স্পোর্টস ডেস্ক : ফুটবলে দু’হাত খুলে বিনিয়োগ করছে সৌদি আরব। বছরের শুরুতে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে দিয়ে শুরু। এরপর করিম বেনজেমা, নেইমার জুনিয়র, সাদিও মানে, রিয়াদ মাহরেজদের মতো ফুটবলার ভিড়িয়েছে সৌদি ক্লাবগুলো। আছে ফিরমিনো, ফ্যাবিনহো, জর্ডান হ্যান্ডারসন, ক্লদিও কাউলিবালি, ইয়াসিন বোনোর মতো নামও।
আকাশচুম্বী বেতনের শর্তে সৌদি ক্লাবে খেলতে রাজি হয়েছেন এই তারকারা। এই যেমন- রোনালদো আড়াই বছরের চুক্তিতে সব মিলিয়ে পকেটে পুরবেন প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার। নেইমারকে দুই বছরের জন্য এড অন্স, বাণিজ্যিক চুক্তি মিলিয়ে ৪০০ মিলিয়ন ডলার পাইয়ে দেওয়ার আশা দিয়েছে সৌদি। বেনজেমা পুরো রিয়াল মাদ্রিদ ক্যারিয়ারে যে বেতন পেয়েছেন বুড়ো বয়সে সৌদিতে এসে দুই বছরে পাবেন সেই অর্থ। তাকে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার দেবে তার ক্লাব।
উপরে উল্লেখিত ফুটবলাররাও পাবেন মোটা অঙ্কের বেতন। সঙ্গে মানে, বোনো, ম্যালকম, ইবানেজদের কিনতে হয়েছে ক্লাবটির। তার জন্যও খরচ হয়েছে মোটা অঙ্কের অর্থ। প্রশ্ন হলো- ফুটবলে বিনিয়োগ করার এতো অর্থ সৌদি ফুটবল কর্তৃপক্ষ পাচ্ছে কোথায়, বিশাল এই অর্থ বিনিয়োগের উদ্দেশ্য কী?
সৌদি ফুটবল কর্তৃপক্ষের অর্থের উৎস: ফুটবলে বিনিয়োগ করার জন্য সৌদি আরব কর্তৃপক্ষকে বিশাল অঙ্কের এই অর্থ দিচ্ছে পাবলিক ইনভেসমেন্ট ফান্ড (পিআইএফ)। বিশ্বের ষষ্ঠ সার্বভৌম্য সম্পদশালী তহবিল এটি। যার আর্থিক কাঠামো প্রায় ৭৭৬ বিলিয়ন ডলার (১ বিলিয়নে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা)। তহবিলটি সৌদি আরবের ফুটবলে ২০২১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র ৭ বিলিয়ন ডলার বা ৭৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে (দ্য গার্ডিয়ান)।
পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড কী: সৌদি আরব সরকার ১৯৭১ সালে পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড গঠন করে। দেশটির গর্ভনর এটির তত্বাবধায়ন করেন। দেশটির বর্তমান ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান এটি পরিচালনা করেন। তহবিলটি সৌদির ভেতরে ৬০ শতাংশ কার্যক্রম পরিচালনা করে। দেশটির ব্যবসা-বাণিজ্য, রিয়েল স্টেট, ট্যুরিজম খাতে এটি বিনিয়োগ করে। আর এই বিনিয়োগের মূল উদ্দেশ্য দেশ তথা সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা।
সৌদির ফুটবলে বিনিয়োগ: পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড ফুটবলে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ করেছে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব নিউক্যাসল ইউনাইটেড কেনার জন্য। ২০২০ সালে প্রায় ৪১৫ মিলিয়ন ডলার দিয়ে ক্লাবটির মালিকানা নেয় ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড। ক্লাবটিকে ৩১৫ বিলিয়ন ডলারের ফান্ড দিয়েছে পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড। তখনই সৌদি আরবের রাজ পরিবারের ক্লাব হিসেবে পরিচিত আল হিলাল, আল ইত্তিহাদ, আল নাসর ও আল আহলির আর্থিক পরিচালনার দায়িত্বভার নেয় ক্লাবটি। সৌদি আরব ফুটবলে এখন পর্যন্ত অর্থের ঝনঝনানি দিয়ে যে বাজিমাত করেছে তা মূলত এই চার ক্লাবই করেছে।
ফুটবলে বিনিয়োগের উদ্দেশ্য: প্রশ্ন হলো, এতো অর্থ সৌদি কর্তৃপক্ষ ফুটবলের পেছনে বিনিয়োগ করছে কেন? ২০৩০ ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজনের বিডে অংশ নেওয়ার কথা বলা হলেও সেখান থেকে অনেকটা সরে এসেছে সৌদি। দ্য গার্ডিয়ান তাদের প্রতিবেদনে সরকারের ভাবমূর্তি সম্মুনত করার কথা বলছে। যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। ক্রীড়া মাধ্যম দিয়ে ওই ভাবমূর্তি উজ্জ্বল বা সম্মুনত করার মিশন হাতে নিয়েছে রাষ্ট্রটি। মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা গ্রান্ট লিবার্টি, আর্মনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইট ওয়াচ যেটাকে বলছে ‘স্পোর্টসওয়াশ’। অর্থাৎ ক্রীড়া মাধ্যম ব্যবহার করে রাষ্ট্রের ইমেজ ধোলাই করা।
স্পোর্টসওয়াশ কেন দরকার: সৌদি আরবের বিরুদ্ধে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে। ২০১৮ সালে সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যা আরও জোরালো হয়। সৌদি আরব ইমেজ সংকটে পড়ে যায়। গত বছর লিডস ইউনিভিার্সিটির ৩৪ বছর বয়সী সৌদি শিক্ষার্থী সালমা বিন শেহাব ভিন্ন মতাদর্শের টুইটার ফলো করায় এবং রিটুইট করায় দেশে ফেরার পর ৩৪ বছরের কারাদণ্ড পান। ইয়ামেনে হত্যা, ধর্ষণে মদদ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে সৌদির বিরুদ্ধে। সঙ্গে নারী স্বাধীনতা, শ্রমিক নির্যাতন ও কঠোর শাস্তির বিধানের কারণে সমালোচিত হয় রাষ্ট্রটি। যে কারণে বিদেশিরা বিনিয়োগ স্থগিত ও প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেয়। ইমেজ ধোলাইয়ের জন্য সৌদি তাই স্পোর্টসওয়াশের পথ বেছে নিয়েছে বলে দ্য গার্ডিয়ানের উল্লেখ করা হয়েছে।
পূর্বে কেন বিনিয়োগ করেনি: মানবাধিকার সংস্থা গ্রান্ট লিবার্টি দাবি করেছে, খাসোগি হত্যাকাণ্ডের পর ক্রীড়া ব্যক্তিত্বদের মানবাধিকার লঙ্ঘন অভিযোগের কারণে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি সৌদি। ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ও ব্র্যান্ড সৌদি আরবর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। তবে সম্প্রতি প্রো লিগের আকর্ষণীয় সব প্রস্তাবের মাধ্যমে হাওয়া বদলে দিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। সৌদি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা থেকে বহু দূরে থাকা শর্তেও রোনালদো-বেনজেমা-নেইমাররা সৌদিমুখী হওয়ায় উদ্বেগও প্রকাশ করেছে গ্রান্ট লিবার্টি।
যে যে ক্রীড়াখাতে সৌদির বিনিয়োগ: শুধু ফুটবলে নয় সৌদি কর্তৃপক্ষ অন্যান্য ক্রীড়াক্ষেত্রেও মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ করেছে ও করছে। ২০২১ সালে তারা লিভ গলফ (LIV Golf) চালু করেছে। যার জন্য প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি ক্রিকেটে বিনিয়োগ করার কথা ভাবছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। নতুন টি-২০ লিগ আনতে চাওয়া, আইপিএলের সঙ্গে চুক্তিতে যাওয়ার খবর তারই অংশ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।