জুমবাংলা ডেস্ক : ভ্যাপসা গরমে অস্বস্তিতে আছেন? তাহলে মোটামুটি নিশ্চিত থাকতে পারেন- এমন পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হবে না। কারণ দ্রুতই ঝড়-বৃষ্টি আসছে, সঙ্গে পড়তে পারে শিলা! আবহাওয়ার সাম্প্রতিক প্রবণতায় এমন পূর্বাভাসই মিলছে।
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জায়গায় হঠাৎ হঠাৎ ঝড় এবং শিলাবৃষ্টি হচ্ছে। এই প্রবণতা আরও বেশ কয়েক সপ্তাহ অব্যাহত থাকতে পারে। আবহাওয়াবিদরা জানাচ্ছেন, আগামী দুই মাস দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার ভেতর দিয়ে যাবে দেশ। এতে ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হবে সবচেয়ে বেশি।
শিলা বৃষ্টি কী, কেন হয়?
আবহাওয়াবিদরা জানান, বাংলাদেশে সাধারণত চৈত্র মাসের শেষ ও বৈশাখ মাসের শুরুতে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বঙ্গোপসাগর থেকে আসা বাতাসে এক ধরনের ঊর্ধ্বমুখী চাপ সৃষ্টি হয়। এর প্রভাবে কালবৈশাখী ঝড় হয়। এই কালবৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে শিলা থাকে।
শিলাবৃষ্টির প্রধান শর্ত প্রচণ্ড গরম। বাংলাদেশে চৈত্র-বৈশাখ মাসে গরম পড়ে। ফলে মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে কালবৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে শিলাবৃষ্টি হয়। যখন বৃষ্টির ফোঁটা বজ্রঝড়ের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলের উপরের দিকে অত্যন্ত ঠাণ্ডা জায়গায় পৌঁছায়, তখন তা জমাট বেঁধে শিলা তৈরি হয়।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের উপপরিচালক ড. মোহাম্মদ সাদেকুল আলম বলেন, একটা কালবৈশাখী ঝড় যখন হয় তখন উপরের দিকে ওঠার সময় বাতাসের তাপমাত্রা আস্তে আস্তে কমতে থাকে। যে জায়গায় বাতাসের তাপমাত্রা শূন্য হয়ে যায়, ওটাকে আমরা ফ্রিজিং লেভেল বলি। শূন্য তাপমাত্রার উচ্চতা যদি আমাদের দেশে ১৪ হাজার ফুটের নিচে হয় এবং ওইদিন যদি ঝড় হয় তাহলে শিলাপাতের সম্ভাবনা খুবই বেশি থাকে। বজ্রঝড়ের মধ্যেই উপরের দিকে শিলা থাকে। কিন্তু ১৪ হাজার ফুটের উপর থেকে পড়া শুরু করলে সেটা গলতে গলতে ছোট হয়ে আসে এবং এক পর্যায়ে আর শিলা থাকে না, পানি হয়ে যায়।
শিলার আকার ছোট-বড় হওয়া কিসের ওপর নির্ভর করে?
গত রোববার (৩১ মার্চ) সিলেটে কালবৈশাখী ঝড়ের সাথে যে আকারের শিলাবৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে আলোচনা চলছে। স্থানীয়রা বলছেন, এত বড় আকারের শিলা পড়তে তারা খুব কমই দেখেছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এই শিলাবৃষ্টিতে সেখানে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অনেক টিনের চাল ভেদ করে শিলা ভেতরে ঢুকে গেছে। এতে চাল নষ্ট হয়েছে। ঘরের বাইরে থাকা বিভিন্ন জিনিসপত্র ভেঙে গেছে। অনেকের বাসাবাড়ির জানালার কাচ, গাড়ির কাচ ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফল-ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি অনেক পাখিও মারা গেছে।
স্থানীয়রা বলছেন, হঠাৎ কালবৈশাখী শুরু হওয়ায় তারা ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর মতো প্রস্তুতি নেয়ার সময়ও পাননি।
ক্ষয়ক্ষতি বেশি হওয়ার কারণ শিলার আকার। সিলেট নগরবাসী জানান, বড় বড় শিলা দেখে হতবাক হয়েছেন তারা। এক দোকানি বিশাল আকৃতির এক শিলা কুড়িয়ে সেটির ওজন মেপে দেখেন ২০৩ গ্রাম। এছাড়া নগরীতে ১০০ গ্রাম ওজনের শিলা পড়েছে বেশি।
যদিও শিলার আকার কত বড় তা নির্ধারণে ওজন নয়, বরং ডায়ামিটার ব্যবহার করা হয়। আবহাওয়াবিদদের মতে, বাংলাদেশে মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত হাফ ইঞ্চি ডায়ামিটারের শিলার আকার স্বাভাবিক।
ড. মোহাম্মদ সাদেকুল আলম বলেন, ‘শিলা কত বড়, আমরা সেটা নির্ধারণ করি ডায়ামিটার দিয়ে। বুঝার চেষ্টা করি, সেটার সাইজ কত বড় ছিল। বাংলাদেশে এক ইঞ্চি ডায়ামিটারের চেয়ে বড় শিলা খুব কমই দেখা যায়।’
তিনি আরও বলেন, গরম এলাকা হওয়ায় এখানে শিলার সাইজ ছোট হয়। পড়তে পড়তেই গলা শুরু করে, বেশি বড় থাকে না।
সিলেটে কেন এত বড় শিলা পড়ল?
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এনভাইরনমেন্ট সাইন্সের অধ্যাপক মো. রিদওয়ানুর রহমান বলেন, ‘সিলেট হিমালয় পর্বতমালা এবং ভারতের মেঘালয়ের খুব কাছাকাছি। মেঘালয়ের উঁচু পাহাড়ে সার্বক্ষণিকভাবে ঝড়-বৃষ্টি এবং শিলা পড়ে। কিন্তু এবার দেখা গেছে সেটা মেঘালয় রাজ্য থেকে নিচের দিকে সিলেটে হয়েছে। এটার কারণ, সিলেটে যে সময়ে শিলাবৃষ্টি হয়েছে মেঘালয়ে ওই সময় ঝড়ো বাতাস ছিলো। ফলে যে মেঘটি ভেসে ওখানে যাওয়ার কথা ছিল সেটা যেতে পারেনি, সিলেটেই নেমে গেছে এবং শিলাগুলোও পড়ে গেছে।’
সিলেটে ২০০ গ্রাম ওজনের শিলার বিষয়ে অধ্যাপক রিদওয়ান জানান, ‘শিলা আরও বড় হতে পারে। দুই-আড়াই কেজি ওজনের শিলা পড়ার রেকর্ডও আছে। যে মেঘগুলো মেঘালয়ের উঁচু পাহাড়গুলোতে ধাক্কা খায় সেগুলো ওখানে যেতে পারলে হয়তো শিলাগুলো আরও ছোট হয়ে যেত, অথবা ওখানকার পাহাড়ে ধাক্কা লেগে ঘুরে আমাদের এখানে প্রবেশ করলেও ছোট হয়ে মার্বেল আকৃতির হয়ে যেত।’
‘সাধারণত মেঘালয়ের বড় বড় পাহাড়গুলোতে অনেক বড় আকৃতির শিলা পড়ে। সেখানে অনেক বেশি শিলাবৃষ্টি হলে নিচের দিকে অবস্থিত সুনামগঞ্জের হাওড়গুলো তলিয়ে যায়,’ বলেন অধ্যাপক রিদওয়ান।
এ বছরের আবহাওয়ার প্রবণতা কী অশনি সংকেত দিচ্ছে?
শিলাবৃষ্টি বছরের এই সময়টাতেই বেশি হয়; কিন্তু এবার অনেক সময় পূর্বাভাস ছাড়াই হয়েছে। সিলেটেও পূর্বাভাস ছিলো না।
অধ্যাপক রিদওয়ান জানান, শিলাবৃষ্টি বিরূপ আবহাওয়ার কারণেই হয়ে থাকে। বঙ্গোপসাগর থেকে যখন মেঘ ভেসে বহু উপর দিয়ে যায়, যে মেঘটা দৃশ্যমান নয় এবং আবহাওয়ার সংবাদের ভেতরে প্রচার করা হয় না, এতটা উপর দিয়ে শিলাগুলো পাথরের মতো জমে ভেসে যায়। কিন্তু যদি হঠাৎ করে রাতের আবহাওয়াটা ঠাণ্ডা হয়ে যায় আকস্মিকভাবে সেটা দ্রুত নেমে আসে। এই অল্প সময়ের মধ্যে ব্রডকাস্ট করা সম্ভব হয় না। সিলেটেও এরকম হয়ে গেছে। স্যাটেলাইটে যেভাবে আসে এবং সেটা ব্রডকাস্ট করতে যে সময়টুকু লাগে সেটা পাওয়া যায়নি।
এবছর আবহাওয়া স্বস্তিদায়ক হবে না বলে মনে করেন অধ্যাপক রিদওয়ান। তিনি বলেন, ‘এবার দেখা যাচ্ছে কোনোদিন প্রচণ্ড গরম পড়ছে। কিন্তু আগের দিন এমনকি রাতেও বুঝা যাচ্ছে না যে, পরদিন এত গরম পড়তে পারে।’
এবারের আবহাওয়া ফসলের জন্যও প্রচণ্ড ক্ষতি বয়ে আনতে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানান তিনি। বিশেষ করে মৌসুমি ফল, যেমন আম মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তিনি বলেন, ‘রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষিরা খুবই হতাশ হয়ে গেছেন। গাছে ফুল অনেক কম। যতটুকু আছে তাও জ্বলে যাচ্ছে।’
এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া আরও প্রায় দুই মাস অব্যাহত থাকতে পারে বলে ধারনা তার। টানা দুই-তিনদিন প্রচণ্ড ভারি বৃষ্টিপাত হয়ে গেলে অথবা ছোট একটা নিম্নচাপ হয়ে গেলে আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাবে এবং আবহাওয়ার পরিবর্তন আসবে বলে জানান তিনি।
‘কিন্তু আপাতত সেরকম কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কোনো পূর্বাভাসই এরকম নেই। সাগরেও কোনো নিম্নচাপ এই মুহূর্তে নাই।’
তিনি আরও বলেন, আবহাওয়া নিয়ে যারা খোঁজখবর রাখেন বা চিন্তাভাবনা করেন, তারা এবারের আবহাওয়ার হিসাবটা মেলাতে পারছেন না। পূর্বের সূত্রগুলো আমাদের এলোমেলো করে দিচ্ছে। পূর্বাভাসগুলো ভালো কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছে না।
কৃষকদের জন্য খারাপ খবর
মুহূর্তে মুহূর্তে আবহাওয়ার এমন রূপ বদল- প্রচণ্ড গরম, বজ্রঝড় এবং শিলাবৃষ্টিতে যেসব ফসল মাঠে আছে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলচাষিরা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সামনে আরও ক্ষতির আশঙ্কা আছে।
এই মুহূর্তে চাষিদের প্রস্তুতি নিয়ে রাখার পরামর্শ দেন অধ্যাপক রিদওয়ান। তিনি বলেন, ‘একটি ফসলের সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি ফসলের প্রস্তুতি থাকতে হবে। এই বিষয়ে কৃষি অফিসগুলোও প্রস্তুতি নিয়ে রাখলে ভালো। যেমন- একটা ফসল চলে গেলে কৃষক সেটার ক্ষতি পোষাতে দ্রুততার সঙ্গে আরেকটি কী ফলস চাষ করতে পারেন, সেই হিসেবে কৃষকদের কিছু বীজ সরবরাহ করা যেতে পারে। এতে কৃষক হয়তো কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন।’
আবহাওয়ার সাম্প্রতিক পূর্বাভাস
মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার জন্য আবহাওয়া অফিসের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, পরবর্তী তিনদিন দেশের পাঁচ বিভাগে তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে বলে আশঙ্কা আবহাওয়া অফিসের। এতে এসব অঞ্চলের বাসিন্দাদের অস্বস্তি বাড়তে পারে। এ সময় দেশের কোথাও কোথাও শিলাবৃষ্টির আশঙ্কাও করা হচ্ছে।
আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। এ অবস্থায় মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ী দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।
এর পাশাপাশি কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে হতে পারে শিলাবৃষ্টিও। এর পরের ৪৮ ঘণ্টা সিলেট বিভাগের দু-এক জায়গায় এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যান্য জায়গায় আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে।
এদিকে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, রংপুর বিভাগের নীলফামারী ও দিনাজপুর জেলা এবং রাজশাহী, ঢাকা, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এটি বিস্তার লাভ করতে পারে। জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে বাড়তে পারে অস্বস্তি। এ পরিস্থিতি আগামী শুক্রবার (৫ এপ্রিল) সকাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।