মুফতি আবদুল্লাহ তামিম : বৈদেশিক মুদ্রা বা ‘ফরেক্স মার্কেট’ বিশ্বের বৃহত্তম আর্থিক বাজার। এখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুদ্রার পাল্টাপাল্টি লেনদেন হয়। এটি একটি অপ্রতিরোধ্য নগদ বাজার যেখানে ব্রোকারদের মাধ্যমে দেশের মুদ্রা বিনিময় করা হয়। ফরেইন এক্সচেঞ্জ ট্রেডিং বা ফরেক্স ট্রেডিংয়ের মাঝে অনেক প্রকার লেনদেন করা হয়ে থাকে।
Carry trade (ক্যারি ট্রেড)। ফরেক্স কমোডিটি ট্রেডিং। স্পট ট্রেড (Spot trade )। ফিউচার ট্রেড। এসব প্রকার লেনদেন বেশি প্রসিদ্ধ। এসবের বিধান জানতে হলে বিষয়গুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা জরুরি।
Carry trade (ক্যারি ট্রেড)। এর সারমর্ম হলো, কম দামে কারেন্সি ক্রয় করে দাম বাড়লে বেশি দামে বিক্রি করা। এভাবে দুই কারেন্সির মাঝখানের লাভ-ক্ষতিটাই ট্রেডারের লাভ ও ক্ষতি। এ পদ্ধতিটা ব্যাংক ও অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের মতই। যারা কম সুদে ঋণ নেয় এবং বেশি সুদে ঋণ প্রদান করে। আর এ দুইয়ের মাঝের পার্থক্যটাই তাদের লাভ।
এ কারবারে শরীক তিন প্রকার হয়ে থাকে। যেমন: ১. বিভিন্ন ব্যাংক। অধিকাংশই বড় লেনদেন ব্যাংক করে থাকে। কারেন্সির উত্থান ও পতনে ব্যাংকের কার্যক্রম সবচে’ বেশি হয়ে থাকে। ২. বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। যারা কারেন্সি বিজনেস করে লাভ করে থাকে। ৩. ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কারেন্সি এক্সচেঞ্জ করে থাকে।
ফরেক্স কমোডিটি ট্রেডিং। ইন্টারনেট বিজনেসের এ প্ল্যাটফর্মে যে শুধু কারেন্সি এক্সচেঞ্জ বিজনেস করা হয় বিষয়টি তা নয়। বরং নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক কিছুই ট্রেড করা হয়ে থাকে। যেমন তেল, কাপড়, লোহা, চাল, ডাল ইত্যাদি। এসব জিনিসও উক্ত প্ল্যাটফর্মে ক্রয় বিক্রয় করা হয়ে থাকে। তবে ক্রয় বিক্রয়ের মূলনীতি প্রায় কারেন্সি এক্সচেঞ্জের মতোই।
এখানে স্বল্প ক্যাপিটাল বা কম পূঁজি বিনিয়োগ করে ব্রোকারের মাধ্যমে লেভারেজ তথা এক প্রকার ঋণ নিয়ে অনেক দামের বস্তুও ক্রয় করা যায়। যেমন দশ হাজার টাকা ইনভেষ্ট করে সংশ্লিষ্ট ডিলার বা ব্রোকারের কাছ থেকে লেভারেজ তথা ব্রোকারের কাছ থেকে ঋণের ভিত্তিতে এক লাখ টাকার তেল বা গমও ক্রয় করতে পারেন।
ক্রয় বিক্রয়ের সময় শুধু দশ হাজার টাকাই পরিশোধ করা হয়। এসব কারবারে স্পট ট্রেড (Spot trade ) এবং ফিউচার ট্রেড (Future Trade) এসবই হয়ে থাকে। পণ্য ক্রয় করার পর যদি পণ্যটির মূল্য বাড়তে থাকে, তাহলে ট্রেডারের লাভ হয়। তখন অনেক সময় নির্ধারিত সময় আসার আগে ওই পণ্যটি সে আবার বিক্রি করে দেয়।
আর যদি ক্রয় করা পণ্যটির মূল্য কমতে থাকে, তাহলে ট্রেডারের লস হয়। যদি লস জমা করা অর্থকে অতিক্রম করে ফেলে তখন ব্রোকার/ডিলার ট্রেডারকে বলে আরও টাকা জমা করতে। নতুবা চুক্তিটি বাতিল হয়ে যাবে। যদি ট্রেডার অতিরিক্ত টাকা জমা না করে, তাহলে কারবারটি বাতিল করে দেয়া হয়।
তাহলে কী বুঝা গেল, স্ক্রীনে ট্রেডারের সাথে ক্রয় করার দ্বারা যে মালিকানা দেখানো হয়ে থাকে, এ পদ্ধতিটি এর সম্পূর্ণ খেলাফ। কারণ, সত্যিকার মালিকানা ট্রেডারের হলে, তার হস্তক্ষেপ ছাড়া কিভাবে সেটি বাতিল করা সম্ভব? সুতরাং বুঝা গেল যে, ট্রেডারের মালিকানা শুধুমাত্র তার জমা করা অর্থের ওপরই সীমাবদ্ধ থাকে। বাকি যে অর্থ দেখানো হয়ে থাকে, সেটি সুধুমাত্র একটি আইওয়াশ ছাড়া কিছু নয়। এই হলো, মোটামুটি ফরেক্স ট্রেডিংয়ের বাস্তব রূপ। এছাড়া আরও অনেক ধরন রয়েছে।
ফরেক্স ট্রেডিংয়ে শরিয়তের বিধান
ক্রয় বিক্রয় পূর্ণতা পাবার জন্য পণ্যটি হস্তগত হওয়া তথা কবজ হওয়া শর্ত। যা উপরোক্ত লেনদেনের মাঝে পাওয়া যায় না। উভয় পক্ষ বা এক পক্ষের কবজ তথা হস্তগত হওয়ার শর্তটি পূর্ণতা পায় না। মোটকথা, ফরেক্স ট্রেডিংয়ের মাঝে কারেন্সি এক্সচেঞ্জ লেনদেনে কবজ তথা হস্তগত করার শর্ত না পাওয়ার কারণে উক্ত লেনদেন নাজায়েজ ও হারাম হয়ে যায়।
عَنْ حَكِيمِ بْنِ حِزَامٍ، قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ الرَّجُلُ يَسْأَلُنِي الْبَيْعَ وَلَيْسَ عِنْدِي، أَفَأَبِيعُهُ؟ قَالَ: لَا تَبِعْ مَا لَيْسَ عِنْدَكَ হযরত হাকিম ইবনে হিজাম রহ. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললাম, ইয়া রসুলাল্লাহ! এক ব্যক্তি আমার নিকট থেকে এমন কিছু কিনতে চায়, যা আমার নিকট বিদ্যমান নাই। আমি কি তার সাথে বিক্রয় চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারি? তিনি বলেন তোমার নিকট যা বিদ্যমান নেই, তা তুমি বিক্রয় করো না। (সুনানে ইবনে মাজাহ ২১৮৭, সুনানে আবু দাউদ ৩৫০৩, সুনানে তিরমিজি ১২৩২)
عَنْ حَكِيمِ بْنِ حِزَامٍ قَالَ: نَهَانِي رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ أَبِيعَ مَا لَيْسَ عِنْدِي হযরত হাকিম ইবনে হিজাম রহ. হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমার হাতে নেই এমনসব বস্তু বিক্রয় করতে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে নিষেধ করেছেন। (সুনানে তিরমিজি ১২৩৩)
قَالَ حَكِيمُ بْنُ حِزَامٍ: ابْتَعْتُ طَعَامًا مِنْ طَعَامِ الصَّدَقَةِ، فَرَبِحْتُ فِيهِ قَبْلَ أَنْ أَقْبِضَهُ، فَأَتَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَذَكَرْتُ ذَلِكَ لَهُ، فَقَالَ: «لَا تَبِعْهُ حَتَّى تَقْبِضَهُ হযরত হাকিম ইবনে হিজাম রহ.থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি সাদকার খাদ্য ক্রয় করলাম এবং তা আপন অধিকারে আনার পূর্বেই তা দ্বারা মুনাফা করলাম। এরপর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁর নিকট সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেনঃ তুমি তা নিজের অধিকারে না এনে বিক্রি করবে না। (সুনানে নাসায়ি ৪৩০৩)
ফিক্বহে ইসলামীর গ্রহণীয় উসূল হলো, ফাসিদ শর্তের কারণে ক্রয়বিক্রয় ফাসিদ হয়ে যায়। ফরেক্স ট্রেডিং এর মাঝে ফাসিদ শর্তও লাগানো হয়ে থাকে। যেমন স্যোয়াপ (swaps) তথা ইকালা এর শর্তে বাই। মানে বাই বাতিল করার সুযোগের শর্তে ক্রয়বিক্রয় করা।
এর অর্থ হলো, একটি নির্ধারিত সময়ের পর ক্রয়বিক্রয়টি বাতিল হয়ে যায়। অথচ ক্রয়বিক্রয় শুদ্ধ হবার জন্য শর্ত হলো, ক্রয় বিক্রয় হবার দ্বারা উভয় পক্ষের এখতিয়ার শেষ হয়ে যায়। ইচ্ছে করলেই তা আর বাতিল করতে পারে না।
অথচ ফরেক্স ট্রেডিং এর মাঝে এ শর্ত পাওয়া যায় না। সুতরাং এ ক্রয়বিক্রয় শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে জায়েজ হয় না। হেদায়া কিতাবের তৃতীয় খণ্ডের ৫৯ পৃষ্ঠায় এ বিষয়ে আলোচনা উল্লেখ আছে।
এছাড়া Options এর মাঝে ট্রেডারকে এ হক দেয়া যে, সে অপর পক্ষের অনুমতি ও সন্তুষ্টি ছাড়াই ইকালা তথা ক্রয়বিক্রয় বাতিল করতে পারবে। এটা ক্রয়বিক্রয়ের মাঝে শর্তে ফাসিদ। কেননা ক্রয়বিক্রয়ের মাঝে ইক্বালা করতে হলে উভয় পক্ষের সন্তুষ্টি জরুরি। শরিয়তে এ শর্তও উক্ত লেনদেনে লঙ্ঘিত হয়। (হেদায়া ৩/১৪৭)
ফিউচার সেল ইসলামি শরিয়তে বৈধ নয়। এ প্রকার লেনদেনের মাঝে ‘বাই ক্বাবলাল কাবজ’ তথা হস্তগত করার আগেই ক্রয়বিক্রয় করার শামিল। কারণ, অধিকাংশ ট্রেডারই এ মার্কেটে ক্রয়বিক্রয় শুধুমাত্র কারেন্সি রেটের দর ও পতনের মাধ্যমে লাভ করার মানসেই করে থাকে। কারেন্সি অর্জন করা তাদের উদ্দেশ্য হয় না।
তাই কারেন্সি হস্তগত করা ছাড়াই আবার তা বিক্রি করে দেয়। যা জায়েজ নয়। কারেন্সি ছাড়া অন্য পণ্যের ক্রয়বিক্রয়গুলো যদিও ‘বাইয়ে ছরফ নয়। এ কারণে সেগুলোতে নগদে ক্রয়বিক্রয় শর্ত নয়।
কিন্তু সেসবের মাঝেও ‘বা’ই ক্বাবলাল কাবজ’ তথা হস্তগত হবার আগে ক্রয় বিক্রয় এবং ‘বা’ই মুজাফ ইলাল মুস্তাকবিল’ তথা ফিউচার সেল, অর্থাৎ ভবিষ্যতের দিকে সম্বোধিত ক্রয় বিক্রয়ের মত নাজায়েজ বিষয়গুলো শামিল। এছাড়া অন্যান্য ফাসিদ শর্তও তাতে বিদ্যমান।
এছাড়া এর মাঝে এ খারাবীও রয়েছে যে, ব্রোকার ক্রয়বিক্রয়ের সুযোগ দেবার মাধ্যমে লাভ হলে লভ্যাংশ নেয়। কিন্তু যখন লস হতে থাকে, তখন এ চুক্তিটিকে বাতিল করার ক্ষমতাও রাখে।
অথচ শরীয়তে ব্রোকার তার কাজের পারিশ্রমিক নেবার পর লেনদেনের মাঝে তার কোন এখতিয়ার থাকে না। সুতরাং তারা কোন কিছু ক্রয় বিক্রয় করে লাভ বা লোকসান করলে এটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির হবে। এর সাথে ব্রোকারের কোন সম্পর্ক নেই। লোকসান দেখে ব্রোকারের জন্য উক্ত লেনদেন বাতিল করে দেবার কোন ক্ষমতা থাকে না। যতক্ষণ না উভয় পক্ষ তাতে রাজি না হয়।
অথচ ফরেক্স ট্রেডিং এর মাঝের ব্রোকার সেই ক্ষমতা রাখে। সুতরাং বুঝা গেল যে, ইসলামি শরীয়তের দৃষ্টিতে প্রচলিত ফরেক্স ট্রেডিং এ বিজনেস করা, ইনভেষ্ট করা, লেনদেন করা শরিয়ত সম্মত নয়। অনেকে মনে করেন সুদ গ্রহণ না করে ফরেক্স ট্রেড জায়েজ।
কিন্তু ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে এখানে যে চুক্তিগুলো হচ্ছে, লেনদেনগুলো হচ্ছে সে পদ্ধতিগুলো না জায়েজ পদ্ধতি। তাই যারা এ ধরণের ব্যবসায় জড়িত, যত দ্রুত সম্ভব এ ব্যবসা থেকে বিরত থেকে আল্লাহর কাছে হালার রুজির জন্য দোয়া করা প্রয়োজন। আল্লাহ উত্তম রিজিকদাতা। তার কাছেই হালাল উপার্জনের জন্য দোয়া করা উচিত।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।