কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের প্রান্তে দাঁড়িয়ে মায়মুনা আক্তার। তার সংগঠন ‘নারী জাগরণী ফোরাম’ এর নেতৃত্বে স্থানীয় মৎস্যজীবী মহিলারা গড়ে তুলেছেন একটি সমবায় সমিতি। পর্দা মাথায়, কিন্তু স্বপ্ন চোখে। ইসলামের নির্দেশনা আর স্থানীয় প্রেক্ষাপট মিলিয়ে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে নেতৃত্বের পথ হাঁটতে হয়। তার মতোই হাজারো বাংলাদেশি নারী আজ প্রশ্ন করছেন: ইসলামে নারী নেতৃত্বের সুযোগ কোথায়? কতটুকু? কী শর্তে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আমাদের এ যাত্রা। শুধু তত্ত্ব নয়, বাস্তব জীবনের উজ্জ্বল উদাহরণ আর ইসলামের প্রামাণিক দলিলের আলোকে তৈরি এই পথনির্দেশ।
ইসলামে নারী নেতৃত্বের ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় ভিত্তি (Historical and Religious Foundations)
নারী নেতৃত্ব” কথাটি শুনলেই অনেকে ভাবেন, এটি আধুনিকতার ফল। কিন্তু ইসলামের ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর সময় থেকেই নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করে গেছেন, তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েছেন স্বয়ং রাসূল (সা.)।
- খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ (রা.): ইসলামের প্রথম স্ত্রী খাদিজা (রা.) ছিলেন মক্কার শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী। শুধু তাই নয়, নবুয়ত প্রাপ্তির পর হতাশ নবীজি (সা.) কে সর্বপ্রথম সান্ত্বনা, বিশ্বাস ও আর্থিক সমর্থন যিনি দিয়েছিলেন, তিনি এই মহীয়সী নারী। তার বুদ্ধিমত্তা, ব্যবসায়িক দূরদর্শিতা এবং নেতৃত্বগুণ ছিল প্রাতঃস্মরণীয়। ইসলামে নারী নেতৃত্বের সুযোগ এর সর্বপ্রথম ও উজ্জ্বলতম উদাহরণ তিনি। তার মর্যাদা সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, “আল্লাহ তাআলা তার চেয়ে উত্তম স্ত্রী আমাকে দেননি… যখন সবাই আমাকে অস্বীকার করল, তখন সে আমার প্রতি ঈমান আনল।” (সহীহ মুসলিম)।
- আয়েশা বিনতে আবু বকর (রা.): উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) কেবল নবীজির স্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট আলিমা, মুহাদ্দিসা এবং ফকিহা। তার নিকট থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন অসংখ্য সাহাবি। জাহেলী যুগের অন্ধকার ভেঙে জ্ঞানের আলো ছড়ানোর ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অতুলনীয়। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রেও উপস্থিত ছিলেন এবং পরামর্শ দিয়েছেন। তার জ্ঞান ও বিচক্ষণতা ছিল প্রসিদ্ধ।
- উম্মে ওয়ারাকা (রা.): মদিনায় নবীজি (সা.) নিজেই তাকে তার এলাকার মহিলাদের জন্য ইমামতি করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। (সুনান আবু দাউদ, হাদিস নং ৫৯৩)। এটি প্রমাণ করে ধর্মীয় নির্দেশনামূলক ভূমিকাতেও নারীর নেতৃত্ব ইসলামের প্রাথমিক যুগে বিদ্যমান ছিল, বিশেষত নারীদের ক্ষেত্রে।
- শিফা বিনতে আবদুল্লাহ (রা.): তিনি ছিলেন লেখাপড়ায় দক্ষ এবং নবীজি (সা.) তাকে হাফসা বিনতে উমর (রা.) কে লিখতে শেখানোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। (সহীহ বুখারী, কিতাবুল ইলম)। শিক্ষাদান ও জ্ঞান বিতরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বেও নারীরা ছিলেন সমাদৃত।
ইসলামিক স্কলারশিপের দৃষ্টিভঙ্গি: ইসলামিক স্কলাররা স্পষ্ট করেন যে কুরআন বা সহীহ হাদিসে সরাসরি নারীকে রাষ্ট্রপ্রধান বা সর্বোচ্চ বিচারপতি হওয়া থেকে নিষেধ করে এমন কোনো স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা (নাস) নেই। বরং কুরআনে নারীর সম্মান, অধিকার এবং তার সক্ষমতা বিকাশের কথা বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন:
- “নিশ্চয়ই নারী ও পুরুষ, মুসলিম নারী ও মুসলিম পুরুষ… আল্লাহ তাদের সবার জন্য প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।” (সূরা আল-আহযাব, আয়াত ৩৫)
- “পুরুষ যা অর্জন করে, তা তার অংশ এবং নারী যা অর্জন করে, তা তার অংশ…” (সূরা আন-নিসা, আয়াত ৩২) – যা নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও মর্যাদার স্বীকৃতি দেয়।
- “আর মুমিন নর-নারী তারা একে অপরের বন্ধু; তারা সৎকাজের আদেশ দেয় ও অসৎকাজে নিষেধ করে…” (সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত ৭১) – যা নারী-পুরুষের সমান অংশীদারিত্ব ও সামাজিক দায়িত্বের কথা বলে।
বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার ড. জাকির নায়েক তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেন, “ইসলাম নারীকে নেতৃত্ব দিতে বাধা দেয় না, তবে নির্দিষ্ট কিছু প্রেক্ষাপটে (যেমন পরিবারের অভিভাবকত্ব) দায়িত্বের বন্টনে কিছু নির্দেশনা রয়েছে। সামাজিক, শিক্ষাগত, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর যোগ্যতা অনুযায়ী নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ ইসলামে বিদ্যমান।
বাস্তব জীবনে ইসলামী নীতিমালার প্রয়োগ: ক্ষেত্র ও শর্তাবলী (Practical Application in Real Life: Fields and Conditions)
ইসলাম নারীর নেতৃত্বকে একটি খোলা চেক বই দেয় না, আবার তালাবদ্ধ দরজাও দেয় না। বরং এটি একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ প্রদান করে, যেখানে যোগ্যতা, নৈতিকতা ও সামাজিক প্রেক্ষাপট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইসলামে নারী নেতৃত্বের সুযোগ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কীভাবে প্রসারিত হয় এবং এর সাথে জড়িত শর্তাবলী বুঝতে পারলেই বাস্তবায়ন সম্ভব।
- শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব:
- সুযোগ: ইসলাম জ্ঞানার্জনকে নারী-পুরুষ সবার উপর ফরজ করেছে। তাই শিক্ষিকা, অধ্যাপিকা, গবেষিকা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ, এমনকি ইসলামিক স্কলার হওয়া – সবই ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত সম্মানিত ও পূর্ণাঙ্গভাবে অনুমোদিত পেশা। বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলিমা বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের উদ্যোগে নারী শিক্ষার প্রসার এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বর্তমানে বাংলাদেশের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ায় নারীরা অধ্যাপনা করছেন, গবেষণা পরিচালনা করছেন।
- শর্ত ও নীতিমালা: শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ইসলামী আদব-কায়দা (যেমন পর্দার বিধান) মেনে চলা। নারী শিক্ষার্থীদেরকে নারী শিক্ষিকাদের দ্বারা শিক্ষাদান ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত। ইসলামিক স্টাডিজ বা ফিকহ শেখানোর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ইলম (জ্ঞান) ও যোগ্যতা থাকা আবশ্যক। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ নারীদের জন্য আলিমা ট্রেনিং প্রোগ্রাম পরিচালনা করে, যা ধর্মীয় শিক্ষায় নেতৃত্বের পথ তৈরি করছে।
- সামাজিক সেবা ও উন্নয়নমূলক কাজে নেতৃত্ব:
- সুযোগ: সমাজসেবা, দান-সদকা, এতিম-অসহায়ের দেখভাল, স্বাস্থ্যসেবা (বিশেষত নারী ও শিশু স্বাস্থ্য), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, নারী অধিকার সচেতনতা, দারিদ্র্য বিমোচন ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীর নেতৃত্ব ইসলামে অত্যন্ত উৎসাহিত। বাংলাদেশের ব্র্যাক, আশা, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মতো সংস্থাগুলোতে অসংখ্য নারী মাঠপর্যায় থেকে উচ্চপর্যায় পর্যন্ত নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যারা ইসলামী মূল্যবোধের আলোকেই তাদের কাজকে দেখেন। স্থানীয় কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট, কো-অপারেটিভ সোসাইটির নেতৃত্বে নারীরা সফলতার স্বাক্ষর রাখছেন।
- শর্ত ও নীতিমালা: কাজের পরিবেশ ও পদ্ধতি শরীয়াহ সম্মত হওয়া। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা এড়িয়ে সামাজিক দূরত্ব (হিজাব) বজায় রেখে কাজ করা। সততা, নিষ্ঠা ও জনকল্যাণকে প্রাধান্য দেওয়া। ইসলামিক রিলিফ কমিটি বাংলাদেশের (IRCB) মতো সংগঠনগুলোতে নারীরা শরণার্থী শিবিরে নারী ও শিশুদের জন্য কাজের নেতৃত্ব দেন শরীয়াহ মেনেই।
- রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ:
- সুযোগ: ইসলামে নারীর মতামত প্রদান, পরামর্শ দেওয়া এবং শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ নয়। নবীজি (সা.) এর সময় উম্মে সালামা (রা.) এর মতামত উসমানা বিন যায়েদ (রা.) কে সেনাপতি নিযুক্তির ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হয়েছিল। বর্তমান যুগে সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, স্থানীয় সরকারের চেয়ারম্যান/মেম্বার, এমনকি রাষ্ট্রপ্রধান পদেও (যদিও এ নিয়ে ফিকহি বিতর্ক আছে) মুসলিম নারীরা অধিষ্ঠিত রয়েছেন। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেত্রী – সকলেই মুসলিম নারী।
- শর্ত ও নীতিমালা: সর্বোচ্চ নির্বাহী পদ (যেমন রাষ্ট্রপ্রধান) নিয়ে ইসলামিক স্কলারদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। একদল (প্রধানত হানাফি মাযহাব অনুসরণকারী) যুক্তি দেখান যে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও যুদ্ধনীতি নির্ধারণের মতো দায়িত্বের প্রেক্ষাপটে পুরুষ নেতৃত্বকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। অন্যদল (সমকালীন অনেক স্কলার) যুক্তি দেখান যে আয়াত ও হাদিসে সরাসরি নিষেধ নেই, এবং বর্তমান যুগের প্রেক্ষাপট ভিন্ন; যোগ্যতা ও প্রয়োজনই প্রধান বিবেচ্য হওয়া উচিত। অন্যান্য রাজনৈতিক পদে (সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, স্থানীয় নেতা) নারীর অংশগ্রহণে অধিকাংশ স্কলারই কোনো বাধা দেখেন না, যদি তা শরীয়াহর সীমানার মধ্যে থেকে জনকল্যাণের জন্য হয়। ইসলামিক মূল্যবোধ রক্ষা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাই মুখ্য। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় সরকারে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে, যা অংশগ্রহণে সুযোগ বাড়াচ্ছে।
- অর্থনৈতিক উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়িক নেতৃত্ব:
- সুযোগ: হজরত খাদিজা (রা.) এর উত্তরসূরি হিসেবে নারীরা ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প প্রতিষ্ঠান, কুটির শিল্প, কৃষি, টেকনোলজি স্টার্টআপ – সর্বত্রই সফল নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ইসলাম নারীর সম্পদের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার পূর্ণ অধিকার দিয়েছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে নারী শ্রমিক ও ম্যানেজারদের বিশাল ভূমিকা, পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর মাধ্যমে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে নারীদের ঋণ ও প্রশিক্ষণ প্রদান – এসবই ইসলামে নারী নেতৃত্বের সুযোগ এর অর্থনৈতিক দিকের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইসলামিক ফাইন্যান্স বা হালাল ব্যবসার ক্ষেত্রেও নারীরা উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে আসছেন।
- শর্ত ও নীতিমালা: ব্যবসায়িক লেনদেন শরীয়াহ সম্মত হওয়া (সুদ, জুয়া, হারাম পণ্য বর্জন)। কর্মক্ষেত্রে ইসলামী শিষ্টাচার বজায় রাখা। সততা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ইসলামিক ব্যাংকগুলো বিশেষ মাইক্রোফাইন্যান্স ও ব্যবসায়িক ঋণের সুবিধা দিচ্ছে।
- পরিবার ও সন্তান প্রতিপালনে নেতৃত্ব:
- সুযোগ: ইসলামে মাকে ‘স্বর্গের পাদদেশ’ বলা হয়েছে। সন্তান লালন-পালন, তাদের চরিত্র গঠন, শিক্ষাদান, পরিবারের পরিবেশ সুন্দর রাখা – এগুলো সবই নারীর জন্য সর্বোচ্চ মর্যাদার নেতৃত্বের দায়িত্ব। একজন নারী তার সন্তানকে সঠিকভাবে গড়ে তুলে ভবিষ্যতের নেতৃত্ব দান করেন। এই ভূমিকা সমাজ গঠনের ভিত্তি।
- শর্ত ও নীতিমালা: স্বামীর সাথে পরামর্শ ও সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ। ইসলামী মূল্যবোধে সন্তানদের গড়ে তোলা। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া। এই নেতৃত্বের গুরুত্ব অপরিসীম।
সাধারণ শর্তাবলী (সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য):
- যোগ্যতা ও জ্ঞান: সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা থাকা।
- নৈতিক চরিত্র (আখলাক): সততা, আমানতদারী, ন্যায়পরায়ণতা, দায়িত্ববোধ, ধৈর্য ও সহনশীলতা থাকা।
- ইসলামী শরীয়াহর অনুসরণ: সকল কর্মকাণ্ড ইসলামের মৌলিক নীতিমালা ও আদর্শের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। হারাম কাজে নেতৃত্ব দেওয়া যায় না।
- পর্দা ও শালীনতা (হিজাব): ইসলাম নির্দেশিত পর্দার বিধান মেনে চলা। এটি শুধু পোশাক নয়, আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির শালীনতাও বোঝায়।
- সামাজিক কল্যাণ (মাসলাহা): নেতৃত্বের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মানুষের কল্যাণ সাধন, ব্যক্তিগত স্বার্থ বা ক্ষমতার লোভ নয়।
- পরিবারের দায়িত্বের সাথে সমন্বয়: ইসলামে নারীর উপর স্ত্রী ও মা হিসেবে দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাইরের নেতৃত্বের দায়িত্ব যেন পরিবারের এই মৌলিক দায়িত্ব ও অধিকারকে ক্ষুণ্ণ না করে, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতা এখানে মূল চাবিকাঠি।
বাংলাদেশে নারী নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জ ও ইসলামিক দৃষ্টিকোণ (Challenges and Islamic Perspectives in Bangladesh)
বাংলাদেশে নারী নেতৃত্বের পথ মসৃণ নয়। ইসলামী মূল্যবোধকে ভুল ব্যাখ্যা করা বা সামাজিক কুসংস্কার নারীর অগ্রযাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এগুলোকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার আলোকে চিহ্নিত করা এবং সমাধানের পথ দেখানো জরুরি।
- সামাজিক কুসংস্কার ও ভুল ব্যাখ্যা:
- চ্যালেঞ্জ: “নারী ঘরের কোণায় থাকবে”, “নারীর কথা শুনলে সংসার অশান্ত হয়”, “মেয়েদের বেশি পড়ালেখা করালে বিয়ের বাজারে দাম কমে যায়” – এ ধরনের কুসংস্কারপূর্ণ ধারণা এখনও সমাজে প্রচলিত। কিছু লোক ইসলামের নামে নারীর শিক্ষা, কাজ ও নেতৃত্বকে নিরুৎসাহিত করেন, যা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার পরিপন্থী।
- ইসলামিক দৃষ্টিকোণ: ইসলাম নারীকে ঘরে বন্দী থাকতে বলে না। নবীজির স্ত্রীগণ ও সাহাবিয়াগণ বিভিন্ন প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হয়েছেন, ব্যবসা করেছেন, জিহাদে অংশ নিয়েছেন (চিকিৎসা, পানি সরবরাহ ইত্যাদি সেবামূলক কাজে)। কুরআনে জ্ঞানার্জনের নির্দেশ সবার জন্য। ইসলামী ইতিহাসে জ্ঞানী নারীদের মর্যাদা সুবিদিত। এই কুসংস্কারগুলো ইসলাম নয়, বরং অজ্ঞতা ও স্থানীয় সংস্কৃতির প্রভাব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, “ইসলাম নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। নারীর শিক্ষা, কর্ম ও নেতৃত্বের অধিকার ইসলামে স্বীকৃত, তবে তা শরীয়াহর সীমারেখার মধ্যেই। সামাজিক কুসংস্কার ইসলাম নয়, বরং ইসলামের নামে বিকৃতিই নারীর অগ্রযাত্রার প্রধান বাধা।”
- শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাব:
- চ্যালেঞ্জ: বিশেষত গ্রামীণ ও দরিদ্র পরিবারে নারীরা শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নের পর্যাপ্ত সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ (যেমন পাবলিক স্পিকিং, ম্যানেজমেন্ট, প্রযুক্তি জ্ঞান) তাদের নাগালের বাইরে থাকে।
- ইসলামিক দৃষ্টিকোণ: ইসলাম জ্ঞানার্জনকে ফরজ করেছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জ্ঞানার্জনের সুযোগ সৃষ্টি করা পরিবার ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। নারীদের জন্য আলাদা ও মানসম্মত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা ইসলামী সমাজের অপরিহার্য কর্তব্য। বাংলাদেশ সরকারের নারী শিক্ষা প্রকল্প ও মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এর বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এই অভাব পূরণে কাজ করছে।
- কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য ও হয়রানি:
- চ্যালেঞ্জ: সমান কাজের জন্য অসম বেতন, পদোন্নতিতে বাধা, যৌন হয়রানি, সামাজিক কটূক্তি ইত্যাদি নারী নেতৃত্বের পথে বড় বাধা।
- ইসলামিক দৃষ্টিকোণ: ইসলামে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা অত্যাবশ্যক। “নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দান করার আদেশ দেন…” (সূরা আন-নাহল, আয়াত ৯০)। কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন, তার অধিকার নিশ্চিত করা এবং যেকোনো ধরনের হয়রানি থেকে তাকে রক্ষা করা ইসলামের স্পষ্ট নির্দেশ। ইসলামী নৈতিকতা কর্মক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বাংলাদেশ শ্রম আইন ও ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশন, বাংলাদেশ নারী কর্মীদের অধিকার রক্ষায় কাজ করে।
- পরিবার ও কর্মজীবনের সমন্বয়:
- চ্যালেঞ্জ: নারী নেতৃত্বের উচ্চপর্যায়ের পদে যেতে গেলে দীর্ঘ সময় ও শক্তি ব্যয় করতে হয়, যা অনেক সময় পরিবারের দায়িত্ব পালনে চাপ সৃষ্টি করে। সমাজ অনেক সময় ‘ভালো মা’ ও ‘সফল নেতা’ হওয়াকে পরস্পরবিরোধী হিসেবে দেখে।
- ইসলামিক দৃষ্টিকোণ: ইসলাম নারীর উপর স্ত্রী ও মা হিসেবে দায়িত্বকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়, তবে একে একমাত্র পরিচয় হিসেবে সীমাবদ্ধ করে না। স্বামীর সহযোগিতা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। নবীজি (সা.) নিজেই ঘরের কাজে স্ত্রীদের সাহায্য করতেন। পারিবারিক দায়িত্ব ও পেশাগত নেতৃত্বের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা এবং পরিবারের সদস্যদের (বিশেষত স্বামীর) সমর্থন ও সহযোগিতা নিশ্চিত করাই ইসলামী সমাধান। একে অপরের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে সহযোগিতার মনোভাব পোষণ ইসলামের শিক্ষা।
- ধর্মীয় নেতৃত্বে প্রতিবন্ধকতা:
- চ্যালেঞ্জ: মসজিদের ইমামতি বা পুরুষদের জন্য জুমার খুতবা দেওয়ার মতো ধর্মীয় পদে নারীরা অংশ নিতে পারেন না – এটি ইসলামের ঐকমত্য। তবে ধর্মীয় শিক্ষা দান, ফতোয়া প্রদান (যদিও এটিও বিতর্কিত), ইসলামিক সংস্থা পরিচালনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে।
- ইসলামিক দৃষ্টিকোণ: পুরুষদের সমন্বয়ে গঠিত জামাতের ইমামতি নারী করবেন না – এ ব্যাপারে ইসলামিক স্কলারদের ঐক্যমত আছে। তবে নারীদের জন্য আলাদা জামাতে নারী ইমামতি করার সুযোগ আছে, যেমন নবীজির যুগে উম্মে ওয়ারাকা (রা.) এর উদাহরণ। ধর্মীয় জ্ঞান বিতরণ, আলিমা হিসেবে ফতোয়া প্রদান (বিশেষত নারী বিষয়ে), ইসলামিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে যোগ্য নারীদের নেতৃত্বকে অনেক সমকালীন স্কলার স্বাগত জানান, যদি তা শরীয়াহর সীমানার মধ্যে থাকে এবং প্রয়োজনীয় যোগ্যতা তাদের থাকে। বাংলাদেশে ‘আলিমা’ ট্রেনিং প্রোগ্রাম এদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
ক্ষমতায়নের পথে: ইসলামিক নারী নেতৃত্ব বিকাশের কৌশল (Strategies for Empowerment)
ইসলামে নারী নেতৃত্বের সুযোগ কে বাস্তবে রূপ দিতে, শুধু তত্ত্ব নয়, প্র্যাকটিক্যাল পদক্ষেপ প্রয়োজন। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র – সবাইকে তাদের ভূমিকা পালন করতে হবে।
- ব্যক্তিগত স্তরে (For the Individual Woman):
- জ্ঞানার্জন: ইসলামী জ্ঞান (কুরআন, হাদিস, ফিকহ, সীরাত) এবং প্রয়োজনীয় আধুনিক জ্ঞান (শিক্ষা, পেশাগত দক্ষতা, প্রযুক্তি) অর্জনে সদা তৎপর থাকা। জ্ঞানই শক্তি ও আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি।
- চরিত্র গঠন: ইসলামী আখলাক (সততা, আমানতদারী, ধৈর্য, দায়িত্ববোধ, সহানুভূতি) অর্জন করা। নেতৃত্বের জন্য চরিত্রই মূলধন।
- আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি: নিজের যোগ্যতা ও সক্ষমতার উপর বিশ্বাস রাখা। ইসলামী ইতিহাসের নারী নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত দ্বারা অনুপ্রাণিত হওয়া।
- নেটওয়ার্কিং: অন্যান্য সফল ও আদর্শবান নারীদের সাথে যোগাযোগ রাখা, মেন্টরশিপ নেওয়া, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করা। নারী সংগঠনগুলোর সাথে যুক্ত হওয়া।
- পরিবারের সাথে খোলামেলা আলোচনা: স্বামী, পিতা-মাতা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে নিজের লক্ষ্য ও স্বপ্ন শেয়ার করা, ইসলামী দলিলের আলোকে বোঝানো, তাদের সমর্থন আদায় করা।
- পরিবারিক স্তরে (For the Family):
- কন্যা সন্তানের শিক্ষায় গুরুত্ব: ছেলে ও মেয়ে সন্তানকে সমান গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ করা। ইসলামী ও জাগতিক শিক্ষায় সমান সুযোগ দেওয়া।
- স্ত্রীর স্বপ্নকে সমর্থন: স্বামীর উচিত স্ত্রীর শিক্ষা, পেশা ও নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান করা এবং সম্ভব হলে সহযোগিতা করা। পারস্পরিক পরামর্শ ও সমঝোতা (তাশাওর) ইসলামী দাম্পত্য জীবনের মূলনীতি।
- ঘরের দায়িত্ব ভাগাভাগি: নারী যখন বাইরের দায়িত্ব পালন করেন, ঘরের কাজে স্বামী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের এগিয়ে আসা উচিত। এটি নারীর উপর চাপ কমাবে এবং তাকে নেতৃত্বে মনোনিবেশ করতে সাহায্য করবে।
- ইতিবাচক মানসিকতা গড়ে তোলা: পরিবারে নারীর সাফল্যকে উদযাপন করা, তাকে উৎসাহ দেওয়া, সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রক্ষা করা।
- সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে (For Society and Institutions):
- ইসলামী শিক্ষার সংস্কার: মাদ্রাসা ও সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা, বিশেষত নারীর মর্যাদা ও অধিকার বিষয়ে সঠিক ও যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা। নারী আলিমা তৈরির ব্যবস্থা জোরদার করা।
- মিডিয়া ও ধর্মীয় বক্তৃতায় সচেতনতা: নারীর বিরুদ্ধে ভুল ধারণা ও কুসংস্কার প্রচার করা থেকে বিরত থাকা। ইসলামের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারে মিডিয়া ও ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
- নারী-বান্ধব কর্মক্ষেত্র: কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য পর্দা ও শালীনতার ব্যবস্থা, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, মাতৃত্বকালীন সুবিধা, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য দূরীকরণ, নেতৃত্বে নারীদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ ও মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম চালু করা। ইসলামী ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসতে পারে।
- রাষ্ট্রীয় নীতি ও সহায়তা: নারী শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশিক্ষণ ও উদ্যোক্তা উন্নয়নে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে নারী নেতৃত্বে কোটা ও সুযোগ সৃষ্টি করা। নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধ ও আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করা। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর এর বিভিন্ন কর্মসূচি এদিকে নজর রাখে।
- ইসলামিক সংগঠন ও মসজিদের ভূমিকা: মসজিদ কমিটি ও ইসলামিক সংগঠনগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বের সুযোগ তৈরি করা। নারীদের জন্য আলাদা সেশন ও কর্মশালার আয়োজন করা।
জেনে রাখুন-
ইসলাম কি নারীকে রাষ্ট্রপ্রধান হতে দেয়?
- এই বিষয়ে ইসলামিক স্কলারদের মধ্যে মতভেদ আছে। কিছু ঐতিহ্যবাহী স্কলার (প্রধানত হানাফি মাযহাব অনুযায়ী) যুক্তি দেখান যে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী পদ, যার দায়িত্বে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব ও যুদ্ধনীতি নির্ধারণ অন্তর্ভুক্ত, তা পুরুষের জন্য সংরক্ষিত। তারা কুরআনের কিছু আয়াত (যেমন ৪:৩৪) এবং হাদিসের ভিত্তিতে এই মত দেন। অন্যদিকে, অনেক আধুনিক স্কলার যুক্তি দেখান যে কুরআন বা সহীহ হাদিসে সরাসরি নিষেধ নেই। তারা বলেন, যুদ্ধনীতি এখন জেনারেলদের হাতে, এবং যোগ্যতা ও প্রজ্ঞাই প্রধান বিবেচ্য হওয়া উচিত। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়ার মতো মুসলিম দেশে নারী রাষ্ট্রপ্রধান/প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এটি একটি চলমান বিতর্ক, যেখানে প্রেক্ষাপটভেদে মতভিন্নতা থাকতে পারে।
- নারীরা কি পুরুষের অধীনস্থ? ইসলামে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের ভূমিকা কি এক?
- ইসলামে নারী-পুরুষের ভূমিকা ও দায়িত্বে পার্থক্য আছে, কিন্তু মর্যাদায় সমান। কুরআনে বলা হয়েছে, “পুরুষ নারীর কর্তা (কাওয়ামুন)” (৪:৩৪)। এর অর্থ হলো পারিবারিক কাঠামোয় পুরুষের উপর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে পরিবারের ভরণপোষণ, নিরাপত্তা ও নেতৃত্ব দেওয়ার। এটি কর্তৃত্ব নয়, বরং দায়িত্বশীলতা। এর অর্থ এই নয় যে নারী জ্ঞান, যোগ্যতা বা নৈতিকতায় কম, অথবা সামাজিক, শিক্ষাগত, অর্থনৈতিক বা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে পারবে না। ইসলামে নেতৃত্বের ভূমিকা ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। পারিবারিক ক্ষেত্রে দায়িত্ব বন্টন আছে, কিন্তু অন্যান্য বহু ক্ষেত্রে যোগ্যতার ভিত্তিতে নারী নেতৃত্ব দিতে পারেন।
- পর্দা (হিজাব) নারী নেতৃত্বের জন্য বাধা নয় তো?
- একেবারেই নয়। পর্দা ইসলামে নারীর জন্য একটি আবশ্যিক বিধান, যা তার সম্মান ও নিরাপত্তার জন্য। এটি তার যোগ্যতা, বুদ্ধিমত্তা বা নেতৃত্বের ক্ষমতাকে সীমিত করে না। বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মুসলিম নারী পর্দা মেনে শিক্ষিকা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, এমনকি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সফল নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পর্দা শারীরিক পোশাকের পাশাপাশি আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির শালীনতাও বোঝায়, যা একজন নেতার জন্য অপরিহার্য গুণ। এটি বাধা নয়, বরং একটি পরিচয় ও নৈতিক দিকনির্দেশনা।
- কোন কোন ক্ষেত্রে ইসলামে নারীর নেতৃত্ব স্পষ্টভাবে স্বীকৃত?
- ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই নিম্নোক্ত ক্ষেত্রগুলোতে নারীর নেতৃত্বের স্পষ্ট ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় ভিত্তি রয়েছে:
- শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চা: শিক্ষিকা, আলিমা, গবেষিকা।
- সামাজিক সেবা ও জনকল্যাণ: এতিমখানা, হাসপাতাল, দাতব্য সংস্থা পরিচালনা, সমাজ সংস্কার।
- অর্থনৈতিক উদ্যোগ: ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা, সমবায় সমিতির নেতৃত্ব।
- ধর্মীয় নির্দেশনামূলক ভূমিকা (নারীদের জন্য): নারীদের জামাতের ইমামতি, নারীদের ধর্মীয় শিক্ষাদান।
- পরিবার ও সন্তান প্রতিপালন: মা হিসেবে সন্তানের ভবিষ্যৎ গঠনে নেতৃত্ব।
- পরামর্শদান: শাসক বা নেতাদেরকে পরামর্শ প্রদান (যেমন উম্মে সালামা (রা.) এর উদাহরণ)।
- স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ (বিতর্কিত সর্বোচ্চ পদ ছাড়া): সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি।
- ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই নিম্নোক্ত ক্ষেত্রগুলোতে নারীর নেতৃত্বের স্পষ্ট ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় ভিত্তি রয়েছে:
- একজন নারী কীভাবে ইসলামিক মূল্যবোধ বজায় রেখে আধুনিক নেতা হতে পারেন?
- ইসলামী মূল্যবোধ বজায় রেখে আধুনিক নেতা হওয়ার মূলমন্ত্র হলো ভালো কাজে প্রতিযোগিতা (কুরআন ৫:৪৮) এবং সর্বোত্তম পন্থা অবলম্বন। এর জন্য:
- দৃঢ় ঈমান ও ইবাদত: আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখা, ফরজ ইবাদত নিয়মিত আদায় করা, নৈতিক চরিত্র অটুট রাখা।
- গভীর জ্ঞান: সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে আধুনিক জ্ঞান ও দক্ষতার পাশাপাশি ইসলামী জ্ঞান অর্জন করা যাতে সিদ্ধান্ত শরীয়াহ সম্মত হয়।
- ইসলামী আদব-কায়দা: পর্দা, লজ্জা, নম্রতা, সততা, আমানতদারী, ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখা। কর্মক্ষেত্রে ইসলামী শিষ্টাচার মেনে চলা।
- ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি: সমস্যার সমাধানে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সৃজনশীল ও যুগোপযোগী পন্থা খুঁজে বের করা।
- কল্যাণকামী মনোভাব: নিজের সাফল্য নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মানুষের কল্যাণকে প্রধান লক্ষ্য রাখা।
- ভালো উদাহরণ তৈরি করা: নিজের জীবন ও কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করা যে ইসলামী মূল্যবোধের সাথে আধুনিক নেতৃত্ব পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ।
- ইসলামী মূল্যবোধ বজায় রেখে আধুনিক নেতা হওয়ার মূলমন্ত্র হলো ভালো কাজে প্রতিযোগিতা (কুরআন ৫:৪৮) এবং সর্বোত্তম পন্থা অবলম্বন। এর জন্য:
ইসলামে নারী নেতৃত্বের সুযোগ কে উপলব্ধি করতে হলে আমাদেরকে কুসংস্কারের চশমা খুলে ফেলতে হবে। ইসলাম নারীকে দিয়েছে মর্যাদা, শিক্ষার অধিকার, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং যোগ্যতা অনুযায়ী নেতৃত্বের দায়িত্ব পালনের সুযোগ। খাদিজা (রা.) এর ব্যবসায়িক প্রজ্ঞা, আয়েশা (রা.) এর জ্ঞানভাণ্ডার, উম্মে সালামা (রা.) এর বিচক্ষণ পরামর্শ – এগুলো শুধু ইতিহাস নয়, আজকের নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। বর্তমান বাংলাদেশে গ্রাম থেকে শহর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সংসদ ভবন – সর্বত্রই নারীরা প্রমাণ করছেন ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব। আমাদের দায়িত্ব হলো ইসলামের সঠিক শিক্ষাকে সামনে রেখে, নারীর যোগ্যতাকে স্বীকৃতি দিয়ে, পরিবার ও সমাজের সমর্থনে ক্ষমতায়নের পথ সুগম করা। তাহলেই মায়মুনা আক্তারদের পথচলা আরও প্রসারিত হবে, সমাজ পাবে আরও অনেক যোগ্য নেতৃত্ব। নারী নেতৃত্বের ইসলামিক গাইডলাইন অনুসরণ করে গড়ে উঠুক একটি ভারসাম্যপূর্ণ, ন্যায়ভিত্তিক ও উন্নত সমাজ। এগিয়ে যান, ইসলামের আলোকে নিজের যোগ্যতায় বিশ্বাস রেখে, ক্ষমতায়নের এই পথে আপনিও হোন একজন পথিকৃৎ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।