ড. আবদুল আলীম তালুকদার : হিংসা একটি ধ্বংসাত্মক কু-অভ্যাস। মানুষকে কলুষিত করার জন্য এই একটি বদঅভ্যাসই যথেষ্ট। তাইতো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে আমরা কত বিচিত্র স্বভাবের মানুষই না দেখতে পাই। আমাদের মধ্যে এমন অনেক লোকও আছেন যারা অন্যের ভালো একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। অন্যের ভালো কিছু দেখলে হিংসায় জ্বলে-পুড়ে একাকার হয়ে যান। মানবজাতির এই হিংসা প্রবণতা এক প্রকার ব্যাধি; যা ইসলামের দৃষ্টিতে মারাত্মক পাপের কাজ, অবশ্যই বর্জনীয় এবং সম্পূর্ণরূপে হারাম। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে সুরা ফালাকের ৫নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর (আমি আশ্রয় চাই) হিংসুকের অনিষ্ট থেকে, যখন সে হিংসা করে।’ এ মর্মে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সন্দেহ নেই, হিংসা নেক আমলগুলোর নুর ও আলোকে নিভিয়ে দেয়’- (সুনানে আবু দাউদ : ৪৯০৬)। এ ছাড়াও হজরত আনাস বিন মালিক (রা.) হতে বর্ণিত নবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা পরস্পরে বিদ্বেষ করো না, হিংসা করো না, ষড়যন্ত্র করো না ও সম্পর্ক ছিন্ন করো না। বরং তোমরা আল্লাহর বান্দা হয়ে যাও, পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও’- (বুখারি : ৬০৭৬, মুসলিম: ২৫৫৯, জামে তিরমিজি: ১৯৩৫)।
মানুষের অন্যতম খারাপ অভ্যাস হলো অন্যের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করা। ইসলামে হিংসা বা বিদ্বেষ পোষণকারীকে খুবই নিকৃষ্ট চোখে দেখা হয়েছে। তাইতো হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা হিংসা-বিদ্বেষ করা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা হিংসা নেক আমলকে সেভাবে খেয়ে ফেলে যেভাবে আগুন কাঠকে জ্বালিয়ে নিঃশেষ করে দেয়’- (সুনানে আবু দাউদ : ৪৯০৫)। হজরত যামরাহ্ বিন ছালাবাহ (রা.) বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত কল্যাণের মধ্যে থাকবে, যতক্ষণ তারা পরস্পরে হিংসা না করবে’- (তাবারানি: ৮১৫৭, ছহিহাহ: ৩৩৮৬)।
মানুষ হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকুক এবং মানব সমাজে সামাজিক শান্তি-সম্প্রীতি বজায় থাকুক এটাও আল্লাহ তায়ালার একান্ত অভিপ্রায়। তাইতো তিনি কোরআনের সুরা আন-নিসার ৫৪নং আয়াতে ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে যা দিয়েছেন, সে জন্য কি তারা তাদের ঈর্ষা করে?’ একজন প্রকৃত ইমানদার ব্যক্তি কখনো হিংসার বশবর্তী হতে পারেন না। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘মোমিন বান্দার পেটে আল্লাহর রাস্তার ধুলা এবং জাহান্নামের আগুন একত্রে জমা হতে পারে না। একইভাবে হিংসা এবং ঈমানও কোনো বান্দার মাঝে একত্রে থাকতে পারে না’- (নাসাই)। এ ছাড়াও হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে আরো একটি হাদিসে বর্ণিত রাসুল (স.) বলেছেন, ‘কোনো বান্দার হৃদয়ে ঈমান ও হিংসা একত্রে থাকতে পারে না’- (সুনানে নাসাই: ৩১০৯)।
মানুষের বদভ্যাস সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, তিনটি বদভ্যাস আছে, যা থেকে কেউ মুক্ত নয়। ১. কু-ধারণা ২. হিংসা ৩. অশুভ ফলাফলে বিশ্বাস। সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, এসব থেকে মুক্ত থাকার উপায় কী? তিনি বললেন, ‘কারো প্রতি কু-ধারণা এলে তা বিশ্বাস না করা, হিংসার উদ্রেক হলে প্রকাশ না করা আর কাজ থেকে ফিরে না আসা’- (মাজমাউজ জাওয়াইদ)।
হিংসা এমন একটি খারাপ অভ্যাস যা মানুষের নৈতিক চরিত্র তো ধ্বংস করেই তার সঙ্গে ধর্মীয় অনুভূতিগুলোকেও ধ্বংস করে দেয়। তাইতো নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থাক। কারণ হিংসা দীন ধ্বংস করে দেয়’- (তিরমিজি)। এ ছাড়াও হজরত জুবায়ের ইবনুল আওয়াম (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে পিপীলিকার মতো প্রবেশ করবে বিগত উম্মতদের রোগ। আর তা হলো হিংসা ও বিদ্বেষ; যা হলো মু-নকারী। আমি বলি না যে চুল মু-ন করবে, বরং তা দীনকে মু-ন করে ফেলবে’- (তিরমিজি: ৫০৩৯)।
হিংসুকরা আল্লাহর নিয়ামতের শত্রু, গোটা মোমিনের শত্রু। তাইতো রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর নিয়ামতের শত্রু আছে।’ সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহর নিয়ামতের শত্রু কারা? রাসুল (সা.) বললেন, ‘হিংসুকরা। হিংসুক তো এজন্যই হিংসা করে- আল্লাহ কেন তার বান্দাকে অনুগ্রহ করেছেন’- (দাওয়াউল হাসাদ)। এ ছাড়াও ইমাম বাকির (রহ.) বলেন, ‘হিংসা ইমানকে জ্বালিয়ে নিঃশেষ করে দেয়’- (আল কাফি, খ- ২, পৃষ্ঠা-৩০৬, হাদিস নং-১)। হিংসার পরিণাম সম্পর্কে ইমাম জাফর সাদিক (রহ.) বলেন, ‘একে অপরের সঙ্গে হিংসা করা থেকে বিরত থাকো, কেননা হিংসা হলো কুফরের ভিত্তিস্বরূপ’- (আল কাফি, খ- ৮, পৃষ্ঠা-৮, হাদিস নং-১)। হিংসুক বান্দাহদের আল্লাহতায়ালা ক্ষমা করবেন না আর ইহকাল ও পরকালে তাদের পরিণতি ভয়াবহ। তাইতো নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘অর্ধ শাবানের রাতে (অর্থাৎ শবেবরাতে) আল্লাহতায়ালা তার সব সৃষ্টিকেই ক্ষমা করে দেন। তবে তিনি মুশরিক ও হিংসা-বিদ্বেষপোষণকারীকে ক্ষমা করেন না’- (সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৩৯০)।
পরিশেষে বলা যায় যে, হিংসা মানুষের একটি আত্মিক রোগ। যা মরণ-ব্যাধির চেয়েও ভয়ংকর। এই হিংসাই মানব আত্মাকে দূষিত ও কলুষিত করে এবং সব নেক আমলকে নষ্ট করে দেয়। অতএব সব মানব সন্তানেরই হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকা অবশ্য কর্তব্য।
লেখক : সহ-অধ্যাপক
শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ, শেরপুর
সূত্র : প্রতিদিনের বাংলাদেশ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।