ধর্ম ডেস্ক : ইসলামী সমাজব্যবস্থায় কবর একটি অপরিহার্য অংশ। কোনো মুমিন মারা গেলে তাঁকে কবরস্থ করা হয়। শরিয়তে কবরের মর্যাদা স্বীকৃত। ইসলাম কবরের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন এবং তা পদদলিত করা নিষিদ্ধ করেছে।
এমনকি রাসুলুল্লাহ (সা.) কবরের ওপর বসতেও নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমাদের জন্য কবরের ওপর বসার চেয়ে জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর বসা এবং অঙ্গারে কাপড় পুড়ে তা চামড়া পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া উত্তম।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৯৭১)
কবর সম্মানজনক স্থান
কবর মুসলমানের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ। তাই কবরের প্রতি সম্মান রক্ষা করা মুমিনের দায়িত্ব।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তার মৃত্যু ঘটান এবং তাকে কবরস্থ করেন। এরপর যখন ইচ্ছা তিনি তাকে পুনর্জীবিত করবেন।’
(সুরা : আবাসা, আয়াত : ২১-২২)
এ ছাড়া একাধিক হাদিসে কবরের ওপর বাসা, জুতা পায়ে কবরের ওপর হাঁটা ইত্যাদি নিষেধ করা হয়েছে। যার দ্বারা কবরের সম্মান প্রমাণিত হয়।
সম্মানে সীমা লঙ্ঘন নয়
কবর ও কবরস্থানের সম্মান রক্ষায় মুমিন সীমা লঙ্ঘন করবে না, বরং শরিয়তের সীমা রক্ষা করবে। এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘ইহুদি ও খ্রিস্টানদের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ। তারা তাদের নবীদের কবরকে সিজদার স্থান হিসেবে গ্রহণ করেছে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৫৩০)
কবরের পরিচর্যায় করণীয়
যেহেতু ইসলাম কবরকে সম্মানের স্থান বলেছে, তাই কবরের পরিচর্যায় কিছু কাজ করারও অনুমতি দিয়েছে। যেমন—
১. মাথার কাছে চিহ্ন রাখা : মুসলমানের কবরের মাথার দিকে কোনো কিছু দিয়ে চিহ্নিত করে রাখা উত্তম।
কেননা নবীজি (সা.) এমনটি করেছিলেন। আল মুত্তালিব (রহ.) বলেন, উসমান ইবনু মাজউন (রা.) মারা গেলে তাঁর লাশ আনা হলো, তারপর দাফন করা হলো। নবী করিম (সা.) এক ব্যক্তিকে তাঁর কাছে একটি পাথর নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ দিলেন। কিন্তু লোকটি তা বহন করতে অক্ষম হলো। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে পাথরটির কাছে গেলেন এবং নিজের জামার আস্তিন গুটালেন। অতঃপর তিনি পাথরটি দুই হাতে তুলে এনে (উসমান ইবনু মাজউনের) শিয়রে রাখলেন। তিনি বললেন, এর দ্বারা আমি আমার ভাইয়ের কবর চিনতে পারব এবং আমার পরিবারের কেউ মারা গেলে তার পাশে দাফন করব। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৩২০৬)
ইমাম নববী (রহ.) বলেন, সুন্নত হলো কবরের মাথার দিকে একটি চিহ্ন রাখা। সেটা পাথর, কাঠ বা অন্য কিছুর মাধ্যমে হতে পারে। (আল মাজমু : ৫/২৬৫)
২. কবর সামান্য উঁচু করা : ফিকহের ইমামরা একমত যে মৃত ব্যক্তিকে দাফন করা পর কবর সামান্য পরিমাণ উঁচু করা উত্তম। এর উচ্চতা হবে উটের কুঁজ বা এক বিঘত পরিমাণ। কেননা নবীজি (সা.)-এর কবর এমনই ছিল। সুফিয়ান আত-তাম্মার (রা.) বলেন, তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কবরকে উটের কুঁজের মতো দেখেছেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৩৯০)
ইবনে কুদামা (রহ.) বলেন, কবর এক বিঘত পরিমাণ উঁচু করা মুস্তাহাব। যেন জানা যায় এটি কবর এবং তার অসম্মান করা থেকে বেঁচে থাকা যায়, কবরবাসীর সম্মান করা যায়। কবর বেশি উঁচু করা মুস্তাহাব পরিপন্থী। (আল মুগনি : ২/১৯০; মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যা : ১১/৩৪২)
৩. কবরস্থানের প্রাচীর নির্মাণ : কবরস্থানের চারপাশে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করা উত্তম। যেন তার সীমানা পৃথক করা যায় এবং সংরক্ষণ করা যায়। পাশাপাশি জীবজন্তুর যাতায়াত বন্ধ হয় এবং শিশুদের খেলাধুলা ও অবাধ ছোটাছুটিও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। (আহকামুল মাকাবির, পৃষ্ঠা-৪৫৭)
যা করা নিষিদ্ধ
কবর পরিচর্যা ও সংরক্ষণের নামে করা কিছু কাজ ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। যেমন—
১. স্থাপনা নির্মাণ করা : কবরের ওপর যেকোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা হারাম। চাই তা উঁচু হোক বা নিচু, চাই তা ঘরের আদলে হোক বা বাড়ির। ফিকহের সব ইমাম কবরের ওপর স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে একমত। হানাফি মাজহাব অনুসারে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য স্থাপনা নির্মাণ করা হারাম এবং দাফনের পর কবর মজবুত করার জন্য কোনো কিছু নির্মাণ করা মাকরুহ। (মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যা : ৩২/২৫০)
জাবের (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) কবরে পাকা ঘর নির্মাণ, কবরকে বর্ধিতকরণ ও চুনকাম করা থেকে নিষেধ করেছেন। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ২০২৭)
২. কবর বেশি উঁচু করা : কবর স্বাভাবিক তথা এক বিঘতের বেশি উঁচু করা নিষেধ। আবুল হাইয়াজ আল আসাদি (রহ.) বলেন, একবার আলী (রা.) আমাকে পাঠালেন এবং বললেন, আমি কি তোমাকে এমন কাজে প্রেরণ করব যে কাজে আমাকে রাসুলুল্লাহ (সা.) পাঠিয়েছিলেন? তাহলো, আমি যেন কোনো উঁচু কবর দেখলে তা সমতল করা ছাড়া এবং কোনো মূর্তি দেখলে চূর্ণবিচূর্ণ না করে নিবৃত্ত না হই। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৩২১৮)
৩. সৌন্দর্যবর্ধন করা : কবরে নানা প্রকার সৌন্দর্যবর্ধক রং কিংবা চুন দিয়ে প্রলেপ দেওয়া মাকরুহ। কবর চুনকাম করা মাকরুহ হওয়ার বিষয়ে ফকিহরা একমত। কেননা (ওপরে উল্লিখিত) জাবির (রা.)-এর হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) তা থেকে নিষেধ করেছেন। উমাইরা বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার হিকমত হলো কবরের সৌন্দর্যবর্ধন। কেননা এটি শরয়ি অনুমোদনহীন খাতে অর্থ নষ্ট করার শামিল।’
(আল-মাউসুয়াতুল ফিকহিয়্যা : ৩২/২৫০)
৪. কবরের চারপাশে প্রাচীর দেওয়া : কবর সংরক্ষণের প্রয়োজন না থাকলে কেবল সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য কবরের চারপাশে প্রাচীর নির্মাণ করা নিষেধ। শায়খ আলবানি (রহ.) বলেন, ‘কবরকে এ ধরনের জাঁকজমকপূর্ণ আকৃতির বেড়া দিয়ে ঘেরাও করা এক প্রকার মন্দ কাজ, যা মানুষকে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অবাধ্যতার দিকে এবং কবরবাসীকে এমন সম্মান করার দিকে ধাবিত করে, যা শরিয়তে জায়েজ নেই।’ (তাহজিরুস সাজিদ, পৃষ্ঠা-৮৯)
৫. কবরের ওপর বসা : কবর পরিচর্যার সময় বা অন্য সময় কবরের ওপর বসা, হেলান দেওয়া এবং কবরস্থানে জুতা পায়ে হাঁটাচলা করা নিষেধ। নবী করিম (সা.) বলেন, ‘তোমাদের জন্য কবরের ওপর বসার চেয়ে জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর বসা এবং অঙ্গারে কাপড় পুড়ে তা চামড়া পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া উত্তম।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৯৭১)
বশির ইবনু খাসাসিয়া (রা.) বলেন, আমি একবার রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে চলছিলাম। তিনি মুসলমানদের একটি কবরস্থানে গিয়ে বললেন যে এরা বহু মন্দ কাজ পরিত্যাগে অগ্রগামী হয়েছে। অতঃপর তিনি মুশরিকদের একটি কবরস্থানে গিয়ে বললেন যে এরা বহু মঙ্গলময় কাজ পরিত্যাগে অগ্রগামী হয়েছে। এরপর তিনি অন্যদিকে লক্ষ করে দেখলেন যে এক ব্যক্তি জুতা পায়ে কবরস্থানে মাঝ দিয়ে হাঁটাহাঁটি করছে। তখন তিনি বললেন, ‘হে পাকা জুতা পরিধানকারী, জুতা ফেলে দাও (খুলে নাও)’। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ২০৪৮)
মুফতি আতাউর রহমান
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।