লাইফস্টাইল ডেস্ক : মাজহাব আরবি শব্দ। যার অর্থ হলো মত, পথ, বিশ্বাস, মতবাদ ইত্যাদি। যুগে যুগে সন্ধানী গবেষকরা তাঁদের মেধা ও শ্রম দিয়ে কোরআন-সুন্নাহর বাণী আরো সহজ করে ফুটিয়ে তুলেছেন, যা হানাফি, মালেকি, শাফেয়ি ও হাম্বলি নামে চার মাজহাব হিসেবে প্রসিদ্ধ। মাজহাবগুলোর মধ্যে পরস্পর শাখাগত মাসাআলা নিয়ে মতভেদ থাকলেও প্রত্যেকের ইসলামী মৌলিক বিষয় এক।
সাহাবিদের যুগেও অনেক মাসাআলা নিয়ে তাঁদের মধ্যে মতভেদ ছিল। এ অবস্থায় সাহাবিরা ইজতিহাদ তথা গবেষণার মাধ্যমে বিবদমান সমস্যার সমাধান করেছেন। ইজতিহাদের বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ইজতিহাদ সঠিক হলে দ্বিগুণ সওয়াব এবং বেঠিক হলে একটি সওয়াব।’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)।
নিচে ফিকহবিদদের মতভেদ ও মাজহাবকেন্দ্রিক ভিন্নতার কারণ উল্লেখ করা হলো-
কোরআন ও হাদিসের বর্ণনাভঙ্গি : পবিত্র কোরআন ও হাদিসের কোনো কোনো বক্তব্য মুজমাল তথা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। যেগুলোর কোথাও কোথাও একাধিক অর্থবোধক শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, আবার কোথাও ব্যবহৃত হয়েছে অস্পষ্ট শব্দ। এসবের ব্যাখ্যা ও সঠিক মর্মার্থ উত্ঘাটনে বিভিন্ন মতের সৃষ্টি হয়ে বিভিন্ন মতভেদ ও মাজহাব গঠিত হয়েছে। যেমন—আল্লাহ তাআলার বাণী, ‘তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী তিন কুরু অপেক্ষায় থাকবে।’ (সুরা : আল-বাকারাহ, আয়াত : ২২৮)
এখানে উল্লিখিত কুরু শব্দটি একাধিক অর্থবোধক। এর এক অর্থ হায়েজ তথা মাসিক, অপর অর্থ পবিত্রতা। অর্থাৎ পরস্পরবিরোধী সম্পূর্ণ বিপরীত দুটি অর্থ। সাহাবি আলী (রা.), ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) ও ইমাম আবু হানিফা (রহ.)সহ অনেকে বলেছেন, ‘কুরু শব্দটি এখানে হায়েজ তথা মাসিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।’ অপরদিকে সাহাবিয়া আয়েশা (রা.), জায়েদ ইবনে সাবিত (রা.) ও ইমাম শাফেয়ি (রহ.)সহ অনেকে বলেছেন, ‘কুরু শব্দটি এখানে পবিত্রতা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।’ (মাকাসিদুশ শরিয়াহ)
এভাবেই মাজহাবে ভিন্নতার সৃষ্টি হয়।
গবেষণায় ভিন্নতা : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘উত্তম যুগ হলো আমার যুগ, তারপর তাবেঈদের যুগ, তারপর তাবে-তাবেঈদের যুগ।’ (সহিহ বুখারি) প্রত্যেক যুগের মতো তাবে-তাবেঈদের যুগেও ফিকহবিদরা গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তাঁরা কোনো বিষয়কে সরাসরি গ্রহণ না করে গবেষণা ও চিন্তা-ভাবনা করে সঠিক বিষয়টি গ্রহণ করতে চেষ্টা করতেন। আর এ গবেষণায় ভিন্নতা সৃষ্টি হওয়ায় বিভিন্ন মতভেদ ও মাজহাবের সৃষ্টি হয়েছে।
সাহাবায়ে কিরামের বর্ণিত হাদিসের মতভেদ : ইমাম শাফেয়ি (রহ.) সলফে সালেহিন তথা—সাহাবি, তাবেঈ ও তাবে-তাবেঈদের ঐক্য না হলে ওই হাদিস অনুযায়ী আমল করতেন না। অন্যদিকে সনদ তথা হাদিস বর্ণনার ক্রম বিশুদ্ধ হলেই ইমাম আবু হানিফা (রহ.) সেই হাদিসের ওপর আমল করতেন। এভাবেই হাদিসের মধ্যে আমলের ক্ষেত্রে ফিকহবিদদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিয়েছে, আর এর ফলে বিভিন্ন মাজহাবেরও সৃষ্টি হয়েছে।
সাহাবি ও তাবেঈদের কথায় মতভেদ : সাহাবি ও তাবেঈদের কথায় ভিন্নতা সৃষ্টি হওয়ার কারণে তাবে-তাবেঈদের কথা, সিদ্ধান্ত এবং গবেষণায়ও ভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে। আর সাহাবি ও তাবেঈদের কথায় ভিন্নতা থাকার অন্যতম কারণ হলো তাঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ শিক্ষককে অনুসরণ করতেন।
মহানবী (সা.)-এর আমলের পরিবর্তন ও সাহাবিদের হিজরত : বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ওহি নাজিল হওয়ার পর রাসুল (সা.) অনেক আমলের পরিবর্তন এনেছেন। যেমন—ইসলামের প্রথম যুগে নবী করিম (সা.) নামাজরত অবস্থায় সালামের জবাব দিয়েছেন, ওহির মাধ্যমে হাবশার বাদশাহ নাজ্জাশির শহীদ হওয়ার খবর পেয়ে এক হাজার মাইল দূরে রাসুল (সা.) সাহাবিদের নিয়ে গায়েবানা জানাজা পড়েছেন। পরবর্তী সময়ে রাসুল (সা.) এ রকম অনেক কিছু আর করেননি। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)
এমন অনেক বিষয়ের পর অনেক সাহাবি মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে ইসলাম প্রচারের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে হিজরত করেছেন। অনেক দূরত্বসহ নানা কারণে ওই সাহাবিদের সঙ্গে পরবর্তী সময়ে আর রাসুল (সা.)-এর সাক্ষাৎ হয়নি। ফলে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আমল পরিবর্তনের অনেক হাদিস উক্ত হিজরতকারী সাহাবিদের কাছে পৌঁছেনি, যা পরে বিভিন্ন মতভেদ ও মাজহাব সৃষ্টির অন্যতম কারণ।
এখন প্রশ্ন হলো আলেম, ফিকহবিদদের মতভেদ ও মাজহাব ভিন্নতায় সাধারণ মানুষের করণীয় কী? এখানে সাধারণ মানুষের করণীয় হলো—‘মাছ বাজারে গিয়ে দোকানদারের কথা ও মাছ যাচাই করে মাছ কেনার মতো’ অর্থাৎ নিজের মেধা ও যোগ্যতার আলোকে কোনো বিশেষজ্ঞ আলেমের পরামর্শ মেনে চলা। বিভিন্ন আলেমের মধ্যে যিনি বেশি জ্ঞানী, তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী চলে মহান আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করা।
সাইফুল ইসলাম
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।