ধর্ম ডেস্ক : বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আলোচিত একটি বিষয় হলো, (Artificial Intelligence) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। স্বয়ংক্রিয়তা, দক্ষতা বৃদ্ধি ও নতুন নতুন উদ্ভাবনে জোরালো ভূমিকা রেখে সব খাতেই শক্ত অবস্থান তৈরি করছে এই প্রযুক্তি। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, ব্যবসা ও অর্থনীতি, কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন, শিল্প ও উৎপাদন, আইন ও নিরাপত্তা, যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যাদি খাতেই এর ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। মানুষ অল্প খরচ ও সময়ে অধিক ফলাফল পেতে দিন দিন এই প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।
প্রশ্ন হলো, ধর্ম শেখার ক্ষেত্রেও কি এই প্রযুক্তির ওপর আস্থা রাখা যাবে?
এর উত্তর হলো, ইসলামী জ্ঞান শুধু তথ্যগত বিষয় নয়, বরং এর সঙ্গে আধ্যাত্মিকতা, তাকওয়া (আল্লাহভীতি), হিকমাহ (প্রজ্ঞা) ও দীর্ঘ অভিজ্ঞতার সমন্বয় রয়েছে। যেহেতু এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কোনো আত্মা বা আধ্যাত্মিক উপলব্ধি নেই, তাই ইসলামী বিধান বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র এটিকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তদাতা বা নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে গ্রহণ করা বিপজ্জনক হতে পারে। স্রেফ আক্ষরিক জ্ঞান হিদায়াত পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। এ জন্য আল্লাহর রাসুল (সা.) এমন আক্ষরিক জ্ঞান থেকে আশ্রয় চেয়েছেন, যা উপকারে আসে না।
তিনি দোয়া করতেন—‘হে আল্লাহ! আমি সেই জ্ঞান থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই, যা কোনো উপকারে আসে না; এমন দোয়া থেকে, যা শোনা হয় না; সেই অন্তর থেকে, যা ভীত হয় না এবং সেই দেহ থেকে, যা তৃপ্ত হয় না।’
(ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৫০)
সমাধান কী হতে পারে?
১. এআইয়ের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে মানব স্কলারদের তত্ত্বাবধান রাখা এআইকে ইসলামী গবেষণার সহায়ক টুল হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে চূড়ান্ত ফায়সালা ও ব্যাখ্যা অবশ্যই অভিজ্ঞ ও যোগ্য আলেমদের মাধ্যমেই হতে হবে।
এআইভিত্তিক ইসলামিক ফতোয়া বা মাসআলা নির্ধারণে ‘হিউম্যান-ইন-দ্য-লুপ’ ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে, যেখানে এআই শুধু তথ্য সরবরাহ করবে, কিন্তু আলেমরা যাচাই ও অনুমোদন করবেন।
কারণ এআই ইন্টারনেটে থাকা তথ্য-উপাত্তকে বিশ্লেষণ করে তার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে একটি সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করে, যা ধর্মীয় ক্ষেত্রে বিপজ্জনক।
বাজার থেকে বই কিনে এনে কোনো মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি না হয়ে নিজে নিজে বই পড়ে যেমন ডাক্তার হওয়া যায় না, তেমনি কোনো মুত্তাকি আহলে ইলমের তত্ত্বাবধানে না থেকে শুধু বই পড়ে ধর্মীয় বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় না। এ জন্যই নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাঁর বান্দাদের অন্তর থেকে ইলম (ধর্মীয় জ্ঞান) উঠিয়ে নেন না, কিন্তু দ্বিনের আলেমদের উঠিয়ে নেওয়ার ভয় করি। যখন কোনো আলেম অবশিষ্ট থাকবে না তখন লোকেরা মূর্খদেরই নেতা বানিয়ে নেবে। তাদের জিজ্ঞাসা করা হলে না জানলেও ফতোয়া প্রদান করবে। ফলে তারা নিজেরাও পথভ্রষ্ট হবে এবং অন্যকেও পথভ্রষ্ট করবে।’ (বুখারি, হাদিস : ১০০)
ইবেনে সিরিন (রহ.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই এই ইলম হচ্ছে দ্বিন। অতএব, তোমরা লক্ষ রাখবে যে তোমাদের দ্বিন কার কাছ থেকে গ্রহণ করছ?’ (মিশকাত, হাদিস : ২৭৩, মুকাদ্দামায়ে মুসলিম)
এগুলো প্রমাণ করে যে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনে কোনো মুত্তাকি, বিজ্ঞ আলেমের তত্ত্বাবধানে না থেকে স্রেফ এআইয়ের ওপর নির্ভরশীল হওয়া মানুষের বিভ্রান্তির কারণ হবে।
২. নির্ভরযোগ্য ও সত্যায়িত উৎস ব্যবহারের নিশ্চয়তা
এআই কেবলমাত্র বিশুদ্ধ, নির্ভরযোগ্য উৎস (যেমন—কোরআন, সহিহ হাদিস, নির্ভরযোগ্য তাফসির ও ফিকহ গ্রন্থ) থেকে উদ্ধৃতি একত্র করে দিতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো একটি হাদিসের ভাবার্থ মনে আছে, কিন্তু হাদিসের ‘মতন’ বা উৎস মনে নেই। সে ক্ষেত্রে এআই ভাবার্থটি বিশ্লেষণ করে নির্ভরযোগ্য কিতাব থেকে তার কাছাকাছি অর্থের হাদিসগুলো (নিজে থেকে তৈরি না করে) হুবহু খুঁজে দিতে সহায়তা করতে পারে।
অনলাইনে বিভিন্ন ভুল ব্যাখ্যা ও ভিত্তিহীন মতামত থাকা স্বাভাবিক, তাই এআইভিত্তিক ইসলামিক টুলগুলোতে ‘সত্যায়িত ইসলামিক উৎস’ ফিল্টার থাকা উচিত, যা প্রয়োজনে সব মাজহাবের আলেমদের তত্তাবধানে আলাদা মাজহাব উল্লেখ করেও হতে পারে।
৩. এআইয়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত না দিয়ে, বরং গবেষণা সহায়ক টুল হিসেবে ব্যবহার করা ইসলামের বিষয়ে এআই নিজে সিদ্ধান্ত দেবে না, তাই ‘ডিজিটাল মুফতি’ বা ‘ফতোয়া ইঞ্জিন’ তৈরি না করে এটিকে গবেষণার সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
যেমন—ইসলামিক স্কলারদের জন্য এআই ব্যবহার করে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে কোরআন, হাদিস ও ফিকহ গ্রন্থ থেকে রেফারেন্স খুঁজে দেওয়া যেতে পারে। সাধারণ মানুষ সেখান থেকে কোনো তথ্য নেওয়ার আগে অবশ্যই কোনো বিজ্ঞ আলেমের কাছ থেকে তা যাচাই করে নিতে হবে। ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, যে ব্যক্তি (শুধু) বইপত্র থেকে ফিকহ অর্জন করে, সে (শরিয়তের) বিধি-বিধান ধ্বংস করে। (আলমাজমু শরহুল মুহায্যাব : ১/৩৮)
৪. এআইতে ভুল ধরা ও শুদ্ধকরণের ব্যবস্থা রাখা
এআই মডেলকে আপডেট করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক ইসলামিক বোর্ড বা স্কলার কমিটি থাকা প্রয়োজন, যারা ভুল তথ্য শনাক্ত করে সংশোধন করবে।
এআই যদি ভুল তথ্য দেয়, তাহলে স্কলাররা তা সংশোধন করতে পারবেন, এমন ফিডব্যাক সিস্টেম থাকা উচিত।
৫. আধ্যাত্মিকতা ও তাকওয়াকে গুরুত্ব দেওয়া
এআই কখনোই মানুষের ঈমান, তাকওয়া ও আধ্যাত্মিক উপলব্ধির বিকল্প হতে পারে না। তাই সত্যিকারের আত্মশুদ্ধি ও ইসলামী জ্ঞান অর্জনের জন্য অবশ্যই যোগ্য মুত্তাকি আলেমের দারস্থ হওয়া অপরিহার্য। কারণ হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, একজন ফকিহ (শরিয়তের বিধানে অভিজ্ঞ ব্যক্তি) শয়তানের জন্য এক হাজার ইবাদতকারীর চেয়ে অধিক শক্ত। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২২)
তাই আধ্যাত্মিকতা ও তাকওয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়ে এআইকে মানুষের বিকল্প ভাবার সুযোগ নেই। তবে বিজ্ঞ আলেমদের মধ্যে যারা এআই ‘প্রমোট’ সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখে, তাদের গবেষণা গতিশীল করতে এআই চমৎকার সহযোগী টুল হতে পারে; কিন্তু যারা বিজ্ঞ আলেম, তবে এআইকে তার ভাষায় প্রমোট লিখে বোঝাতে সক্ষম নয়, কিংবা এআই প্রমোট লিখতে পটু হলেও বিজ্ঞ আলেম নয়, এমন লোকদের জন্য এআই ব্যবহার করে ইসলাম গবেষণা বিপজ্জনক হতে পারে। কারণ জাগতিক বিষয়েও এআইকে সঠিকভাবে প্রমোট লিখে বোঝাতে ব্যর্থ হলে ভুল তথ্য দিয়ে বসে।
উপসংহার
মূল কথা হলো, এআইকে ইসলামের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তদাতা বা ব্যাখ্যাকারী বানানোর সুযোগ নেই, শরিয়াহ বিষয়ে এআইয়ের সমাধান গ্রহণযোগ্য নয়, বরং এটিকে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান রাখে এমন ব্যক্তিদের ইসলামী গবেষণার সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। ধর্মীয় জ্ঞানের সঙ্গে ঈমান-আমলের সম্পর্ক, তাই এখানে উদাসীনতার কোনো সুযোগ নেই। আল্লাহ সবাইকে সঠিক জ্ঞান আহরণ ও সঠিকভাবে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।