ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আসন সমঝোতা করতে গিয়ে সংকটে পড়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি অংশ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম রাজনৈতিক পর্ষদের একজন সদস্য ইতিমধ্যে পদত্যাগপত্রও জমা দিয়েছেন।

জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির সমঝোতার বিষয়টি অনেকটাই চূড়ান্ত হওয়ার পর গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় দল থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন তাসনিম জারা। তিনি দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব ও রাজনৈতিক পর্ষদের সদস্য ছিলেন। এর আগে গত বৃহস্পতিবার দলটি থেকে পদত্যাগ করেন এনসিপিতে জামায়াতবিরোধী অংশের নেতা হিসেবে পরিচিত মীর আরশাদুল হক।
গতকাল সন্ধ্যায় দলের ৩০ জন নেতা এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে ‘সম্ভাব্য জোট বিষয়ে নীতিগত আপত্তি’ বিষয়ে একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন। তাতে তাঁরা বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে কোনো ধরনের জোট এনসিপির নৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করবে এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ ধরনের জোট এনসিপির বহু কর্মী, সমর্থক এবং বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মসহ নতুন ধারার রাজনীতিকে সমর্থন করা বহু সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ও হতাশা তৈরি করবে। এর মাধ্যমে এনসিপির নিজস্ব মধ্যপন্থী রাজনৈতিক এজেন্সি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
‘মধ্যপন্থী রাজনীতির’ কথা বলে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি এনসিপির আত্মপ্রকাশ ঘটে। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক আলোচনা শুরু হলে গত অক্টোবর থেকে তারা প্রথমে বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতার আলোচনা শুরু করে।
নাহিদ ইসলামকে অনুরোধ জানিয়ে ওই ৩০ নেতা বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক জোটে না যাওয়ার বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করা হোক। আমরা মনে করি, নীতিগত অবস্থানের ভিত্তিতে কৌশল নির্ধারিত হওয়া উচিত। কৌশলগত কারণে নীতিগত অবস্থান বিসর্জন দেওয়া উচিত নয়।’
এই চিঠিতে স্বাক্ষরকারী নেতাদের মধ্যে আছেন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ, নুসরাত তাবাসসুম, যুগ্ম সদস্যসচিব মুশফিক উস সালেহীন, এস এম সাইফ মোস্তাফিজ, যুগ্ম মুখ্য সংগঠক সাদিয়া ফারজানা দিনা, যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল্লাহ আল ফয়সাল, উত্তরাঞ্চলের সংগঠক দ্যুতি অরণ্য চৌধুরী, সদস্য তাওহীদ তানজীম ও সৈয়দা নীলিমা দোলা।
‘মধ্যপন্থী রাজনীতির’ কথা বলে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি এনসিপির আত্মপ্রকাশ ঘটে। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক আলোচনা শুরু হলে গত অক্টোবর থেকে তারা প্রথমে বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতার আলোচনা শুরু করে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে এনসিপির শীর্ষ নেতৃত্বের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে একাধিকবার আলোচনা হয়। তবে চাওয়া–পাওয়া নিয়ে শেষ পর্যন্ত বোঝাপড়া হয়নি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফেরার পর তাঁর সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করা যায় কি না, সে চেষ্টাও ছিল। তবে সেটা আর হয়ে ওঠেনি।
বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে আসন সমঝোতার এই প্রচেষ্টায় এনসিপির পাশাপাশি এবি পার্টির নামও আলোচনায় এসেছে। কিন্তু তাদের জোটের আরেক শরিক রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন জামায়াত বা বিএনপির সঙ্গে যেতে রাজি নয়।
এরই মাঝে বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে আলাদা জোট গঠনের চিন্তা থেকে মধ্যপন্থী আলাদা জোট করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই উদ্যোগে গণতন্ত্র মঞ্চকে যুক্ত করার প্রচেষ্টা ছিল। পরে কেবল এনসিপি, এবি পার্টি ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ে জোট হয়। ‘গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট’ নামে ৭ ডিসেম্বর এই ত্রিদলীয় জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
কিন্তু ভোটের রাজনীতির হিসাব–নিকাশ মেলাতে গিয়ে এনসিপি বড় দুই দলের কোনো একটির সঙ্গে আসন সমঝোতাকে গুরুত্ব দেয়। বিএনপির সঙ্গে সমঝোতার সম্ভাবনা কমে আসার পর সম্প্রতি এনসিপি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আলোচনায় যুক্ত হয়। এরপর সদ্য গঠিত ত্রিদলীয় জোটও ভাঙনের মুখে পড়েছে। বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে আসন সমঝোতার এই প্রচেষ্টায় এনসিপির পাশাপাশি এবি পার্টির নামও আলোচনায় এসেছে। কিন্তু তাদের জোটের আরেক শরিক রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন জামায়াত বা বিএনপির সঙ্গে যেতে রাজি নয়।
সমঝোতা প্রায় চূড়ান্ত
এদিকে জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির সমঝোতা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে বলে জানিয়েছেন দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দুজন নেতা। তাঁরা গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির সঙ্গে আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। জামায়াতের সঙ্গেও বিভিন্ন সময়ে কথা হয়েছিল। তবে সম্প্রতি জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতার আলোচনা একটা উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে আসে। ভোটের রাজনীতির নানা দিক বিবেচনা করে এনসিপির শীর্ষ নেতৃত্ব জামায়াতের সঙ্গেই সমঝোতায় যাওয়ার নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেন।
এনসিপির নেতা ও আগামী নির্বাচনে একজন সম্ভাব্য প্রার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ইতিমধ্যে তাঁকে জানিয়েছেন, জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতায় যাওয়ার বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত।
সংশ্লিষ্ট অপর একটি সূত্র জানায়, আসন সমঝোতা নিয়ে গত শুক্রবার রাতেও ঢাকায় জামায়াতের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সঙ্গে এনসিপির প্রতিনিধিদের বৈঠক হয়। সেখানে আসন বণ্টন নিয়েও আলোচনা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন গতকাল বিকেলে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সংস্কার বাস্তবায়নকে প্রধানত গুরুত্ব দিয়ে এনসিপি ও জামায়াতের সমঝোতার আলোচনা চলমান। কিছু রাজনৈতিক প্রশ্ন, করণীয় ও পারিপার্শ্বিক বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা হচ্ছে। এ ছাড়া সম্ভাব্য আসনবিন্যাস নিয়েও আলোচনা হচ্ছে।’
৩০ আসন নিয়ে আলোচনা
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এনসিপির পক্ষ থেকে জামায়াতের কাছে ৫০টি আসন চাওয়া হয়েছিল। জামায়াত ৩০টি আসনে ছাড় দেওয়ার কথা বলেছে। আলোচনার পর এনসিপি বিষয়টি অনেকটা মেনে নিয়ে সম্ভাব্য ৩০ জন প্রার্থীর একটি খসড়া তালিকাও তৈরি করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সমঝোতা আনুষ্ঠানিকভাবে চূড়ান্ত হলে ঢাকা-১১ আসনে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও রংপুর-৪ আসনে দলের সদস্যসচিব আখতার হোসেন ছাড় পাবেন। কেন্দ্রীয় অন্য নেতাদের মধ্যে কুমিল্লা-৪ আসনে হাসনাত আবদুল্লাহ, পঞ্চগড়-১ আসনে সারজিস আলম, ঢাকা-১৬ আসনে আরিফুল ইসলাম আদীব, ঢাকা-১৮ আসনে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী এবং নোয়াখালী-৬ আসনে আবদুল হান্নান মাসউদ জামায়াতের সমর্থন পেতে পারেন। আরও যেসব আসনে জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা চূড়ান্ত হতে যাচ্ছিল, তার মধ্যে ঢাকা-৯ আসনে তাসনিম জারার নামও ছিল। এরই মধ্যে তাসনিম জারা গতকাল সন্ধ্যায় দল থেকে পদত্যাগ করে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করার ঘোষণা দেন। একই সময়ে ৩০ নেতা জামায়াত প্রশ্নে দলীয় প্রধানকে স্মারকলিপি দেন। এর মধ্য দিয়ে জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা প্রশ্নে এনসিপিতে নতুন সংকটের প্রকাশ পায়।
জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির সম্ভাব্য সমঝোতার আলোচনায় প্রার্থী হিসেবে আসিফ মাহমুদের নামও রয়েছে বলে জানা গেছে।
আসিফের নাম আছে, মাহফুজের নেই
এদিকে এনসিপির একজন দায়িত্বশীল নেতা জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার এনসিপিতে যোগদান নিয়ে আলোচনা চলছে। গত ৯ নভেম্বর তিনি ঢাকা-১০ সংসদীয় আসনের ভোটার হওয়ার জন্য আবেদন করেন। ২২ ডিসেম্বর তিনি এই আসনের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। গতকাল শনিবার কুমিল্লা-৩ আসন থেকেও তাঁর পক্ষে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন এক ব্যক্তি। জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির সম্ভাব্য সমঝোতার আলোচনায় প্রার্থী হিসেবে আসিফ মাহমুদের নামও রয়েছে বলে জানা গেছে।
তবে এই আলোচনায় মাহফুজ আলমের নাম নেই। সদ্য পদত্যাগ করা এই উপদেষ্টা নির্বাচন করবেন কি না, করলে কোনো দল থেকে করবেন নাকি স্বতন্ত্রভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন—এসব বিষয়ে গতকাল পর্যন্ত নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি।
১০ ডিসেম্বর এনসিপি ১২৫টি সংসদীয় আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছিল। বাকি আসনগুলোতে এনসিপি প্রার্থী দেয়নি। তবে জামায়াতের সঙ্গে আসন সমঝোতায় গেলে নির্ধারিত ৩০টির বাইরে অন্যান্য আসনে এনসিপি প্রার্থী দেবে না বলে দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা জানিয়েছেন।
সূত্র: প্রথম আলো
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



