বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : মহাজগতের ১৩০০ কোটি বছর আগের ছবি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে সারা দুনিয়ায় হইচই ফেলে দিয়েছে নাসা। কিন্তু যে যন্ত্র দিয়ে এসব ঝকঝকে ছবি তোলা হয়েছে, সেই দূরবীক্ষণ যন্ত্রের নাম জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ কেন? ২০০২ সালে নাসার অ্যাডমিনিস্ট্রেটর পদে ছিলেন সিন ওকিফে। তিনি সে সময় ঘোষণা দেন, নাসার এর পরের টেলিস্কোপ হবে জেমস ওয়েবের নামে। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত নাসার নেতৃত্বে ছিলেন জেমস ই ওয়েব। ঐ সময় বিশ্ব অ্যাপোলো মিশনে নিল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিনের চাঁদে অবতরণ দেখেছিল।
নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, মহাকাশবিজ্ঞানে জেমস ওয়েব ছিলেন তুখোড়। তবে তার কিছু কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক রয়ে গেছে এখনো।
১৯৫০ এর দশকে ট্রুম্যান সরকারের শাসনামল পরিচিতি পায় ‘ল্যাভেন্ডার স্কেয়ার’ হিসেবে। চল্লিশের দশকের শেষ দিক থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত হাজার হাজার সরকারি কর্মীকে সমকামী হিসেবে চিহ্নিত করে হয় বরখাস্ত, নয়তো চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়। ঐ ঘটনা নিয়ে এলজিবিটিকিউ ইতিহাসবিদ ডেভিড কে জনসনের ‘দ্য ল্যাভেন্ডার স্কেয়ার’ বইটি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে।
জেমস ওয়েব ঐ সময় ট্রুম্যান ও সিনেট কমিটির সঙ্গে কাজ করেন। তাদের দায়িত্ব ছিল সরকারি চাকরিতে থাকা সমকামী কর্মীদের তালিকা করা। ২০২১ সালের মার্চে জনসনের বইয়ের বরাত দিয়ে চার জ্যোতির্বিদের লেখা নিবন্ধ প্রকাশ পায় সায়েন্টিফিক আমেরিকান ম্যাগাজিনে। জেমস ওয়েব এলজিবিটিকিউ বিরোধী কাজ করেছেন, সে কারণে টেলিস্কোপের নাম বদলানো উচিত—এটাই ছিল তাদের বক্তব্য। সম্পাদকীয়তে জেমস ওয়েবকে নিয়ে বলা হয়, তিনি স্বভাবগতভাবে জটিল এবং এর সবচেয়ে বাজে প্রকাশ ঘটেছিল ফেডারেল সরকারে সমকামীদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণের মধ্যে দিয়ে।
সমকামী হওয়ার কারণে নাসার কর্মী ক্লিফফোর্ড নরটনকে চাকরীচ্যুত করেন জেমস ওয়েব। ১৯৬৩ সালে ঐ ঘটনার পর নরটন মামলা করেন এবং ১৯৬৯ সালে তার পক্ষেই রায় যায়।
নাসা জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের ছবি প্রকাশের পর মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব নিউ হ্যাম্পশায়ারের পদার্থ বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক চান্দা প্রেসকড-ওয়াইনস্টাইন। সায়েন্টিফিক আমেরিকান ম্যাগাজিনে প্রকাশিত সেই নিবন্ধের চার লেখকের একজন তিনি।
বিষয়টিকে ‘অম্লমধুর’ হিসেবে বর্ণনা করে চান্দা প্রেসকড-ওয়াইনস্টাইন এক টুইটে বলেন, নতুন এই ছবিগুলো দেখতে পেয়ে আমি রীতিমতো উত্তেজনা বোধ করছি। কিন্তু আমি নাসা হেড কোয়ার্টারের ওপর রেগেও আছি।
নাসা বারবার বিষয়টি এড়িয়ে চলেছে। ওয়েব সম্পর্কে সবাই জানে। এমন দুর্দান্ত একটি অবজারভেটরি তার নামে হবে—সেরকম যোগ্য তো তিনি নন। নাসার নতুন ছবিগুলো সামনে আসার পর পরামর্শক সংস্থা জাস্ট স্পেস অ্যালায়েন্স থেকে ৪০ মিনিটের একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করা হয়; সেখানে জেমস ওয়েবের এলজিবিটিকিউবিরোধী কার্যকলাপের তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে।
এদিকে লুসিয়ান ওয়াকোউইকজ, চান্দা প্রেসকড-ওয়াইনস্টাইন, ব্রায়ান নর্ড এবং সারাহ টার্টল মিলে যে নিবন্ধ লিখেছিলেন, তার শিরোনাম ছিল ‘পালটাতে হবে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের নাম।’
চান্দা প্রেসকড-ওয়াইনস্টাইনের নেতৃত্বে কয়েকজন বিজ্ঞানী মিলে গত বছর একটি পিটিশনেরও উদ্যোগ নেন। টেলিস্কোপের নাম বদলানোর আর্জি জানিয়ে ঐ পিটিশনে ১ হাজার ৭০০ জন সই করেন। তাদের বেশির ভাগই জ্যোতির্বিদ্যা অথবা সংশ্লিষ্ট কাজে জড়িত। ইন্ডিয়া টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, খোদ নাসার ভেতরেও অনেকে মনে করেন জেমস ওয়েবের নাম টেলিস্কোপ থেকে মুছে ফেলা উচিত।
লাগাতার দৃষ্টি আকর্ষণের প্রেক্ষিতে গত সেপ্টেম্বরে নাসার পক্ষ থেকে বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেওয়া হয়। পরে সংস্থার ব্যবস্থাপক বিল নেলসন বলেন, নাম বদলের কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখছেন না তারা। নাম বদল করা হবে কি হবে না—তা নিয়ে নাসার ভেতরে মেইল চালাচালির বিস্তর প্রমাণ এ বছর মার্চে তুলে ধরে বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার।
নাসা অ্যাস্ট্রোফিজিকস বিভাগের প্রধান পল হার্জ গত বছর এপ্রিলে ১০ জনের বেশি জ্যোতির্বিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নাম বদল নিয়ে তাদের মত জানতে চান। এ নিয়ে পল হার্জ বলেন, আমরা নাম না পালটালে তারা নাখোশ হবেন—এমন কিছু তাদের কেউ আমাকে বলেনি।
ইমেইলে হার্জ তার ম্যানেজারকে এও লিখেছিলেন, যারা মতামত দিয়েছেন, তাদের মধ্যে কেউ এলজিবিটি গোষ্ঠীর নন। কিন্তু নেচার ম্যাগাজিন থেকে হার্জকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করা হয়েছে, যাদের মধ্যে এলজিবিটিকিউ থেকেও ছিল।
২০২১ সালের নভেম্বর মাসে নাসার অ্যাস্ট্রোফিজিক্স অ্যাডভাইজরি কমিটি থেকে পূর্ণ প্রতিবেদন চাওয়া হয় এ বিষয়ে। নাসার সাবেক ব্যবস্থাপক সিন ও’কিফে সে সময় ইমেইলে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, ঐ সময় যা হয়েছিল তা জেমস ওয়েবের একার সিদ্ধান্ত ছিল না। তাতে অবশ্য দমে যাননি সমালোচকরা। তাদের ভাষ্যে, যদি ভুলের জন্য জেমস ওয়েব দায়ী না হন, তবে ভালো কাজের জন্যই বা কেন তিনি প্রশংসিত হবেন?
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।