আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ইসরায়েলে গত ৭ অক্টোবর রকেট হামলা চালায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। এর পরপরই গাজা উপত্যকায় হামলা শুরু করে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। এরপর ২৭ অক্টোবর স্থল অভিযান শুরু করে। আড়াই মাসের বেশি সময় ধরে চলা এই সংঘাতে রবিবার পর্যন্ত ৪৮৭ ইসরায়েলি সেনা নিহতের তথ্য জানিয়েছে আইডিএফ।
ইসরায়েলের প্রকাশিত সেনা নিহতের এই তথ্য কতটা সত্য? গাজা উপত্যকায় হামাসের সঙ্গে এই লড়াইয়ে নিজেদের শক্তি জাহির করতে ইসরায়েল কি মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করছে? এসব প্রশ্ন উঠছে এখন।
পশ্চিম এশিয়াভিত্তিক অনলাইন সংবাদমাধ্যম দ্য ক্রেডল সম্প্রতি এ নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে প্রতিবেদক উইলিয়াম ভ্যান ওয়াগেনেন বলছেন, গাজায় হামাসের সেনা হতাহতের চেয়ে অনেক কম ইসরায়েলি সেনা হতাহতের তথ্য জানালে আইডিএফের বেশ সুবিধা হয়। এতে তারা বোঝাতে চায়, যুদ্ধে ইসরায়েলের তেমন ক্ষতি হয়নি। আর তাতে লড়াই আরও চালিয়ে যাওয়ার মৌন সম্মতি আসবে আমেরিকাসহ মিত্র দেশগুলোর পক্ষ থেকে। এছাড়া ইসরায়েলিরাও এতে সম্মতি দেবে।
এমনটাই চাইতে পারে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। আর সে কারণেই ইসরায়েলি সেনা নিহতের সংখ্যা কমিয়ে বলার একটা প্রবণতা থাকতে পারে তাদের মধ্যে। কেননা হামাস ও ফিলিস্তিনিদের হটিয়ে গাজা উপত্যকায় আবার বসতি স্থাপনের দুরভিসন্ধি রয়েছে ইসরায়েলের।
হামাসের সঙ্গে সংঘাতে ইসরায়েলি সেনা নিহতের সংখ্যা যদি উদ্বেগজনক হয়, তাহলে সেখানে তাদের চালানো ‘গণহত্যা’ থামানোর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে চাপ আসতে পারে বলেই মনে করছেন প্রতিবেদক উইলিয়াম ভ্যান ওয়াগেনেন। বেশি চাপ আসবে হোয়াইট হাউস থেকে।
ইসরায়েলি ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে ‘লুকোচুরি’
সংবাদ সংস্থা আনাদুলু বলছে, ৭ অক্টোবর থেকে চলা এই সংঘাতে রবিবার পর্যন্ত ৪৮৭ ইসরায়েলি সেনা নিহতের তথ্য জানিয়েছে আইডিএফ। অনলাইন সংবাদমাধ্যম দ্য ক্রেডল বলছে, ২৭ অক্টোবর গাজায় স্থল অভিযান শুরুর পর থেকে গত ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২১ ইসরায়েলি সেনা নিহতের তথ্য জানানো হয়েছে।
কিন্তু এসব তথ্য কতটা সত্য—তা যাচাই করা বেশ দুরুহই বটে। তবে মিথ্যা হতে পারে বলেই মনে করা হচ্ছে। কেননা যুদ্ধের ময়দানে হামাসের সঙ্গে লড়াইয়ে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে ইসরায়েলকে। সম্প্রতি গাজায় যুদ্ধরত গোলানি বিগ্রেডের সাবেক কমান্ডারের ভাষ্য সেদিকেই ইঙ্গিত করছে।
গোলানি বিগ্রেডের ১৩তম ব্যাটালিয়নের কমান্ডার টমার গ্রিনবার্গ বলেন, ‘আমরা সবচেয়ে প্রতিরোধপূর্ণ এলাকায় প্রবেশ করছি, যেখানে শত্রুশিবিরে সেনার সংখ্যা অনেক।’
গাজা উপত্যকার সুজাইয়া এলাকায় এই অভিযানের আগে জয়ের আশাই করে গিয়েছিলেন কমান্ডার টমার গ্রিনবার্গ। কিন্তু তিনি আর বেঁচে নেই। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর একটি সূত্র বলছে, গত ১২ ডিসেম্বর একটি অভিযানের সময় মারা যান তিনি। এ সময় সঙ্গে ছিলেন আরও ৯ ইসরায়েলি সেনা।
তিনবার সেখানে অভিযান চালিয়েও সুবিধা করতে পারেনি ইসরায়েল। অনেকের মরদেহও নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। ওই সময়ই হামাস একটি হুমকিমূলক বিবৃতি প্রকাশ করে। তাতে লেখা, ‘যত বেশি সময় এখানে তোমরা থাকবে, তত বেশি সেনা হারাতে হবে। ক্ষয়ক্ষতি নিয়েই ফিরতে হবে তোমাদের।’
সুজাইয়া এলাকায় আরও বেশি ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর এক সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মিরি এইসিন বলছেন, ১২ ডিসেম্বর অনেক উঁচু পদের সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলের অনেকটা ক্ষতি হয়েছে এতে।
আর এই মতামতের পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে ইসরায়েলি সেনা নিহতের সংখ্যা সঠিক কিনা—তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সাবেক এক মার্কিন সেনা। এর উত্তরও এসেছে হামাসের পক্ষ থেকে।
হামাস দাবি করেছে, ১২ ডিসেম্বর কাসেম বিগ্রেডের হাতে ১১ ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়েছে। ইসরায়েলের তথ্যের সঙ্গে এর মিল রয়েছে। কিন্তু ঝামেলা অন্যখানে। ওই একই দিন খান ইউনূসে ১০ ইসরায়েলি সেনা, শেখ রাদওয়ানে ২০ জন হতাহত হয়েছে বলে জানায় হামাস। এছাড়া আবু রশিদ পোল নামের এলাকায় ১৫ ইসরায়েলি সেনা হত্যার দাবিও করে তারা।
এই হিসাব করলে ওইদিন অন্তত ৫০ জন ইসরায়েলি হতাহত হয়েছে। এদের বেশির ভাগই নিহতের তালিকায় থাকার কথা। কিন্তু ইসরায়েল জানায়, সংখ্যাটি দশের বেশি নয়।
সংবাদমাধ্যম ও হাসপাতালে সেন্সরশিপ
মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র গণতন্ত্র চর্চাকারী হিসেবে নিজেদের বলে থাকে তেল আবিব। কিন্তু নিরাপত্তা ইস্যুতে কারও কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ রাখে না ইসরায়েল। কোনো সামরিক ঘটনায় যতটুকু তথ্য বাহিনী থেকে প্রকাশ করা হবে, ঠিক ততটুকুই প্রচার করা যাবে। এনিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। এমনকি হাসপাতাল থেকেও যাতে তথ্য ছড়িয়ে না পড়ে, সেই ব্যবস্থাও রয়েছে।
শুধু অক্টোবরে হামাসের হামলার পর এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে—এমনটি নয়। আল আকসা ফ্লাড নামের অপারেশনের সময় হামাসের হাতে প্রাণ যায় ৪১ ইসরায়েলি সেনার। কিন্তু এ নিয়ে বেশি তথ্য দেয়নি ইসরায়েল। এমনকি বছরের পর বছর ধরে চলা হামাস–ইসরায়েল লড়াইয়ে নিহত ইসরায়েলি সেনাদের সংখ্যাও সবিস্তারে জানায় না আইডিএফ।
নোভা মিউজিক ফেস্টিভ্যালে হামাসের হামলায় ৫৮ ইসরায়েলি পুলিশ নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছিল আইডিএফ। এ ছাড়া হামাসের হামলার পাশাপাশি লেবানন সীমান্তেও হামলা হয়। মোট ১১৫ সেনা মারা যায়। কিন্তু লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ বলছে, এই সংখ্যা অনেক কম। তাদের হামলাতেই মারা গেছে অন্তত ৩৫ জন। আহত হয় ১৭২। কিন্তু এই সংখ্যা ১৯ জন বলে দাবি করে ইসরায়েল, যা আসল সংখ্যার অর্ধেক।
এই সেনাদের বয়সও কম। বেশির ভাগের বয়স ২০ বছরের নিচে। অনভিজ্ঞ সেনা পাঠাতে ইসরায়েল বাধ্য হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। একসময় ইসরায়েলি এক সেনা ৩৬ জন নিহতের তথ্য স্বীকারও করেছিলেন। কিন্তু বাহিনীর কয়েকজন বলেন, তারা আরও তথ্য জানেন। চাকরি হারানো ও গ্রেপ্তার এড়াতে সত্য জানাতে পারছেন না।
গত ১৮ নভেম্বর মাউন্ট হার্জ সামরিক সমাধির পরিচালক যে কথা বলেন, তা আরও সন্দেহজনক। ডেভিড ওরেন বারুচ নামের ওই ব্যক্তি বলেন, প্রতি ঘণ্টায় এখানে একাধিক শেষকৃত্য হচ্ছে। নতুন করে সমাধি বানাতে ব্যস্ত সময় পার করছে সবাই। আরও জায়গার দরকার। এমনও হয়েছে, ৪৮ ঘণ্টায় অর্ধশতাধিক শেষকৃত্য হয়েছে এখানে।
সামরিক নিয়ন্ত্রণ
সংঘাতে সেনা হতাহতের তথ্য প্রকাশ করতে অপারগ ছিল ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। গত ১০ ডিসেম্বর এই অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় তারা। কেননা হাসপাতালে নিহতের সংখ্যা ও সমাধিতে শায়িতের সংখ্যায় মিল ছিল না। সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, প্রতি ঘণ্টায় হাসপাতালে ঘুরতে দেখা যায় সামরিক বাহিনীর কাউকে না কাউকে। নিহতের সংখ্যা কত বলা হবে, তা তারা ঠিকঠাক করে দিয়ে যান।
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ইয়েদিওথ আদ্রোনথ গত ৯ ডিসেম্বর এক প্রতিবেদনে জানায়, পুনর্বাসন কেন্দ্রে প্রতিদিন ৬০ জনের বেশি আহত সেনা ভর্তি হচ্ছে। এ পর্যন্ত ২ হাজারের বেশি সেনা আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ গুরুতর আহত।এই সেনারা মারা গেলে সেসব তথ্য আর প্রকাশ করছে না আইডিএফ।
ইসরায়েলি বাহিনীর দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা অভিযানে কার্যত ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে গাজা উপত্যকা, নিহত হয়েছেন ২০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি। এই নিহতদের ৭০ শতাংশই নারী, শিশু, অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর-কিশোরী এবং বয়স্ক লোকজন। সেই সঙ্গে আহত হয়েছেন আরও ৫২ হাজার ৫৮৬ জন এবং এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ৬ হাজার ৭০০ জন। এ ছাড়া হাজার হাজার পরিবার বাড়িঘর-সহায় সম্বল হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন স্কুল, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল প্রাঙ্গণে।
হামাস এখনো লড়ে যাচ্ছে। তবে তাদের হাতে কতজন ইসরায়েলি সেনা মারা যাচ্ছে, তার সঠিক তথ্য কেউ প্রকাশ করছে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। খোদ ইসরায়েলি বাহিনীই করছে না। এ নিয়ে মার্কিন সামরিক কর্মকর্তাও নড়েচড়ে বসেছেন। এ কারণে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু নতুন কোনো চাপে পড়বেন কিনা—তা বোঝা যাচ্ছে না।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।