সেলিম খান : ভারতে দীর্ঘ সময় ধরে চলা নির্বাচনের ফল কী হতে চলেছে, তার জন্য আর মাত্র সাত দিন অপেক্ষা করলেই হবে। আগামী মঙ্গলবার এতক্ষণে পরিষ্কার হয়ে যাবে, নরেন্দ্র মোদি তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন, না বিদায় নিচ্ছেন। ভারতের লোকসভা নির্বাচনের এই দীর্ঘ ৮০ দিনের পরিক্রমা যেমন মজার, তেমনি ঘটনার ঘনঘটায় ভরা। শুরুতে মনে হয়েছিল, মোদি ও তাঁর দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) কাছে কেউ পাত্তাই পাবে না। তাদের বিরোধী পক্ষ এতটাই ছন্নছাড়া দশায় ছিল যে, সবাই এটা মেনেই নিয়েছিল—মোদির বিকল্প আসলে মোদি নিজেই। নিজে না হারলে তাঁকে কেউ হারাতে পারবে না। বরং ৫৪৩ আসনের লোকসভায় বিজেপি ও শরিকেরা চার শ পেরিয়ে কোথায় দাঁড়াবে—এটাই ছিল কৌতুহলের বিষয়।
কিন্তু ১৯ এপ্রিল প্রথম পর্বের ভোট না হতেই পুরো বিষয়টা কেমন ঘুরে গেল। বিশেষ করে এর আগে কংগ্রেসের ইশতেহার প্রকাশের পর। গোটা নির্বাচনী প্রচারের কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছে গেল জিনিসপত্রের দাম, কর্মসংস্থান, অগ্নিবীর প্রকল্প, সংবিধান রক্ষাসহ নানা বিষয়। প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজের কথা বলার বদলে বিরোধীদের প্রচারের ফাঁসে জড়িয়ে গেলেন। গেলেন শুধু না, ‘ম’ অক্ষরটির প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও ভরসা বাড়তে থাকল। যে কারণে মুসলমান, মঙ্গলসূত্র, মহিষ, মুজরা, মন্দির–এসব শব্দ প্রচণ্ড বিদ্বেষপূর্ণ ভাষায় অতিরিক্ত মাত্রায় স্থান পেল তাঁর ভাষণে। ততদিনে রাহুল-অখিলেশ-তেজস্বী-কেজরিওয়াল-স্ট্যালিনরা অনেক বেশি একজোট হতে পেরেছেন। এই জোটের চক্করে এসে হাওয়া ঘুরতে শুরু করেছে বলে অনেকেই ভাবছিলেন। বিশেষ করে বিজেপির ভোট ব্যাংক বলে পরিচিত হিন্দু সমাজের নানা অংশের বিরক্তি, রাগ, ক্ষোভ এতে বাতাস দিয়েছিল। রাহুল তো বলেই দিয়েছেন, ৪ জুনের পর মোদি আর প্রধানমন্ত্রী থাকবেন না। এটা নির্বাচনী মাঠের ফাঁকা বুলি, না আসলেই তাঁরা করে দেখাতে পেরেছেন, সেটা প্রমাণ হয়ে যাবে কয়েক দিনের মধ্যে।
চতুর্থ ধাপের ভোটের পর আবার ছবিটা পাল্টাতে থাকে। এই ছবি পাল্টানোর জন্য শুরু হয় নানা প্রক্রিয়া। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর পছন্দের পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলোতে সাক্ষাৎকার দিতে থাকেন। যে নরেন্দ্র মোদি গত ১০ বছরে কোনো সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হননি (শুধু হোয়াইট হাউসে বাদে) তিন প্রায় ৭০টির বেশি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ভারতের সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলগুলোতে। সেগুলো ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। সব সাক্ষাৎকারই সাজানো। সেখানে সাংবাদিকতা বাদে আর সবকিছুই আছে—এ অভিযোগ সাংবাদিক রাবিশ কুমারের। ভারতের ভোট-বিপণন বাজারের গুরু প্রশান্ত কিশোরসহ আরও অনেকে মাঠে নেমেছেন এটা প্রমাণ করার জন্য যে, ভারতে এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, যাতে মোদির বিজেপি তিন শর কম আসন পাবে। বরং ২০১৯-কেও ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভবনা নিয়ে বেজায় আশাবাদী তাঁরা। করণ, থাপার বা শ্রীনিবাসন জৈনের মতো সাংবাদিকদের কাছে আড়ং ধোলাই হওয়ার পরও প্রশান্ত সমানে ব্যাটিং করে যাচ্ছেন মোদির পক্ষে। ঘরে বসে প্রশান্ত কিশোরের লোকেদের মতামত মোদির জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে মাত্র।
কিন্তু এই আশার পেছনে হেতু কী? নরেন্দ্র মোদি সাক্ষাৎ ঈশ্বরের অবতার, এটাই? মোদি নিজেই এক টিভি চ্যানেলের সাথে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তাঁর জৈবিক জন্ম হয়নি। অর্থাৎ পিতৃ ঔরসে মাতৃ গর্ভে তাঁর জন্ম হয়নি। সরাসরি ঈশ্বর তাঁকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, বিশেষ কিছু কাজের জন্য। এই বিশ্বাস তাঁর অনেক দিনের। তবে মায়ের মৃত্যুর পর থেকে এই বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছে বলে মোদি জানিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, এই যে কাজ তিনি করেন, আসলে করেন না, কেউ তাঁকে দিয়ে করিয়ে নেয়। অভিনেত্রী ও বিজেপি নেত্রী কঙ্গণা রৌণাতসহ মোদি-মোহিত সমাজের একটা বড় অংশ বিশ্বাস করে প্রধানমন্ত্রী মোদি আসলেই অবতার। কেউ মনে করেন রামের অবতার, তো কেউ বলেন বিষ্ণুর। ওডিশার বিজেপি নেতা সম্বিত পাত্র তো বলেই বসলেন, পুরির প্রভু জগন্নাথও মোদির ভক্ত। যাক বাবা, তবুও বাঁচোয়া যে, চ্যালা বলে বসেননি। এমনি বিতর্ক সামলাতে সম্বিতের ঘাম ছুটে গেছে, আর এটা বললে না জানি কী হতো!
কিন্তু ভক্তিরসের এই প্রবল স্রোত কীভাবে যেন ধীরে ধীরে মোদির ভেতরেও সংক্রমিত হতে শুরু করেছে। যে কারণে ক্রমেই নিজেকে অবতার হিসেবে ভাবতে ভালোবাসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। এ নিয়ে হাসিঠাট্টা কম হয়নি। তবে মোদি এক কথার মানুষ। বলেই দিয়েছেন, কোনো হাসিঠাট্টাই তাঁকে তাঁর বিশ্বাস থেকে নড়াতে পারবে না। পরমাত্মা যাকে এই বিশেষ কাজ দিয়ে পাঠিয়েছেন, তিনি সেই দায়িত্ব না পালন করে সাধারণ মানুষের কথায় নড়বেন কেন? তবে গোল বেধেছে অন্য জায়গায়। পরমাত্মা তাঁকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে পাঠানোর কথা বললেও দায়িত্বটা আসলে কী, সেটাই খোলসা করেননি প্রধানমন্ত্রী মোদি। এর সুযোগ নিচ্ছে তাঁর বিরোধীরা। কেউ কেউ বলছেন, আদানির হাতে দেশের সবকিছু তুলে দেওয়ার জন্যই কি তাঁকে পাঠানো হয়েছে? নাকি জ্বালানি তেলের দাম সেঞ্চুরি পার করার জন্য? না মুসলমানদের দেশের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করতে? বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী ভোটের আগে পরিষ্কার করলে নিন্দুকেরা এসব প্রশ্ন তুলতে পারত না।
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর লালকেল্লা থেকে দেওয়া ভাষণে নরেন্দ্র মোদি নিজেকে জনগণের প্রধান সেবক হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। ২০১৯-এ হয়েছিলেন দেশের চৌকিদার। এ দুটো বিষয় বেশ ভালো খেয়েছিল ভারতের মানুষ। এরপর ২০২৪-এ এল ঈশ্বরের অবতার। এটা প্রকৃতই মোদির বিশ্বাস না আরেকটি রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি তা নিয়ে সাংবাদিক সিদ্ধার্থ ভাটিয়া প্রশ্ন তুলেছেন। আসলে ২০০১ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া বা ২০১৪ সালে সারা ভারতের নির্বাচিত শাসক হওয়া নরেন্দ্র মোদি কখনো সরাসরি নির্বাচনে পরাজয়ের স্বাদ পাননি। সব সময় সাফল্য তাঁর হাতে ধরা দেওয়ায় ২৩ বছরে তিনি ভুলেই গেছেন হারলে কেমন লাগে। এই ভুলে যাওয়া অভিজ্ঞতা যাতে ফিরে না আসে, সেজন্য অবতার কেন ঈশ্বর হতেও বাধবে না। কারণ সাধারণ মানুষ আছে এক অদ্ভুত মোহে। যেখানে আবেগ আর অন্ধবিশ্বাস যুক্তির সব ঘরগুলোকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। কোনো নেতিবাচক ঘটনা সে আমলে নিতে প্রস্তুত না। এই যদি হয় প্রাপ্তবয়স্ক ভোটারদের অবস্থা, তাহলে সে দেশের দুর্গতি ঠেকানোর সাধ্য কোনো পরমাত্মারই নেই।
মোদি বিহারের এক জনসভায় বলেছেন, ৪ জুন ফল বেরোনোর পরই বিরোধী দলগুলো ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনকে (ইভিএম) দুষতে থাকবে তিনি নিশ্চিত। তাঁর এই নিশ্চয়তার কারণগুলো ইতিমধ্যে ভারতের নির্বাচন কমিশন তৈরি করে ফেলেছে। মোদির অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণও দাবি করছেন, ফল বেরোনোর পর বিরোধীরা ইভিএমের দোষ খুঁজতে বের হবে। বিরোধীদের এভাবে কটাক্ষ না করে নির্মলা তাঁর স্বামী বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. পরাকলা প্রভাকরকে প্রশ্নটা করতে পারতেন। এর উত্তর পরাকলা স্যার ভালোই জানেন। আর ঘরের লোকের কথা বিশ্বাস করার মতো আত্মবিশ্বাস ভারতের প্রথম নারী অর্থমন্ত্রীর আছে বলেই মনে হয়।
যদিও ভোট পড়ার হার কয়েক দিনের ব্যবধানে বেড়ে যাওয়া এ পর্যন্ত ভারতের নির্বাচনে বড় চমকের সাথে সাথে অতি বড় অবিশ্বাস্য ঘটনা। প্রথম চার পর্বে ভোটের দিনের হিসাবের তুলনায় ভোট বেড়েছে ছিল ১ কোটি ৭ লাখ, অর্থাৎ প্রতিটি আসনে গড়ে বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার। এই ভোট কি সত্যিই আগে পড়েছে? আগে না পরে, প্রশ্ন সেটাই? পরে পড়লে কাদের ঘরে পড়েছে? বুথ ধরে ধরে ভোটের হিসাব কেন এবার ওয়েবসাইটে দিল না নির্বাচন কমিশন? কী লুকাতে চায় তারা? ২০১৯-এ ৪০টির মতো আসনে এই ধরনের সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচ হয়েছিল। ধরা পড়েনি। সব্যসাচী দাস নামে একজন অধ্যাপক হিসাব কষে এই গরমিল ধরিয়ে দেন। তৃণমূল কংগ্রেসের এমপি মহুয়া মৈত্র এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। পাঁচ বছরে তা ফয়সালা হওয়ার আগে আবার আরেকটা ভোট এসে পড়েছে। কী আর করার। অতএব ইভিএমকে শাসকেরা ভরসা করতেই পারেন।
সেজন্যই কি অবতার মোদি ও তাঁর দলের বড় ভরসা হয়ে উঠেছে ইভিএম। না হলে পরিস্থিতি যা, তাতে এতটা আত্মবিশ্বাসী তো লাগার কথা না।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, ডিজিটাল মিডিয়া, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।