জুমবাংলা ডেস্ক : যশোরের গাছিদের মধ্যে শুরু হয়েছে খেজুর রস সংগ্রহের তোড়জোড়। এখনও শীত জেঁকে না বসলেও জেলায় খেজুর গাছ প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে প্রস্তুতকৃত গাছের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক কম। অধিক পরিশ্রম হওয়ায় নতুন প্রজন্মের কৃষকের মধ্যে রস-গুড় উৎপাদনে তেমন আগ্রহ নেই।
এর ফলে খেজুর গাছ থাকলেও গাছির সংকটে সব গাছ উৎপাদনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যশোরে প্রায় ১৬ লাখ খেজুর গাছ রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন লাখ গাছে রস উৎপাদন হয়।
প্রতিটি গ্রামে গড়ে ৮ থেকে ১০ জন পেশাদার গাছি পাওয়া যেত। এখন আর সেদিন নেই। গাছিদের পেশা বদল, নতুন করে এ পেশায় কেউ না আসার কারণে প্রতি গ্রাম তো দূরে থাক কয়েক গ্রাম খুঁজলেও একজন পেশাদার গাছির সন্ধান মিলবে না।
শার্শা উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, খেজুর গাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। আগে খেজুর গাছের যেসব বাগান ছিল এখন আর তা নেই। নতুন করে এখন আর কেউ বাগানও করছেন না।
মাঠে কিম্বা রাস্তার ধারে অল্প-বিস্তর যেসব গাছ আছে তারও বেশিরভাগ পড়ে আছে। অল্প কিছু সংখ্যক খেজুর গাছ কাটা হচ্ছে।
অনেকে বলেন, আগে শীত এলে গ্রামে গ্রামে খেজুরের রসে ভিজানো ‘রসের পিঠা’ খাওয়ার যে ধুম পড়ত তা এখন খুব একটা চোখে পড়ে না।
বাহাদুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান বলেন, ৯০’র দশকের শুরু থেকে যশোরে খেজুর গাছ বিলুপ্ত হওয়া শুরু হয়। খেজুর গাছ জ্বালানি হিসেবে চলে যাচ্ছে বিভিন্ন ইট ভাটায়। অন্যদিকে খেজুর গাছ কমে যাওয়ায় এই গাছ কাটার কাজে নিয়োজিত গাছিরা চলে যাচ্ছেন অন্য পেশায়।
যেসব গাছ অবশিষ্ট আছে সেগুলো এখন গাছির অভাবে পড়ে রয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই গ্রাম বাংলা থেকে হারিয়ে যাবে খেজুরের রস। দূষ্প্রাপ্য হয়ে যাবে গুড় পাটালি।
বেনাপোলের ছোট আঁচড়া গ্রামের গাছি কোরবান আলী (৬০) বলেন, “আগে শীতকালে শত শত গাছ কাটিছি। অনেক রস পাতাম, রস বাজারে বিক্রি করতাম। জ্বালিয়ে গুড় বানাতাম। গুড়-পাটালি বিকি করে বেশ টাকা আয় করতাম। পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালোই দিন কাটত। কিন্তু এখন এলাকায় তেমন একটা খেজুর গাছ নেই। যা আছে তা মালিকরা নিজেদের জন্য কাটাচ্ছে। তাই কাজ না পেয়ে গাছিরাও অন্য পেশায় চলি যাচ্ছে।”
ভবারবেড় গ্রামের গাছি ইউনুচ আলী জানান, শীতকালে আগে শহর থেকে মানুষ দলে দলে আসতো খেজুর রস খেতে। সন্ধ্যায় গ্রামীণ পরিবেশে খেজুরের রস বিক্রি জমে উঠতো। রস আহরণকারী গাছিদের প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যেত সেই সময়ে। এখন আর তেমন লক্ষ্য করা যায় না। তবে খেজুরের গুড়ের চাহিদা রয়েছে। দামও ভালো পাওয়া যায়।
কাগজপুকুর গ্রামের মো. আলাউদ্দিন জানান, তিনি এবার ১০০ খেজুর গাছ প্রস্তুত করেছেন রস নেওয়ার জন্য। দুই-তিন মাসের রস-গুড় বিক্রির অর্থ দিয়ে তার বছরের ৫-৬ মাস সংসার চলে।
খেজুর গাছ প্রস্তুত করার পর খেজুরের যে পাতা পেয়েছেন, সেগুলো জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি আকর্ষণীয় ও মজবুত পাটি তৈরি করবেন। এগুলো বাজারে বিক্রি করে বাড়তি অর্থ আয় করার কথা জানান তিনি।
শার্শার শ্যামলাগাছি গ্রামের গাছি আমিনুর রহমান জানান, বর্তমানে যে হারে খেজুর গাছ হারিয়ে যাচ্ছে, তাতে এক সময় হয়ত এলাকায় গাছ দেখা যাবে না। এলাকার ঐতিহ্য ধরে রাখতে চাইলে কৃষকের বেশি করে খেজুর গাছ লাগানো এবং তা পরিচর্যা করা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
প্রায় ৪০ বছর খেজুর গাছ কেটে রস বের করছেন সামটা গ্রামের গাছি উজির আলি (৭২)। প্রবীণ এই গাছি বলেন, “খেজুর গাছ কেটে এখন আর পেট চলে না। বয়স হয়েছে, তাই গাছির পেশা ছেড়ে দিয়েছি।”
শার্শা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা প্রতাপ মণ্ডল বলেন, উপজেলায় মোট খেজুর গাছের সংখ্যা ৫২ হাজার ২৮০টি। এরমধ্যে মোট ফলন্ত (রস দেওয়া) গাছের সংখ্যা ৪৬ হাজার ৫২০টি। খেজুর গাছ কেটে রস বের করা একটা শিল্প। কিন্তু সেই শৈল্পিক পেশাদার গাছি এখন তো চোখেই পড়ে না।
গাছির অভাবে প্রায় ২০ থেকে ৩০ ভাগ গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয় না। আর টাকার লোভ দেখিয়ে এই অনাবাদি খেজুর গাছগুলো অবৈধ ইটভাটার মালিকরা কেটে নিয়ে যান।
নতুন করে গাছ রোপণ কম, অনাবাদি পড়ে থাকা, অনাগ্রহ, ভেজাল গুড় তৈরিসহ নানা কারণে যেমন খেজুর গাছ হ্র্রাস পাচ্ছে। তেমনি খেজুর গাছ কমে যাওয়া, রস ও গুড়ের ঐতিহ্য হারানোর কারণে গাছিও কমে যাচ্ছে। এর মধ্যেও উপজেলায় ৪৬০ জন গাছি এখনও টিকে আছেন বলে জানান এই কৃষি কর্মকর্তা।
যশোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, জেলায় প্রায় ১৬ লাখ খেজুর গাছ রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন লাখ গাছে রস উৎপাদন হয়। এসব খেজুর গাছ থেকে বছরে পাঁচ কোটি লিটারের বেশি রস পাওয়া যায়। এই রসে বছরে গুড় উৎপাদিত হয় প্রায় ৫২ লাখ কেজি। যার মূল্য শত কোটি টাকার বেশি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।