জুমবাংলা ডেস্ক : গেল পাঁচ আগষ্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর রাজনীতির মাঠে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করা জামায়াত ভোটের রাজনীতিতেও বেশ অ্যাক্টিভ। রাজনীতির সব আলোচনার ভিড়ে ‘বড় ফ্যাক্টর’ হিসেবে তৃণমূলে নাম আসছে দলটির। গেল এগারো মাসে দলের কেন্দ্রীয় আমীর ডা. শফিকুর রহমানের রংপুর অঞ্চলে একাধিকবার ‘ভোটে জিতিয়ে আসতে পারবে’ এমন আসনে পথসভা ও জনসভা করেছেন। এ নিয়ে এই অঞ্চলে ভোট রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রংপুরের এই জনসভা হবে এই বিভাগের নির্বাচনের জন্য টার্নিং পয়েন্ট।
এর আগে, দলের আমীর পৃথক পথসভা এবং জনসভা করলেও এবার বিভাগে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে বড় শোডাউনের অংশ হিসেবে রংপুর জিলা স্কুল মাঠে আগামীকাল শুক্রবার (৪ জুলাই) শুক্রবার বৃহৎ সমাবেশে অংশ নিচ্ছেন তিনি। এই সমাবেশে প্রধান বক্তা থাকবেন সদ্য কারামুক্ত কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য এটিএম আজহারুল ইসলাম।
দলটির পক্ষে দাবি করা হচ্ছে, সম্ভাব্য আসনগুলোতে দলীয় প্রার্থী জেতাতে দলের কর্মীদের উজ্জীবিত করার পাশাপাশি পুরো বিভাগের মানুষের মধ্যে দেশকে নিয়ে জামায়াতের পরিকল্পনা ও লক্ষ্য এসব বিষয়ে বার্তা পৌঁছে দেওয়া।
একই সঙ্গে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের জুলুম, নির্যাতন ও অবিচার জনগণকে অবহিতকরণ ও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নসহ মানবিক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এই জনসভা। এতে দুই লক্ষাধিক লোক সমাগমের টার্গেট নেওয়া হয়েছে।
দলের একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছেন, আওয়ামী দুঃশাসনের সময়ে স্থানীয় থেকে জাতীয় নির্বাচনে এই অঞ্চলে জামায়াত ভালো অবস্থানে ছিল। ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে তাদের প্রার্থী আওয়ামী লীগ জোটকে হটিয়ে ভোটে জিতিয়ে আসতে পেরেছিলেন।
দলটির তৃণমূল জরিপ অনুযায়ী, বিভাগের ৩৩টি আসনের মধ্যে ১৬টিতে জেতার সম্ভাবনা রয়েছে।
জানা গেছে, এই অঞ্চলে একচ্ছত্র দখলে রাখা জাতীয় পার্টি দলীয় কোন্দল-বিভক্তি, সাংগঠনিক দুর্বলতা, বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলোতে অংশগ্রহণসহ নানা কারণে আস্থার সংকটে পড়েছে। এমনকি জেলা, উপজেলাসহ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও সুবিধা করতে পারেনি। ক্রমেই এমন জনপ্রিয়তা হারিয়ে রংপুর বিভাগের পরিবর্তে রংপুর জেলাকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না জামায়াত।
সেই লক্ষে, তৃণমূলে মাঠ গোছাতে ব্যস্ত সময় পার করছে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। মাঠ বৈঠক, উঠান বৈঠকসহ ভোট প্রস্তুতির সাংগঠনিক সব কার্যক্রম পরিকল্পিতভাবেই এগিয়ে নিয়েছেন তারা।
তথ্য বলছে, ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর বিভাগের ৩৩টির বিপরীতে জাপার দখলে ছিল ১৭টি আসন। আওয়ামী লীগ ৯টি, বিএনপি একটি, সিপিবি তিনটি, জামায়াত একটি, বাকশাল ও ন্যাপ একটি করে আসন পায়। ১৯৯৬’র সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট আসন কমে ৩২টি হলেও রংপুর বিভাগে জাতীয় পার্টি পায় ২১টি আসন। আওয়ামী লীগ ৮, বিএনপি তিন ও জামায়াত পায় একটি করে। এরপর ছন্দপতন শুরু হয়। ২০০১ সালের নির্বাাচনে ইসলামী ঐক্য ফ্রন্টের সঙ্গে জোট করেও ২১ থেকে কমে ১৪টি আসন পায় জাতীয় পার্টি। আওয়ামী লীগ ৬টি, বিএনপি ৯টি ও জামায়াত পায় ৪টি আসন।
২০০৮’র নির্বাচনের আগে চারদলীয় ঐক্যজোটের বিপরীতে আওয়ামী লীগ-জাপার সমন্বয়ে গঠিত হয় মহাজোট গঠনে বিএনপি-জামায়াত কোণঠাসা হয়। ২০১৪ ও ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও সুবিধা করতে পারেনি বিএনপি-জামায়াত। তবে, সেই পরিস্থিতি বদলে গেছে।
জামায়াতের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, রংপুরের ৬টি আসনের মধ্যে রংপুর-১, রংপুর-২ ও রংপুর-৪ ও রংপুর-৫ আসনে অবস্থান ভালো হলেও ১, ২ ও ৫ আসন দখলে রাখতে চায়। কুড়িগ্রাম-১ (নাগেশ্বরী-ভুরুঙ্গামারী) ও কুড়িগ্রাম-৪ (চিলমারী-রৌমারী-রাবিজপুর), গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ), গাইবান্ধা-২ (সদর), গাইবান্ধা-৩ (পলাশবাড়ি-সাদুল্লাপুর), লালমনিরহাট-১ (পাটগ্রাম-হাতিবান্ধা), পঞ্চগড়-২, নীলফামারী জেলার চারটি আসনের মধ্যে নীলফামারী-৩ আসনে ১৯৮৬, ১৯৯৬ ও ২০২১ সালে নির্বাচিত হয় দলের প্রার্থী। এবারও নীলফামারী-১,নীলফামারী-২ ও নীলফামারী-৩, ঠাকুরগাও-২ (বালিডাঙ্গি-হরিপুর) এবং দিনাজপুরের ৬টি আসনের মধ্যে দিনাজপুর-১ (বীরগঞ্জ-কাহরোল) ,দিনাজপুর-৪ (চিরিরবন্দর-খানসামা) ও দিনাজপুর-৬ (বিরামপুর, নবাবগঞ্জ, ঘোরাঘাট ও হাকিমপুর) আসনে জিততে চায়। ইতোমধ্যে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।
দলীয় ও বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী, নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম ও দিনাজপুর এই পাঁচ জেলায় সব থেকে বেশী দলীয় প্রার্থী থাকার সম্ভাবনা রয়েছে তাদের। এর আগেও, গাইবান্ধা, নীলফামারী ও কুড়িগ্রামে তাদের সংসদ সদস্য ছিলেন। ভোটের লড়াইয়ে তীব্র প্রতিযোগীতায় ছিল রংপুরের মিঠাপুকুর. গংগাচড়া ও বদরগঞ্জ আসনে।
আওয়ামী লীগ জোটের পতনের পর প্রথম নীলফামারীতেই সমাবেশ করেন জামায়াত আমীর ডা. শফিকুর রহমান। সেখানেই দুইবার বৃহৎ সমাবেশ করে দলটি। এরপর দুই দিনের সফরে রংপুরের পাগলাপীর, মিঠাপুকুর, পীরগঞ্জ ও গাইবান্ধা এবং লালমনিরহাটে স্মরণকালের বৃহৎ সমাবেশ করে। এসব সমাবেশে আওয়ামী লীগের কড়া সমালোচনা, সরকারের দুঃশাসন, তাদের ওপর চলা নির্যাতন, সরকারের দুর্নীতির খতিয়ান তুলে ধরে সাধারণ মানুষকে জামায়াতের পক্ষে থাকার আহ্বান জানান।
জামায়াত নেতারা বলেন, দীর্ঘদিন বিনা কারণে আমাদের নেতাকর্মীরা নির্যাতিত নিষ্পেষিত। এরপরেও আমরা তৃণমূলে কাজ করেছি, এখনো করছি। আর আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টি চরম কোনঠাসায় পড়ার শঙ্কা আছে। আমরা অন্তত ১৬টি আসনে জেতার সক্ষমতা রাখি, সেই পরিকল্পনায় কাজ করছি।
রংপুর জেলা আমির অধ্যাপক গোলাম রব্বানী বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমালে জনসভা তো দূরের কথা প্রকাশ্যে কথা বলারও সুযোগ ছিল না। ১৬ বছর জুলুম নির্যাতনের পর ফ্যাসিস্টদের পতনে এ দেশের মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরেছে। এই স্বস্তিকে দেশগঠনের কাজে লাগাতে চাই। দেশের মানুষ এবারে ঐক্যবদ্ধ। বিগত সময়ে ভোট দিতে পারেন এ দেশের মানুষ। তাই দাঁড়ি পাল্লা মার্কায় ভোট দিতে মুখিয়ে আছেন। এবারে দেশের মানুষ পছন্দের মার্কায় ভোট দিতে পারবে বলে বিশ্বাস করি। রংপুর বিভাগের এই জনসভায় লোক সমাগমই প্রমাণ করে দিবে জামায়াতের জনপ্রিয়তা। জামায়াতের ভোট ব্যাংক।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল ও রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চল পরিচালক মাওলানা আবদুল হালিম জানান, এই জনসভাকে কেন্দ্র করে পুরো রংপুর বিভাগের জামায়াতের নেতাকর্মীদের মাঝে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে। এই স্পিরিটকে কাজে লাগিয়ে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফলাফল ঘরে তোলা হবে। আমরা আশা রাখি বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের ৩৩টি আসনে এখানকার জনগণ ন্যায়-ইনসাফের পক্ষে তাদের প্রত্যাশিত রায় দেবে। আমরা ৩৩টি আসনেই আমাদের প্রার্থী ঘোষণা করেছি। সবগুলো আসনেই জেতার জন্য আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
জনসভার প্রস্তুতি
রংপুর বিভাগীয় জনসভা বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব কেএম আনোয়ারুল হক কাজল জানান, বিভাগীয় জনসভা সফল করতে ইতোমধ্যে সবধরনের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। ১৩টি টিম কাজ করছে রাত-দিন। জনসভা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নের জন্য কেন্দ্র এবং জেলা মহানগর জামায়াতের নির্দেশনায় সকল ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। রংপুর জিলা স্কুল মাঠে বিশাল মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। মাঠের ভেতরে প্রবেশের জন্য নতুন দুটি গেট প্রবেশপথ তৈরি করা হয়েছে। তাছাড়া নারীদের পর্দার সঙ্গে বক্তব্য শোনার জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে।
জনসভায় প্রধান অতিথি থাকবেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। প্রধান বক্তা থাকবেন সদ্য কারামুক্ত কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য এটিএম আজহারুল ইসলাম। বিশেষ বক্তা হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, মাওলানা আব্দুল হালিম, ঢাকা দক্ষিণের আমীর নুরুল ইসলাম বুলবুল, উত্তরের আমীর মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ মাওলানা মমতাজ উদ্দিন, অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান। এছাড়াও জামায়াতের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা বক্তব্য দেবেন জনসভায়।
জামায়াতের বৃহৎ এই সমাবেশকে ঘিরে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিয়েছে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ। আজ বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) বিকাল ৪টার দিকে জনসভাস্থল পরিদর্শন করেন পুলিশ কমিশনার মজিদ আলীসহ পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
পুলিশ কমিশনার জানান, সমাবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সব ধরণের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। চার স্তরের নিরাপত্তা আছে। আশা করছি সুষ্ঠুভাবেই সমাবেশ শেষ হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।