দীপেন ভট্টাচার্য : মানুষের বিজ্ঞানভাবনার প্রকৌশলগত প্রয়োগ যে কত উন্নত হতে পারে, তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি জেনেভায় অবস্থিত লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারে (LHC), যেখানে হিগস কণা আবিষ্কার করা হয়েছে কিংবা লাইগো ডিটেক্টরে যেখানে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ নিরূপিত হয়েছে। এই বছর মহাকাশে স্থাপিত হতে যাচ্ছে জেমস ওয়েব দুরবিন, যা কিনা এই জটিল প্রকৌশলের ধারাকেই বজায় রাখবে। দুরবিনটির নাম দেওয়া হয়েছে ১৯৬১ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত নাসার পরিচালক জেমস ওয়েবের নামে, যাঁর অধীনে চন্দ্রাভিমুখী অ্যাপোলো প্রোগ্রাম সাফল্য লাভ করে। ১৯৯৬ সালে হাবল-পরবর্তী একটি দুরবিনের ভাবনা শুরু হয়, ভাবা হয়েছিল, ৫০০ মিলিয়ন ডলারে এটি বাস্তবায়িত করা যাবে, ২৫ বছর পর এটির বাজেট ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। অনেক জ্যোতির্বিদ তাই এই দুরবিনের নাম দিয়েছেন ‘দুরবিন, যা জ্যোতির্বিদ্যাকে খেয়ে ফেলেছে। কারণ, এটির ফান্ডিং করতে গিয়ে জ্যোতির্বিদ্যার বাকি অংশগুলো কোনো সাহায্য পাচ্ছে না। তবু এই দুরবিনকে যদি উদ্দিষ্ট জায়গায় স্থাপন করে সেটিকে যথাযথভাবে পরিচালনা করা যায়, তবে সেটি আমাদের মহাজাগতিক জ্ঞানকে বর্ধিত করবে বহুগুণ, তখন ১০ বিলিয়ন ডলারের খরচ হয়তো অন্য জ্যোতির্বিদেরা মেনে নেবেন।
১৯৯০-এর দশকে হাবল দুরবিন যখন পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে মহাবিশ্বের দূরতম প্রান্তের গ্যালাক্সিগুলোর প্রতিচ্ছবি ধারণ করছিল, তখন থেকেই বিজ্ঞানীরা আরেকটি দুরবিনের কথা ভাবছিলেন, যেটি হাবল যে দূরত্ব বা যে সময় পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে, তার চেয়েও দূরবর্তী গ্যালাক্সি আবিষ্কার করতে পারবে। ব্যাপারটি সহজ নয়। কারণ, মনে রাখতে হবে যে হাবল বা জেমস ওয়েব যে দূরত্বের গ্যালাক্সির প্রতিচ্ছবি ধারণ করতে চাইছে, সেই সময় গ্যালাক্সিগুলো সবে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। বিগ ব্যাং হওয়ার পর কয়েক লাখ বছর ধরে মহাবিশ্বের ঘনত্ব এত বেশি ছিল যে আলোর কণা, অর্থাৎ ফোটন, মুক্ত ইলেকট্রন কণার সঙ্গে ক্রমাগতই বিচ্ছুরিত হয়ে (আঘাত করে) প্রোটন কণার দঙ্গল থেকে বের হতে। পারছিল না। চার লাখ বছর পর মহাবিশ্ব প্রসারণের ফলে তুলনামূলকভাবে ঠান্ডা হলে (৩০০০ কেলভিনের মতো), ইলেকট্রন প্রোটনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গড়ে তুলত পারল আধানবিহীন নিউট্রাল হাইড্রোজেন পরমাণু, যা কিনা ফোটন কণার সঙ্গে তুলনামূলকভাবে কম বিক্রিয়া করে। এভাবে ফোটন বস্তুকণা থেকে মুক্ত হলো এবং সেই ফোটনগুলোকে আমরা দেখি মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমি (CMB) হিসেবে। আমরা যেদিকেই তাকাই না কেন, এই ফোটন পটভূমি আমাদের ঘিরে রেখেছে।
এরপর মহাবিশ্ব আরও দ্রুত শীতল হতে থাকল এবং প্রথম দিকের তারাগুলোর সৃষ্টি হলো। এগুলো মূলত অতিবেগুনি বা আলট্রাভায়োলেট আলোয় উজ্জ্বল ছিল। সেই বর্ণালির আলো চারপাশের নিউট্রাল হাইড্রোজেন পরমাণু খুব সহজেই শোষণ করে নিতে পারত। এর ফলে এসব প্রথম দিককার তারা আমাদের কাছে অদৃশ্য থাকার কথা, এই সময়কে অনেক জ্যোতির্বিদ ‘অন্ধকার যুগ’ নাম দিয়েছেন। কিন্তু একই সঙ্গে হাইড্রোজেন পরমাণু এই উচ্চ শক্তির আলো দিয়ে আয়নিত হয়ে যেতে থাকে, অর্থাৎ ইলেকট্রন খুইয়ে তার শুধু প্রোটন থাকে। এই আয়নিত হাইড্রোজেন বা প্রোটন আলো শোষণ করতে পারে না। এর ফলে বিগ ব্যাংয়ের প্রায় ৩০০ মিলিয়ন বা ৩০ কোটি বছর পর এসব তারা বা সেগুলো দিয়ে গঠিত গ্যালাক্সিগুলো দৃশ্যমান হতে পারে। তবে এর আগে নিউট্রাল হাইড্রোজেন সেসব আলোর তরঙ্গই শোষণ করে নেবে তা-ই নয়, কিছু উচ্চ শক্তির তরঙ্গ শোষিত হবে না এবং জেমস ওয়েব দুরবিনের সেগুলোকে শনাক্ত করার সম্ভাবনা আছে। অর্থাৎ ‘অন্ধকার যুগের’ সময়ের তারা বা গ্যালাক্সি দেখার একটা সম্ভাবনা আছে।
হাবল দুরবিন দিয়ে সবচেয়ে দূরবর্তী যে গ্যালাক্সি আবিষ্কার করা গেছে, তার নাম হলো GN-211। এটির লাল সরণ বা রেড শিফট পাওয়া গেছে ১১-এর কাছাকাছি। অর্থাৎ কার্বন পরমাণু থেকে নির্গত ০.১৯ মাইক্রোমিটারের অতিবেগুনি বর্ণালি রেখা আমরা শনাক্ত করছি ২.২৮ মাইক্রোমিটার অবলোহিত বা ইনফ্রারেড তরঙ্গে। আধুনিক সময়ের মহাজাগতিক মডেল অনুযায়ী গ্যালাক্সিটি থেকে আলো বিগ ব্যাংয়ের ৪০০ মিলিয়ন বছর পর নির্গত হয়েছে এবং আমাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে দীর্ঘ ১৩.৩ বিলিয়ন বছর চলার পর। বোঝাই যাচ্ছে, যত দূরের গ্যালাক্সি হবে, তার লাল সরণ তত বেশি হবে এবং অতিবেগুনি তরঙ্গ অবলোহিত তরঙ্গদৈর্ঘ্যে দেখা দেবে। কাজেই দুরবিনগুলোর অবলোহিত তরঙ্গে সংবেদী হতে হবে। হাবল দুরবিনের NICMOS ক্যামেরা ০.৮ থেকে ২.৪ মাইক্রোমিটারে কাজ করছে, কিন্তু আরও দূরবর্তী গ্যালাক্সির জন্য দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ডিটেক্টর দরকার—জেমস ওয়েব দুরবিনের তরঙ্গ বিস্তার হবে ০.৬ থেকে ২৮.৫ মাইক্রোমিটার।
জেমস ওয়েব দুরবিনের প্রাথমিক আয়নার ব্যাস হবে ৬.৫ মিটার, হাবলের ছিল ২.৪ মিটার। এর ফলে নতুন দুরবিনের ক্ষেত্রফল হাবলের সাত গুণ বেশি হবে, অর্থাৎ এটির আয়নাতে তারা বা গ্যালাক্সির আলো অনেক বেশি পরিমাণে প্রতিফলিত হবে। ০.৬ থেকে ২৮.৫ মাইক্রোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যে জেমস ওয়েব দূরবিন ওয়েব হাবল, জেমিনি, সোফিয়া, স্প্রিংজার ইত্যাদি অবলোহিত দুরবিন থেকে ১০ থেকে ১০ হাজার গুণ বেশি সংবেদনশীল হবে। বলা হচ্ছে যে চাঁদের দূরত্বে রাখা একটি মৌমাছি থেকে বিচ্ছুরিত তাপ এই দুরবিন শনাক্ত করতে পারবে। কিন্তু এই সাফল্য অর্জন করতে জেমস ওয়েব দুরবিনের জন্য বেশ কয়েকটি দুরূহ প্রকৌশলগত উদ্ভাবন করতে হয়েছে, নিচে একে একে সেইগুলো লিখছি।
প্রথমত, জেমস ওয়েব দুরবিনটিকে স্থাপন করা হবে পৃথিবী থেকে অনেক দূরে— L2 ল্যাগ্রাঞ্জ বিন্দুতে। ১৭৭২ সালে ইতালীয় বিজ্ঞানী জোসেফ-লুই ল্যাগ্রাঞ্জ গণনা করে বের করলেন যে একটি সিস্টেমে যদি দুটি বড় বস্তু মাধ্যাকর্ষণের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে, তবে সেখানে পাঁচটি বিন্দু পাওয়া যাবে। সেখানে তৃতীয় কোনো বস্তু রাখলে অপর দুটির তুলনায় সেটি একই স্থানে স্থিত থাকবে। L2 বিন্দুটি হলো পৃথিবীর পেছনে, সূর্য থেকে দূরে, মনে হতে পারে ওই বিন্দুতে কোনো কিছু রাখলে তার গতিবেগ পৃথিবী থেকে কম হবে, কিন্তু সূর্য ও পৃথিবীর যৌথ আকর্ষণ ওই বিন্দুকে পৃথিবীর সঙ্গেই সূর্যের চারদিকে ভ্রমণ করায়। সবকিছু ঠিক থাকলে ১৮ ডিসেম্বর ২০২১-এ দুরবিনটি দক্ষিণ আমেরিকার ফ্রেঞ্চ গায়ানা থেকে একটি Arianne 5 রকেট মাধ্যমে উৎক্ষেপণ করা হবে এবং L2 বিন্দুর কাছাকাছি পৌঁছাতে প্রায় এক মাস সময় লাগবে। তবে জেমস ওয়েব L2 বিন্দুতে স্থিত থাকবে না, L2 থেকে কয়েক লাখ কিলোমিটার দূরে থেকে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করবে। দুরবিন-উপগ্রহের ছোট রকেট ইঞ্জিন ব্যবহার করে এটিকে এমন কক্ষপথে রাখা হবে, তাতে মনে হতে পারে সেটি 1.2 বিন্দুকে প্রদক্ষিণ করছে।
পৃথিবী থেকে এত দূরে থাকার কারণে দুরবিনটি কাজ না করলে নভোচারী পাঠিয়ে সেটিকে ঠিক করার কোনো উপায় নেই। তবে L2 নিয়ে জ্যোতির্বিদদের ভালো অভিজ্ঞতা আছে। নাসার মাইক্রোয়েভ শনাক্ত করার দুরবিন W হার্শেল, গায়া (GAIA), প্ল্যাঙ্ক ইত্যাদি দুর করা হয়।
আগেই উল্লেখ করেছি, জেমস ওয়েব একটি অবলোহিত তরঙ্গের দুরবিন, অবলোহিত তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ করতে হলে দুরবিনটিকে যতটা সম্ভব ঠান্ডা রাখতে হবে ৫০ কেলভিনের মতো তাপমাত্রায়। অবলোহিত তরঙ্গ হলো তাপ তরঙ্গ, যেকোনো বস্তু অবলোহিত তরঙ্গে বিকিরণ করে, এই ক্ষেত্রে দুরবিনটি এবং সেগুলোর ডিটেক্টর যন্ত্র থেকেও বিকিরণ বের হবে, সেই বিকিরণের মাত্রা কমাতে শীতলতার প্রয়োজন। হাবল দুরবিন পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৫৭০ কিলোমিটার ওপরে ভ্রমণ করে, এই উচ্চতায় তাপ বিকিরণ করে কোনো দুরবিনকে ঠান্ডা রাখা মুশকিল। অন্যদিকে 1.2 বিন্দুতে পৃথিবী ও সূর্য একই দিকে থাকবে, এর ফলে জেমস ওয়েব দুরবিনের জন্য একদিকের পুরোটা আকাশই খোলা থাকবে, শুধু সূর্য ও পৃথিবীর তাপ এড়ানোর জন্য সেটির একটি সৌরতাপীয় ঢাল বা সানশিল্ড লাগবে। তাপীয় ঢাল নিয়োজিত করা একটি কঠিন ব্যাপার, কিন্তু তার আগে প্রকৌশলগতভাবে আরেকটি কঠিন পদ্ধতি নিয়ে কিছু বলি। জেমস ওয়েব দুরবিনটির ফোকাসে MIRI (Mid-infrared instrument) নামে একটি ডিটেক্টর আছে, যেটি ৫ থেকে ২৮ মাইক্রোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যে কাজ করে। এই ডিটেক্টর হলো একটি সিলিকন-আর্সেনিকের যৌগ, যেটিকে ঠিকমতো কাজ করাতে হলে ৫০ কেলভিন নয়, পরম শূন্যতার মাত্র ৭ কেলভিন ওপরের তাপমাত্রা বজায় রাখতে হবে। এর জন্য হিলিয়াম গ্যাস ব্যবহার করে সক্রিয় একটি হিমায়ক (ক্রায়োকুলার) কাজ করবে, কিন্তু সেই হিমায়ক আবার কিছুটা কম্পনের সৃষ্টি করবে এবং সেই কম্পনকে থামানোর জন্য বিজ্ঞানীদের আবার বিশেষ প্রকৌশল উদ্ভাবন করতে হয়েছে।
সৌরতাপের বিরুদ্ধে ঢালটির আকার হলো ১৪×২১ বর্গমিটার—একটি টেনিস কোর্টের সমান। এটি ক্যাপটন নামে একধরনের রাসায়নিক ফিল্ম দিয়ে তৈরি, যা কিনা সহজেই তাপ শোষণ ও বিকিরণ করতে পারে। জেমস ওয়েবের তাপীয় ঢালটি পাঁচটি পাতলা স্তর দিয়ে তৈরি, প্রতিটি স্তর একটি মানব চুলের চেয়েও চিকন। এই ঢালকে ১২ বার ভাঁজ করে রকেটে ঢোকানো হবে এবং শুধু L2 বিন্দুতে পৌঁছানোর পর ঢালটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মোটর দিয়ে ধীরে ধীরে খোলা হবে। এই ঢালের ওপর জেমস ওয়েব দুরবিনের সাফল্য নির্ভর করছে, যদি কোনো কারণে মোটর আটকে যায় এবং ঢালটি পুরোপুরি খোলা না যায়, তবে দুরবিনটি কোনো কাজেই লাগবে না। এ তো গেল সৌরতাপ থেকে মুক্ত রাখার ঢালের কথা। এবার আসি দুরবিনের মূল অংশ—আয়নাতে। জেমস ওয়েবের আয়না কাচের নয়, বরং বেরেলিয়ামের এবং তার ওপর একটি খুবই সূক্ষ্ম চিকন সোনার প্রলেপ দেওয়া। বেরেলিয়ামকে বাছাই করা হয়েছে, কারণ, সেটি হালকা, কিন্তু অনমনীয়। এ জন্য জেমস ওয়েব দুরবিনের সামগ্রিক ভর হাবল থেকে কম। বেরেলিয়ামের ওপর সোনার প্রলেপের কারণ হলো সোনা অবলোহিত তরঙ্গ খুব দক্ষতার সঙ্গে প্রতিফলিত করতে পারে। ১৮টি ষড়ভুজাকৃতি ১.৩২ মিটার আকারের আয়নার অংশ একসঙ্গে যুক্ত হয়ে ৬.৫ মিটার ব্যাসের একটি পূর্ণাঙ্গ আয়না তৈরি করবে। এত বড় ব্যাসের আয়না তো রকেটে ঢোকানো যাবে না, কাজেই ১৮টি ছোট আয়নাকেও ভাঁজ করে L2 বিন্দুতে পাঠানো হবে, যেখানে সেগুলোকে একত্র করে বড় আয়নাটি গঠন করা হবে। সৌর তাপীয় ঢালটি খোলার মতো এটিও একটি প্রকৌশলগত কঠিন কাজ।
জেমস ওয়েবের দুরবিনকে বলা হচ্ছে তিন আয়নার Anstigmat। এটি প্রতিবিম্ব গঠনের তিনটি ত্রুটি (বা অপেরণ) ঠিক করে। একটি হলো গোলাপেরণ বা স্ফেরিকাল অ্যাবারেশন। যদি আয়নাটি গোলীয় হয়, তবে সেটির প্রধান অক্ষের সঙ্গে সমান্তরাল আলো প্রধান অক্ষের বাইরে কোনো বিন্দুতে প্রতিফলিত হলে প্রধান অক্ষের ফোকাসে না পড়ে অন্য জায়গায় পড়তে পারে। এর ফলে প্রতিবিম্বটি বিস্তৃত হয়ে পড়ে। প্রাথমিক বা মূল আয়নাটি গোলীয় না করে অধিবৃত্তীয় বা প্যারাবোলিক করা যায়, এতে গোলাপেরণ থেকে মুক্ত থাকা গেলেও কোমা ও অ্যাস্টিগমাটিজম থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব নয়। কোমা হলো যখন দূর নক্ষত্রের আলো আয়নার প্রধান অক্ষের সঙ্গে সমান্তরাল না হয়ে আয়নার ওপর আপতিত হয় এবং সব প্রতিবিম্বিত আলো আবার মূল ফোকাস বিন্দুতে মিলিত হয় না। আর অ্যাস্টিগমাটিজম হলো যখন উল্লম্ব ও অনুভূমিকভাবে আপতিত রশ্মিগুলো ভিন্ন ভিন্নভাবে ফোকাস বিন্দুর আশপাশে এসে মেলে। জেমস ওয়েব দুরবিনটি ওপরের তিনটি ত্রুটিই সংস্কার করেছে মূল আয়নাটিকে তিনটি অংশে ভাগ করে।
এবার জেমস ওয়েব দুরবিনের ডিটেক্টরগুলো নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। এর চারটি নিরূপক যন্ত্রের মধ্যে একটি মধ্য অবলোহিত তরঙ্গের (৫ থেকে ২৮ মাইক্রোমিটার) MIRI ডিটেক্টরকে নিয়ে আগেই বলেছি যে সেটিকে খুবই শীতল তাপমাত্রায় রাখা দরকার। এটির অতি দূরের খ-গোল বস্তু শনাক্ত করা ছাড়াও আমাদের সৌরজগতের বাইরে বহিঃগ্রহ আবিষ্কারের এবং মোটা মাত্রায় কিছুটা বর্ণালি বিশ্লেষণের ক্ষমতা আছে। বহিঃগ্রহ আবিষ্কারের জন্য MIRI করোনাগ্রাফ নামে একটি পদ্ধতি ব্যবহার করবে, যেটি কেন্দ্রীয় তারাটির আলো মাস্ক দিয়ে ঢেকে দিয়ে তারাটির কক্ষপথের গ্রহ থেকে বিকিরিত অবলোহিত তরঙ্গের খোঁজ করবে।
NIRCam (Near Infrared Imager) কাজ করবে ০.৬ থেকে ৫ মাইক্রোমিটার পর্যন্ত। ০.৬ মাইক্রোমিটার হলো ৬০০ ন্যানোমিটার, যা কিনা লাল-কমলা আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য, কাজেই এই ডিটেক্টর দৃশ্যমান আলোয় ছবি তুলতে সক্ষম হবে। NIRCam এর প্রথম কাজটি হলো জেমস ওয়েব দুরবিনটি কক্ষপথে স্থাপন করার পর উজ্জ্বল নক্ষত্র থেকে আগত আলোকতরঙ্গের দশা নির্ধারণ করে আয়নাটির ১৮টি অংশকে একীভূত করা (যাতে ১৮টি ভিন্ন ভিন্ন প্রতিবিম্ব না সৃষ্টি হয়)। প্রতিটি ছোট আয়নার পেছনে বেশ কয়েকটি মোটর (Actuator) এই কাজ সমাধা করবে। এর ফলে পুরো আয়নার তলটির একটি অংশ আরেকটি অংশ থেকে খুব বেশি হলে কয়েক ন্যানোমিটার কমবেশি হতে পারে (আমাদের চুলের প্রস্থ ২৫ হাজার ন্যানোমিটারের মতো)। এই ডিটেক্টরও প্রথম সৃষ্ট খ-গোল বস্তুগুলোকে নিরীক্ষণ করবে, এ ছাড়া অন্য সৌরজগৎ সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে গুরুত্ব দেবে। NIRCam পারদ ক্যাডমিয়াম-টেলুরাইড (HgCdTe) যৌগ দিয়ে তৈরি একটি ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলবে, কিন্তু সেটির পূর্বে আলোকরেখাকে ফোকাস করার জন্য লিথিয়াম ফ্লোরাইড, বেরিয়াম ফ্লোরাইড ও জিংক সেলেনাইডের লেন্স ব্যবহার করবে।
NIR Spec (Near Infrared Spectrograph) ডিটেক্টরটির কাজ হবে ০.৬ থেকে ৫ মাইক্রোমিটার পর্যন্ত আগত তরঙ্গের বর্ণালি বিশ্লেষণ। ১ ন্যানোমিটারেরও কম সূক্ষ্মতায় ১০০টি খগোল বস্তুর বর্ণালি এটি সমান্তরালভাবে তৈরি করতে পারে। চতুর্থ নিরূপক যন্ত্রটি হলো FGS NIRISS (Fine Guidance Sensor and Near Infrared Imager and Slitless Spectrograph)। এটির একটি কাজ কোনো নির্দিষ্ট তারাকে দৃষ্টিগোলকের মধ্যে রেখে সেই তথ্যকে জেমস ওয়েব উপগ্রহটির ACS (Attitude Control System) ব্যবস্থাকে জানানো, যাতে দুরবিনটি আকাশের একটি নির্দিষ্ট দিকে স্থিত করা যায়।
মহাশূন্যে স্থাপিত দুরবিনটিকে যথাযথভাবে পরিচালনার জন্য একটি ইলেকট্রনিক ব্যবস্থা দরকার, যাকে ‘বাস’ (Bus) বলা হয়। এটির কাজ হলো ১. সমস্ত বৈদ্যুতিক শক্তি বিতরণের ব্যবস্থা করা, ২. উপগ্রহটির দিক নির্ধারণ ও পরিবর্তন করা (Attitude control), ৩. ডিটেক্টর যন্ত্র থেকে তথ্য আহরণ করা, ৪. পৃথিবীর সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করা, ৫. উপগ্রহের ছোট রকেট ব্যবস্থা পরিচালনা করা এবং ৬. সামগ্রিক তাপ নিয়ন্ত্রণ করা। বাসটিকে উপগ্রহের যে দিকটা সূর্যের দিকে মুখ করা, সেদিকে স্থাপন করা হবে, এটি ৩০০ কেলভিন তাপমাত্রায় কাজ করবে। বাসটির কম্পিউটারে মাত্র ৬০ গিগাবাইট সলিড স্টেট মেমোরি আছে। আমাদের কাছে এটা খুব কম মেমোরি মনে হতে পারে, কিন্তু মনে রাখতে হবে জেমস ওয়েব দুরবিনের ওপর অন্তত ২০ বছর ধরে কাজ হচ্ছে, কাজেই ব্যবস্থাপকদের কী ধরনের কম্পিউটার ব্যবস্থা হবে, সেটা অনেক আগে থেকেই নির্ধারণ করতে হয়েছে এবং সেটা সেই সময়ের প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে। এ ছাড়া এ ধরনের মেমোরির মহাশূন্যের উচ্চ শক্তির কণা-বিকিরণের ধ্বংসাত্মক আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে হবে, যেটা ওই ৬০ গিগাবাইট মেমোরির আছে। তবে এ জন্য প্রতিদিন কয়েকবার করে সব আহরিত তথ্য পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিয়ে মেমোরিকে শূন্য করে দিতে হবে।
আর পৃথিবীকে তথ্য পাঠানোর উপায় কী? জেমস ওয়েব দুরবিনে একটি উচ্চ শক্তির (High-gain) অ্যানটেনা ও একটি মধ্য শক্তির (Medium-gain) অ্যানটেনা আছে। উচ্চ শক্তির অ্যানটেনাটিকে পৃথিবীতে অবস্থিত কোনো বড় গ্রহণকারী অ্যানটেনার দিকে তাক করতে হয়, অন্যদিকে মধ্য শক্তির অ্যানটেনাটি থেকে বিকিরিত তথ্য একটি বড় জায়গাজুড়ে অনেক গ্রাহক অ্যানটেনার কাছে পৌঁছাতে পারে। উচ্চ শক্তির অ্যানটেনাটি ০.৬ মিটার K ব্যান্ডে এবং মধ্য শক্তির অ্যানটেনাটি ০.২ মিটার S ব্যান্ডে কাজ করে।
জেমস ওয়েব উপগ্রহের পুরো ব্যবস্থা চালানোর জন্য প্রায় দুই হাজার ওয়াট ক্ষমতা লাগবে, সেটি পুরোপুরিই আসবে সৌর প্যানেল থেকে। ৬ মিটার দৈর্ঘ্যের ৫টি প্যানেলকেও উৎক্ষেপণের পর খুলতে হবে।
নাসা, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ESA) ও কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সির (CSA) এক হাজারের বেশি মানুষ এই দুরবিনের ওপর কাজ করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। নগ্রুপ গ্রুম্যান, লকহিড মার্টিন ও বল অ্যারোস্পেসের মতো কোম্পানিকে, আর আছে বহু বিশ্ববিদ্যালয়। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার জন্য অধ্যবসায়, ত্যাগ ও অনুপ্রেরণার প্রয়োজন, জেমস ওয়েব দুরবিনের সৃষ্টি এরই একটি নিদর্শন। ফ্রেঞ্চ গায়ানা থেকে উৎক্ষেপণ, L2 বিন্দুর কাছাকাছি স্থাপন এবং সৌর প্যানেল, সৌর-তাপীয় ঢাল, দুরবিনের ১৮টি অংশের যথার্থ নিয়োজন অতি সূক্ষ্ম প্রকৌশলের সার্থকতার নিদর্শন হবে। আমাদের আশা, এ দুরবিন এই প্রতি দুরূহ পর্যায় অতিক্রম করে আমাদের মহাশূন্যে দূরতম প্রান্ত থেকে তথ্য এনে দেবে, তেমনই নক্ষত্রের জন্ম বা বহিঃগ্রহ সম্পর্কের আমাদের জ্ঞান বহুগুণ বর্ধিত করবে। শুভকামনা, জেমস ওয়েব দুরবিন!
লেখক : অধ্যাপক ও জ্যোতির্পদার্থবিদ, মোরেনো ভ্যালি কলেজ, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র
*লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তার নভেম্বর ২০২১ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়
Samsung Galaxy S21 FE ও Google Pixel 6 কে টেক্কা দেওয়ার জন্য Nothing Phone 1 কী অফার করছে?
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।