মনে করুন, আপনার প্রিয় পুরনো গাড়িটা। যত্নে রাখতে চান বলেই তো কম্প্রিহেনসিভ ইন্স্যুরেন্স করলেন। কিন্তু যখনই প্রিমিয়ামের বিল আসে, মনে হয়, “এত টাকা কেন?” অথবা, সদ্যোজাত সন্তানের জন্য লাইফ ইন্স্যুরেন্স নিতে গিয়ে হঠাৎ দেখলেন, আপনার বন্ধুর প্রিমিয়াম আপনার চেয়ে অনেক কম! রাগ? হতাশা? না, শুধুই কৌতূহল – ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম কিভাবে নির্ধারিত হয় এই রহস্যের পিছনে লুকিয়ে আছে জটিল এক হিসাব-নিকাশের জগৎ। শুধু কোম্পানির ইচ্ছা নয়, আপনার জীবনযাপন, আপনার আশপাশ, এমনকি দেশের অর্থনীতিও এই প্রিমিয়ামের পরিমাণ ঠিক করতে ভূমিকা রাখে। ভয় পাবেন না, এই আর্টিকেল আপনাকে ধাপে ধাপে বুঝিয়ে দেবে কিভাবে আপনার ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম ঠিক হয়, কোন ফ্যাক্টরগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এবং কীভাবে আপনি সচেতনভাবে কিছুটা সাশ্রয়ও করতে পারেন। জেনে নিন এই টাকার খেলার নিয়ম, যাতে পরের বার প্রিমিয়াম বিল দেখে আপনি শুধু জানেনই না, বোঝেনও কেন এই অংকটা এলো।
ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম নির্ধারণের মূল নীতিঃ ঝুঁকির মূল্যায়ন
ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম কিভাবে নির্ধারিত হয় – এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে প্রথমেই বুঝতে হবে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মূল কাজ কী। সহজ ভাষায়, তারা আপনার কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট অংকের টাকা (প্রিমিয়াম) নিয়ে, ভবিষ্যতে আপনার ওপর পড়তে পারে বিশাল আর্থিক ঝুঁকি (যেমন গাড়ি দুর্ঘটনার ক্ষতি, চিকিৎসার বিপুল খরচ, বা পরিবারের জন্য আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা) নিজেরা বহন করার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি দেওয়ার আগে তাদের জানতে হবে – আসলেই আপনার ওপর সেই ঝুঁকি কতটা? এই ঝুঁকি মূল্যায়নই (Risk Assessment) প্রিমিয়াম নির্ধারণের ভিত্তি।
- অ্যাকচুয়ারিয়াল বিজ্ঞানঃ এই ঝুঁকি হিসেব করার কাজটি করেন বিশেষজ্ঞরা, যাদের বলা হয় অ্যাকচুয়ারি (Actuary)। তারা গাণিতিক মডেল, পরিসংখ্যান (Statistics) এবং সম্ভাব্যতা তত্ত্ব (Probability Theory) ব্যবহার করে বিশ্লেষণ করেন যে, আপনার মতো একজন ব্যক্তির (বা আপনার গাড়ি, বাড়ির মতো একটি সম্পত্তির) ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা কতটা, এবং সেই ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ কত হতে পারে। বাংলাদেশে ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটি (আইডিআরএ) এর নিয়ম মেনেই এই হিসাব-নিকাশ করতে হয় কোম্পানিগুলোকে। আইডিআরএ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট দেখুন।
- লাভ-লোকসানের ভারসাম্যঃ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে অবশ্যই টেকসই হতে হবে। তারা যে প্রিমিয়াম নেয়, তার থেকে সব মিলিয়ে (অর্থাৎ সব গ্রাহকের প্রিমিয়াম জমা) দাবি পরিশোধ (Claim Settlement) ও পরিচালন খরচ (Operational Expenses) বাদ দিয়ে কিছু মুনাফা রাখতে চায়। প্রিমিয়াম যদি খুব কম হয়, কোম্পানি লোকসানে পড়বে। আবার খুব বেশি হলে কেউ পলিসি কিনবে না। তাই ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম কিভাবে নির্ধারিত হয় তার কেন্দ্রে আছে এই সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষা করা।
আপনার প্রিমিয়ামকে প্রভাবিত করে এমন প্রধান ফ্যাক্টরগুলো (ব্যক্তিগত ইন্স্যুরেন্স)
ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম কিভাবে নির্ধারিত হয় তা আপনার ব্যক্তিগত জীবনযাপন এবং বৈশিষ্ট্যের ওপর অনেকটাই নির্ভর করে। দেখে নিন কোন কোন দিকগুলো কোম্পানি খুঁটিয়ে দেখেঃ
১. বয়স (Age)
- লাইফ/হেলথ ইন্স্যুরেন্সে: এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। সাধারণত, যত কম বয়স, তত কম প্রিমিয়াম। কারণ কম বয়সে দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতা বা মৃত্যুর ঝুঁকি তুলনামূলক কম। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই ঝুঁকি বাড়ে, তাই প্রিমিয়ামও বাড়তে থাকে। ২৫ বছর বয়সী একজন সুস্থ যুবকের টার্ম ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম ৫৫ বছর বয়সী একজনের চেয়ে অনেক কম হবে, একই কভারেজের জন্য।
- কেন? পরিসংখ্যান বলে বয়সের সাথে সাথে হৃদরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিসের মতো ক্রনিক ডিজিজের প্রকোপ বাড়ে, যা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির জন্য উচ্চতর দাবির সম্ভাবনা তৈরি করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী অসংক্রামক রোগের বৈশ্বিক বোঝা ক্রমাগত বাড়ছে, বয়স্ক জনগোষ্ঠীতে যা প্রকট।
২. স্বাস্থ্য অবস্থা ও মেডিকেল হিস্ট্রি (Health Status & Medical History)
- হেলথ/লাইফ ইন্স্যুরেন্সে: এটি প্রিমিয়াম নির্ধারণের আরেকটি মূল স্তম্ভ। পলিসি কেনার সময় সাধারণত একটি বিস্তৃত মেডিকেল চেক-আপ বা হেলথ ডিক্লারেশন ফর্ম পূরণ করতে হয়।
- প্রি-এক্সিস্টিং কন্ডিশন: ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে ঝুঁকি বেশি বলে প্রিমিয়াম উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যেতে পারে। কখনো কখনো বিশেষ শর্ত (Loading) আরোপ করা হয় বা সেই বিশেষ অসুস্থতা কভার থেকে বাদও দেওয়া হতে পারে (Exclusion)।
- লাইফস্টাইল: ধূমপান বা তামাক সেবন করলে প্রিমিয়াম নিশ্চিতভাবেই বেশি হবে (স্মোকার vs নন-স্মোকার রেট)। অতিরিক্ত ওজন (BMI), মদ্যপান, এবং এমনকি বিপজ্জনক পেশা বা শখ (যেমন পর্বতারোহণ) প্রিমিয়াম বাড়াতে পারে।
- পারিবারিক ইতিহাস: নিকটাত্মীয়দের (বাবা-মা, ভাইবোন) যদি অল্প বয়সে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা ক্যান্সারের ইতিহাস থাকে, তাহলেও কিছু কোম্পানি ঝুঁকি বেশি বিবেচনা করতে পারে।
- উদাহরণ: একই বয়সের দুই ব্যক্তি – একজন সম্পূর্ণ সুস্থ, অন্যজনের নিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস আছে। ডায়াবেটিস আছে এমন ব্যক্তির হেলথ ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম সুস্থ ব্যক্তির চেয়ে ২০-৫০% বা তারও বেশি হতে পারে।
৩. পেশা (Occupation)
- লাইফ/ডিসএবিলিটি/এক্সিডেন্টাল ইন্স্যুরেন্সে: আপনার পেশা সরাসরি আপনার দৈনন্দিন ঝুঁকির মাত্রাকে প্রভাবিত করে।
- উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ পেশা: খনি শ্রমিক, ইলেকট্রিশিয়ান, নির্মাণ শ্রমিক, ফায়ারফাইটার, পাইলট, জরিপকারী – এসব পেশায় দুর্ঘটনা বা পেশাগত রোগের ঝুঁকি বেশি। ফলে প্রিমিয়ামও বেশি ধার্য হয়।
- নিম্ন ঝুঁকিপূর্ণ পেশা: অফিসে বসে কাজ করা পেশাজীবী, শিক্ষক, হিসাবরক্ষক – এসব পেশায় তুলনামূলক ঝুঁকি কম, তাই প্রিমিয়ামও কম।
- কেন? পরিসংখ্যানগতভাবে দেখা গেছে, কিছু পেশায় মৃত্যুহার বা স্থায়ী অক্ষমতার হার অন্যদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
৪. পলিসির ধরন ও কভারেজ (Policy Type & Coverage)
- সব ধরণের ইন্স্যুরেন্সে: আপনি কোন পলিসি বেছে নিচ্ছেন এবং সেখানে কতটুকু সুরক্ষা (Coverage) চাইছেন, তা প্রিমিয়ামে সরাসরি প্রভাব ফেলে।
- পলিসির ধরন: সাধারণ টার্ম ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম এন্ডোমেন্ট বা মানি ব্যাক পলিসির চেয়ে কম হয়। হোল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম সাধারণত সবচেয়ে বেশি। গাড়ির ক্ষেত্রে থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম কম্প্রিহেনসিভের চেয়ে অনেক কম।
- সুম অ্যাসার্ড (Sum Assured): এটি হচ্ছে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সর্বোচ্চ দায়বদ্ধতার পরিমাণ। লাইফ/হেলথ ইন্স্যুরেন্সে আপনি যত বেশি টাকার কভার নেবেন, প্রিমিয়াম তত বেশি হবে। গাড়ির ইন্স্যুরেন্সে গাড়ির ইন্স্যুরড ডিক্লেয়ার্ড ভ্যালু (IDV) যত বেশি, প্রিমিয়ামও তত বেশি।
- পলিসির মেয়াদ (Term): লাইফ ইন্স্যুরেন্সে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য (যেমন ৩০ বছর) স্বল্প মেয়াদের (যেমন ১০ বছর) চেয়ে প্রিমিয়াম কম হতে পারে (যদি একই বয়সে কেনা হয়), কারণ মোট প্রিমিয়াম বেশি সময় ধরে জমা হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে দীর্ঘ মেয়াদে মোট প্রিমিয়ামের পরিমাণ বেশি হতে পারে।
- রাইডার্স (Riders): বেসিক পলিসির সাথে অতিরিক্ত সুবিধা যেমন ক্রিটিক্যাল ইলনেস কভার, এক্সিডেন্টাল ডেথ বেনিফিট, ডিসএবিলিটি বেনিফিট ইত্যাদি যোগ করলে প্রিমিয়াম স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে।
আপনার প্রিমিয়ামকে প্রভাবিত করে এমন প্রধান ফ্যাক্টরগুলো (প্রপার্টি ও গাড়ি ইন্স্যুরেন্স)
ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম কিভাবে নির্ধারিত হয় শুধু আপনার ব্যক্তিগত তথ্যেই নয়, আপনার সম্পত্তির বৈশিষ্ট্যের ওপরেও নির্ভর করে।
১. গাড়ি ইন্স্যুরেন্সে (Motor Insurance)
- গাড়ির ধরণ, মডেল ও বয়স (Make, Model & Age): লাক্সারি কার, হাই-এন্ড এসইউভি বা দ্রুতগতির কারগুলো মেরামত খরচ বেশি হয় এবং চুরি হওয়ার ঝুঁকিও বেশি থাকে। ফলে এগুলোর প্রিমিয়াম বেশি। নতুন গাড়ির প্রিমিয়াম বেশি, বয়স বাড়ার সাথে সাথে গাড়ির বাজারমূল্য কমে যায় বলে ইন্স্যুরড ডিক্লেয়ার্ড ভ্যালু (IDV) কমে, ফলে প্রিমিয়ামও কমে। কিছু মডেলের দুর্ঘটনার হার পরিসংখ্যানগতভাবে বেশি হলেও তাদের প্রিমিয়াম বেশি হতে পারে।
- ইঞ্জিনের ক্ষমতা (CC): সাধারণত ১৫০০ সিসির ওপরের গাড়ির প্রিমিয়াম বেশি হয়।
- গাড়ির ব্যবহার (Usage): গাড়িটি ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য নাকি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে (যেমন ট্যাকি বা ডেলিভারি ভ্যান) ব্যবহার করা হবে? বাণিজ্যিক যানবাহন সাধারণত বেশি দূরত্ব ভ্রমণ করে এবং বেশি ব্যবহারের কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেশি বলে তাদের প্রিমিয়াম বেশি হয়।
- জিওগ্রাফিক্যাল জোন (Geographical Zone): বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (BIA) বা আইডিআরএ নির্ধারিত জোন অনুযায়ী প্রিমিয়াম ভিন্ন হয়। ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো মহানগরীতে গাড়ি চুরি, দুর্ঘটনা এবং ভাংচুরের ঝুঁকি বেশি বলে সেখানে প্রিমিয়ামও বেশি। প্রত্যন্ত এলাকায় ঝুঁকি কম বলে প্রিমিয়াম কম হতে পারে।
- ক্লেইম হিস্ট্রি (Claim History): আপনার গাড়ির ইন্স্যুরেন্স ক্লেইমের ইতিহাস থাকলে (বিশেষ করে যদি আপনি দায়ী হন), পরবর্তী বছরে আপনার প্রিমিয়াম বেড়ে যেতে পারে। একে নোক্লেইম বোনাস (NCB) হারানোও বলা যেতে পারে। নোক্লেইম বোনাস ধরে রাখতে পারলে প্রিমিয়াম কমতে থাকে।
- সুরক্ষা ব্যবস্থা (Security Features): গাড়িতে এন্টি-থেফট অ্যালার্ম, জিপিএস ট্র্যাকার সিস্টেম ইত্যাদি থাকলে চুরির ঝুঁকি কমে, ফলে প্রিমিয়াম কিছুটা কম পাওয়া যেতে পারে।
২. বাড়ি/প্রপার্টি ইন্স্যুরেন্সে (Home/Property Insurance)
- প্রপার্টির অবস্থান (Location): বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত সম্পত্তির ঝুঁকি বেশি বলে প্রিমিয়াম বেশি হবে। চুরি-ডাকাতির হার বেশি এমন এলাকাও প্রিমিয়াম বাড়ায়। ফায়ার স্টেশন বা পুলিশ স্টেশনের কাছাকাছি সম্পত্তির প্রিমিয়াম কিছুটা কম হতে পারে।
- নির্মাণ সামগ্রী ও কাঠামো (Construction Material & Structure): দালানটি পাকা (কংক্রিট, ইট) নাকি আধাপাকা/কাঁচা? দালানের বয়স কত? আধুনিক ফায়ার-রেজিস্ট্যান্ট ম্যাটেরিয়ালে তৈরি নতুন দালানের ঝুঁকি পুরনো বা কম শক্তিশালী কাঠামোর চেয়ে কম, ফলে প্রিমিয়াম কম হতে পারে।
- সম্পত্তির মূল্য (Property Value): সম্পত্তির বাজারমূল্য এবং পুনঃনির্মাণ খরচ (Reinstatement Value) যত বেশি, সুম অ্যাসার্ড তত বেশি, ফলে প্রিমিয়ামও তত বেশি হবে।
- সুরক্ষা ব্যবস্থা (Security Measures): বাড়িতে সিসিটিভি, বার্গলার অ্যালার্ম, ফায়ার অ্যালার্ম, ফায়ার এক্সটিংগুইশার ইত্যাদি থাকলে ঝুঁকি কমে বলে প্রিমিয়ামে ডিসকাউন্ট মিলতে পারে।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর যা প্রিমিয়াম নির্ধারণ করে
ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম কিভাবে নির্ধারিত হয় শুধু গ্রাহক বা সম্পত্তির ফ্যাক্টরেই সীমাবদ্ধ নয়। কিছু বাহ্যিক এবং কোম্পানির নিজস্ব ফ্যাক্টরও ভূমিকা রাখেঃ
- ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অভ্যন্তরীণ নীতি ও খরচ (Company’s Underwriting Policy & Expenses): প্রতিটি কোম্পানির ঝুঁকি মূল্যায়নের নিজস্ব মডেল ও গাণিতিক সূত্র (অ্যাকচুয়ারিয়াল টেবিল) আছে। তাদের পরিচালন ব্যয় (অফিস ভাড়া, কর্মচারী বেতন, এজেন্ট কমিশন, মার্কেটিং খরচ) এবং লাভের টার্গেটও প্রিমিয়ামে যুক্ত হয়।
- অর্থনৈতিক পরিবেশ (Economic Environment): মুদ্রাস্ফীতি (Inflation) মেরামত খরচ ও চিকিৎসা খরচ বাড়ায়, ফলে প্রিমিয়ামও বাড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হারও কিছু পরোক্ষ প্রভাব রাখতে পারে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্বাস্থ্যখাতে খরচ বৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্য, যা স্বাস্থ্য বীমার প্রিমিয়াম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
- দাবির প্রবণতা (Claim Trends): কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় বা কোনো নির্দিষ্ট ধরণের পলিসিতে (যেমন বন্যার পরে বা মহামারীর সময়) যদি হঠাৎ করেই দাবির পরিমাণ বেড়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে ঐ এলাকা বা পলিসির প্রিমিয়াম সামগ্রিকভাবে বাড়তে পারে।
- বাজারে প্রতিযোগিতা (Market Competition): প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে কোম্পানিগুলো গ্রাহক আকর্ষণ করতে কখনো কখনো প্রিমিয়াম কমিয়ে অফার দিতে পারে (যদিও কোর বেনিফিটে পরিবর্তন না এনে)। তবে আইডিআরএ প্রিমিয়ামের একটি ন্যূনতম সীমা নির্ধারণ করে দিতে পারে, যার নিচে কোম্পানি বিক্রি করতে পারবে না।
- ডিসকাউন্ট ও অফার (Discounts & Offers): অনলাইনে কেনাকাটা করলে, বার্ষিক প্রিমিয়াম একসাথে পরিশোধ করলে, দীর্ঘমেয়াদী পলিসি নিলে, বা একাধিক পলিসি একই কোম্পানির কাছ থেকে নিলে (যেমন বাড়ি ও গাড়ি) কিছু ডিসকাউন্ট পাওয়া যায়। নোক্লেইম বোনাস (NCB) গাড়ি ইন্স্যুরেন্সে প্রিমিয়াম কমানোর সবচেয়ে বড় উপায়।
আপনি কীভাবে ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম কমাতে পারেন? কিছু কার্যকরী টিপস
ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম কিভাবে নির্ধারিত হয় জানার পর এবার আসুন, এই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে কিছুটা হলেও প্রিমিয়াম কমিয়ে আনতে পারেনঃ
- সুস্থ জীবনযাপন করুন: ধূমপান ত্যাগ করুন, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন, নিয়মিত ব্যায়াম করুন। স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান এবং প্রি-এক্সিস্টিং কন্ডিশন থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখুন। সুস্থ দেহই কম প্রিমিয়ামের চাবিকাঠি, বিশেষ করে হেলথ ও লাইফ ইন্স্যুরেন্সে।
- তুলনা করুন, তুলনা করুন, তুলনা করুন: শুধু এক কোম্পানির কাছ থেকে কোটেশন নেবেন না। অন্তত ৩-৫টি বিশ্বস্ত ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে একই রকম কভারেজের জন্য প্রিমিয়ামের কোটেশন নিন। অনলাইন ইন্স্যুরেন্স মার্কেটপ্লেস (যদি থাকে) বা ব্রোকার ব্যবহার করে সহজেই এটি করা যায়। দেখুন কোন কোম্পানি আপনার প্রোফাইলের জন্য সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক রেট দিচ্ছে। মনে রাখবেন, শুধু কম প্রিমিয়াম দেখে কিনবেন না, কোম্পানির ক্লেইম সেটেলমেন্ট রেশিও (Claim Settlement Ratio – CSR) অবশ্যই চেক করুন। [আইডিআরএ সাধারণত কোম্পানিগুলোর বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ করে, যেখানে CSR পাওয়া যেতে পারে]।
- সঠিক সময়ে ইন্স্যুরেন্স নিন: যত কম বয়সে লাইফ বা হেলথ ইন্স্যুরেন্স শুরু করবেন, প্রিমিয়াম তত কম পড়বে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রিমিয়াম বাড়তে থাকে এবং স্বাস্থ্যজনিত জটিলতাও দেখা দিতে পারে যা পলিসি পাওয়াকে কঠিন বা ব্যয়বহুল করে তোলে।
- সঠিক সুম অ্যাসার্ড ও কভারেজ বেছে নিন: আপনার প্রকৃত চাহিদা বুঝে সুম অ্যাসার্ড ঠিক করুন। অপ্রয়োজনে অতিরিক্ত কভারেজ নিলে প্রিমিয়াম বাড়বে। আবার প্রয়োজনের তুলনায় কম কভারেজ নিলে ঝুঁকি থেকে যাবে। গাড়ির ক্ষেত্রে IDV বাস্তবসম্মত রাখুন (গাড়ির বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী)।
- পলিসির মেয়াদ ও প্রিমিয়াম পরিশোধের ফ্রিকোয়েন্সি বুদ্ধিমত্তার সাথে বেছে নিন: লাইফ ইন্স্যুরেন্সে দীর্ঘ মেয়াদে লক-ইন রেটে কম প্রিমিয়াম পেতে পারেন। বার্ষিক প্রিমিয়াম একসাথে দিলে সাধারণত কোয়ার্টারলি বা মাসিক কিস্তির চেয়ে সামগ্রিক খরচ কম হয়।
- নোক্লেইম বোনাস (NCB) ধরে রাখুন: গাড়ি ইন্স্যুরেন্সে ছোটখাটো ক্ষতি নিজেই মেরামত করে নিলে ক্লেইম না করে নোক্লেইম বোনাস বজায় রাখুন। NCB জমতে জমতে প্রিমিয়াম উল্লেখযোগ্যভাবে (৫০% পর্যন্ত) কমে যায়।
- সুরক্ষা ব্যবস্থা বাড়ান: গাড়িতে এন্টি-থেফট ডিভাইস, বাড়িতে ফায়ার ও সিকিউরিটি সিস্টেম বসালে প্রিমিয়ামে কিছুটা ছাড় পাওয়া সম্ভব।
- কম ঝুঁকিপূর্ণ বিকল্প বেছে নিন: গাড়ির ইন্স্যুরেন্সে থার্ড পার্টি কভার কম্প্রিহেনসিভের চেয়ে সস্তা। তবে কম কভারেজের বিনিময়ে কম প্রিমিয়ামের এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ঝুঁকি ভালো করে বুঝে নিন।
- ডিসকাউন্টের সুযোগ কাজে লাগান: অনলাইন কেনাকাটা, বার্ষিক পেমেন্ট, গ্রুপ ইন্স্যুরেন্স (অফিস বা অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে) ইত্যাদির মাধ্যমে প্রায়ই ডিসকাউন্ট পাওয়া যায়।
- এক্সসেস ফি বাড়িয়ে দিন (হেলথ ইন্স্যুরেন্সে): হেলথ ইন্স্যুরেন্সে আপনি যদি ছোটখাটো চিকিৎসার খরচ নিজে বহন করার সক্ষমতা রাখেন, তাহলে স্বেচ্ছায় এক্সসেস ফি (ক্লেইমের সময় আপনার শেয়ার) বাড়িয়ে নিতে পারেন। এতে প্রিমিয়াম কম হবে। তবে জরুরি অবস্থার কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিন।
ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম কিভাবে নির্ধারিত হয় – এই জটিল প্রক্রিয়ার রহস্য ভেদ করে আপনি এখন জানেন আপনার প্রিমিয়াম কেন এলো সেই অংকটা। এটা কোন অদৃশ্য শক্তির খেয়ালখুশি নয়, বরং ঝুঁকির গাণিতিক হিসাব, আপনার ব্যক্তিগত ও সম্পত্তির বৈশিষ্ট্য এবং বাজার ও অর্থনীতির নানা দিকের সমন্বিত ফলাফল। এই জ্ঞান আপনাকে শুধু প্রিমিয়াম বিলের প্রতি অসন্তোষ দূর করতেই সাহায্য করবে না, বরং একজন সচেতন গ্রাহক হিসেবে সঠিক ইন্স্যুরেন্স পণ্য বেছে নিতে, প্রয়োজনীয় কভারেজ নিশ্চিত করতে এবং যুক্তিসঙ্গত প্রিমিয়ামে টেকসই সুরক্ষা পেতে সাহায্য করবে। তাই পরের বার ইন্স্যুরেন্স নেওয়ার সময় শুধু প্রিমিয়ামের অংকটাই দেখবেন না, দেখুন সেটা কিভাবে এলো, এবং আপনার অবস্থান ও চাহিদার সাথে তা কতটা সঙ্গতিপূর্ণ। ইন্স্যুরেন্স এজেন্ট বা কোম্পানির সাথে খোলামেলা আলোচনা করুন, আপনার প্রিমিয়ামকে প্রভাবিত করতে পারে এমন প্রতিটি ফ্যাক্টর বুঝে নিন। সঠিক তথ্য দিয়ে পলিসি নিলে ভবিষ্যতে ক্লেইমে জটিলতা কমবে। সাশ্রয়ী প্রিমিয়ামে সর্বোত্তম সুরক্ষা পেতে আজই বিভিন্ন কোম্পানির প্রিমিয়াম রেট তুলনা করে দেখুন এবং আপনার জন্য সেরা পলিসিটি বেছে নিন।
জেনে রাখুন-
১. প্রশ্নঃ ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম প্রতি বছর বাড়ে কেন?
- উত্তরঃ ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম বাড়ার বেশ কিছু কারণ আছে। প্রথমত, আপনার বয়স বাড়ার সাথে সাথে (বিশেষ করে লাইফ ও হেলথ ইন্স্যুরেন্সে) ঝুঁকি বাড়ে, ফলে প্রিমিয়াম বাড়তে পারে। দ্বিতীয়ত, মুদ্রাস্ফীতির কারণে মেরামত খরচ, চিকিৎসা খরচ, নতুন গাড়ি বা বাড়ির দাম বাড়ে, ফলে ক্ষতিপূরণের খরচও বাড়ে। তৃতীয়ত, যদি আপনার দাবির ইতিহাস থাকে (বিশেষ করে গাড়ি ইন্স্যুরেন্সে), তাহলে নোক্লেইম বোনাস হারিয়ে প্রিমিয়াম বাড়তে পারে। চতুর্থত, সামগ্রিকভাবে কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় বা পলিসি ধরণে দাবির হার বেড়ে গেলে কোম্পানি সামগ্রিক প্রিমিয়াম রেট বাড়িয়ে দিতে পারে।
২. প্রশ্নঃ একই বয়সের দুই জনের লাইফ ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম আলাদা হয় কেন?
- উত্তরঃ শুধু বয়সই একমাত্র ফ্যাক্টর নয়। তাদের স্বাস্থ্য অবস্থা (প্রি-এক্সিস্টিং ডিজিজ আছে কিনা, BMI, ধূমপান করে কিনা), পেশা (ঝুঁকিপূর্ণ পেশা কিনা), পারিবারিক মেডিকেল হিস্ট্রি, নেওয়া পলিসির ধরন (টার্ম, এন্ডোমেন্ট, হোল লাইফ), সুম অ্যাসার্ডের পরিমাণ এবং এমনকি তারা কোন কোম্পানির পলিসি নিয়েছে তার ওপর ভিত্তি করেও প্রিমিয়াম ভিন্ন হতে পারে। একজন সুস্থ নন-স্মোকারের প্রিমিয়াম একজন স্মোকার বা ডায়াবেটিস রোগীর চেয়ে কম হবে।
৩. প্রশ্নঃ গাড়ি ইন্স্যুরেন্সে নোক্লেইম বোনাস (NCB) আসলে কী? এটা কতটা প্রিমিয়াম কমাতে পারে?
- উত্তরঃ নোক্লেইম বোনাস (NCB) হলো একটি পুরষ্কার স্বরূপ ডিসকাউন্ট, যা আপনি তখনই পান যখন আপনি পূর্ববর্তী বছরে কোনো ক্লেইম করেননি। এটি প্রিমিয়ামের একটি বড় অংশ কমাতে পারে। NCB সাধারণত প্রতি বছর ধাপে ধাপে বাড়ে (যেমন প্রথম বছর ২০%, দ্বিতীয় বছর ২৫%, …, পঞ্চম বছর ৫০% পর্যন্ত)। আপনার গাড়ির প্রিমিয়ামের ওপর এই শতাংশ হারে ডিসকাউন্ট প্রযোজ্য হয়। NCB গ্রাহকের সাথে লিঙ্কড, গাড়ির সাথে নয়। তাই গাড়ি বিক্রি করলেও পরবর্তী গাড়ির ইন্স্যুরেন্সে আপনার জমানো NCB ব্যবহার করতে পারবেন।
৪. প্রশ্নঃ অনলাইনে ইন্স্যুরেন্স কিনলে প্রিমিয়াম কম পাওয়া যায় কি?
- উত্তরঃ হ্যাঁ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনলাইনে সরাসরি ইন্স্যুরেন্স কিনলে প্রিমিয়াম কিছুটা কম পাওয়া যায়। এর প্রধান কারণ হলো কোম্পানির এজেন্ট বা ব্রোকারকে কমিশন দিতে হয় না, ফলে সেই সঞ্চয় তারা গ্রাহককে ডিসকাউন্ট আকারে ফেরত দিতে পারে। এছাড়াও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে দ্রুত তুলনা করে সেরা ডিল বেছে নেওয়া সহজ হয়। তবে কেনার আগে কভারেজের বিস্তারিত ভালো করে বুঝে নিন।
৫. প্রশ্নঃ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ক্লেইম সেটেলমেন্ট রেশিও (CSR) দেখে প্রিমিয়াম বাছাই করা কি ঠিক?
- উত্তরঃ CSR একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মেট্রিক যা দেখে বোঝা যায় কোন কোম্পানি দাবি পাওয়ার পর কতটা নির্ভরযোগ্যভাবে তা পরিশোধ করে। সাধারণত, ৯০%-এর উপরে CSR ভালো বলে ধরা হয়। তবে শুধু কম প্রিমিয়াম দেখে নিম্ন CSR সম্পন্ন কোম্পানির পলিসি নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আবার সর্বোচ্চ CSR সম্পন্ন কোম্পানির প্রিমিয়াম অনেক বেশি হলে সেটাও ভেবে দেখতে হবে। সঠিক কৌশল হলো প্রতিযোগিতামূলক প্রিমিয়াম দেওয়া এমন কয়েকটি কোম্পানির মধ্য থেকে যাদের CSR গ্রহণযোগ্য মাত্রার উপরে (বলা চলে ৮৫%+) সেসব কোম্পানিকে অগ্রাধিকার দেওয়া। প্রিমিয়াম এবং CSR – দুটোরই ভারসাম্য বিবেচনা করতে হবে।
৬. প্রশ্নঃ হেলথ ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম কি কর ছাড়ের জন্য যোগ্য?
- উত্তরঃ হ্যাঁ, বাংলাদেশে ব্যক্তিগত আয়করদাতাদের জন্য স্বাস্থ্য বীমার প্রিমিয়াম কর ছাড়ের আওতায় পড়ে। আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ এর ধারা ৪৪(২) অনুযায়ী, নিজের, স্ত্রী/স্বামী, এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের জন্য প্রদত্ত স্বাস্থ্য বীমা প্রিমিয়ামের উপর নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত কর ছাড় পাওয়া যায়। প্রতিবছর অর্থবছরের প্রারম্ভে এই সীমা পুনঃনির্ধারিত হতে পারে, তাই সর্বশেষ তথ্যের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (NBR) ওয়েবসাইট বা আপনার কর উপদেষ্টার সাথে যোগাযোগ করুন। ছাড়ের জন্য প্রিমিয়ামের রশিদ এবং পলিসি কপি সংরক্ষণ করতে হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।