেন্সপ্রাপ্ত বীমা উপদেষ্টার সাথে কথা বলুন। আগামীকালের জন্য আজই গড়ে তুলুন একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ। আপনার সুরক্ষিত জীবনই আমাদের কামনা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।