বিনোদন ডেস্ক : শব্দের জাদুকর প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বড় ছেলে নুহাশ হুমায়ূন। বেশ কয়েক বছর ধরেই নির্মাণে হাত দিয়েছেন। সম্প্রতি সাইকোলজিক্যাল হরর ঘরানার চারটি ভিন্ন গল্প নিয়ে নির্মাণ করেছেন অ্যান্থোলজি সিরিজ ‘পেটকাটা ষ’। এই সিরিজের তিনটি গল্প মুক্তি পেলেও অপেক্ষায় রয়েছে আরও একটি।
ওয়েব সিরিজটি নিয়ে গত মঙ্গলবার (২৬ এপ্রিল) রাতে একটি গণমাধ্যমের লাইভ অনুষ্ঠানে অতিথি হয়েছিলেন নুহাশ। সেখানে কথা প্রসঙ্গে সঞ্চালক তার কাছে জানতে চান- তিনি প্রয়াত বাবা নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের পুত্র হিসেবে এ পর্যন্ত আসতে পেরেছেন কি না। লাইভ শেষে এই প্রশ্ন নিয়ে চরম বিরক্তি প্রকাশ করেছেন নুহাশ।
ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, ”বাংলাদেশে রিপোর্টিং যদি আরেকটু সম্মানজনক হতো! একটু আগে আমি লাইভ ইন্টারভিউতে ছিলাম, ভেবেছিলাম ‘ষ’ নিয়ে কথা হবে। সেখানে আমাকে প্রশ্ন করা হলো, যদি আমার বাবা (হুমায়ূন আহমেদ) না হতেন, তাহলে আমি এই অবস্থানে আসতে পারতাম কি না? আমি জানি না আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত একজন নির্মাতাকে আপনারা কীভাবে এই প্রশ্ন করেন?”
তিনি আরও লেখেন, ‘তোমাদের কি মনে হয় সানড্যান্স, বুসান, এএক্সএসডাব্লিউ, মার্শে দ্যু ফিল্ম- আন্তর্জাতিক উৎসবগুলোতে বাপের নাম দেখে ইনভাইট করে?’
এদিকে তার এমন স্ট্যাটাসের পরই সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় ওঠে। অনেকেই নুহাশকে অহংকারী, বদমেজাজি তকমা দেন। কেউ কেউ আবার তাকে সমর্থনও জানান। তারই প্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার (২৮ এপ্রিল) আরেকটি স্ট্যাটাসে নিজের অভিজ্ঞতা ও না বলা বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন নুহাশ। তার স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
”সবাইকে ধন্যবাদ, আপানদের সহানুভূতি, সুচিন্তিত মতামত এবং ভালবাসা নিয়ে আমার পাশে থাকার জন্য। আমার সাক্ষাৎকারের অভিজ্ঞতা জানানোর পর, অনেকেই আমাকে তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। দেখলাম, আমি-ই প্রথম এমন মানুষ না যে মিডিয়ার সামনে অপ্রস্তুত হয়েছি আর অপমানিত বোধ করেছি। এর মধ্যে ভালো লাগছে যে আমি আমার অনভুতির কথা সরাসরি লিখেছি, অনেকে হয়তো তাঁদেরটা বলতে পারেননি।
আবার খেয়াল করলাম, অনেক পেইজ, সঞ্চালকের ছবি দিয়ে অনাকাঙ্খিত মন্তব্য করছেন। আমি কোনভাবেই এ ধরনের সাইবার বুলিং সমর্থন করি না। আমি মনে করি, কিছু প্রশ্ন আপত্তিকর ছিল, কিন্তু হয়তো এখন মিডিয়াতে এইটাই একটা প্রবণতা হয়ে গিয়েছে। এর সমাধান করতে চাইলে ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে এমন ভাবে প্রস্তুত করতে হবে যেন তারা শ্রদ্ধাশীল থাকেন। কিন্তু কোনভাবেই একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যবহারের উত্তর সেরকম ব্যবহার হওয়া উচিত না। শেষ ‘ষ’ এর পর্বে একটা লাইন ছিল ‘দোষের চেয়ে বিচার বেশি’ সেই অবস্থা যেন না হয়।
আমি চাই, ইন্টারভিউ এর আগে কি নিয়ে আলোচনা হবে, সেটার স্বচ্ছতা থাকুক। সেই ইন্টারভিউ এর আগে আমাকে বলা হয়েছে এটা মূলত ‘ষ’ নিয়ে আলোচনা। হয়তো কিছু কথা হবে বাবা কে নিয়ে। আমি সেটার জন্যই প্রস্তুত ছিলাম।
অতীতে আমার পরিবার নিয়ে আন্তরিক ভাবেই ব্যাক্তিগত বিষয় নিয়ে ইন্টারভিউ দিয়েছি। সেখানে আমার জীবনে আমার মায়ের ভূমিকার কথা বলেছি, আমার বাবাকে নিয়ে কথা বলেছি। কিন্তু এই ধরনের ইন্টারভিউ এর জন্য আমার মানসিক প্রস্তুতি লাগে। আমি হঠাৎ করে এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হলে অপ্রস্তুত হয়ে যাই।
এটা মনে করিয়ে দিতে পারি, আমি ১৯ বছর বয়সে আমার বাবাকে হারিয়েছি। আমি আমার বাবাকে ঠিকভাবে বিদায় জানাতে পারিনি, কারণ চারিদিকে ছিল ক্যামেরা আর সাংবাদিক। একটা মুহূর্ত একা তার পাশে বসতে পারিনি তাঁকে শুইয়ে দেয়ার আগে! তাই হঠাৎ যদি লাইভ অনুষ্ঠানে আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়, বাবা আমার জীবনে না থাকলে সেটা কেমন হতো- আমি অপ্রস্তুত হয়ে যাই। আমার জন্য এই বিষয়টা খুবই স্পর্শকাতর। এছাড়াও আমার মনে হয়, আমার জীবনে বাবার ভূমিকা নিয়ে কথা বলার জন্য- বাবা জীবনে না থাকলে কি হতো/কেমন হতো এই প্রশ্নগুলি খুব একটা শ্রদ্ধাশীল নয়।
আমার খুব ভালো লেগেছে, আমি কয়েকদিন আগে রাহাত রহমানের সাথে একটা পডকাস্ট করেছি। সেখানে তিনি জানতে চেয়েছেন, কিভাবে দেশের বাইরে বিভিন্ন অনুদানের জন্য আবেদন করা যায়। যেহেতু আমি সানডেনস চলচিত্র উৎসবে, ফিল্ম ইন্ডিপেন্ডেন্ট এবং স্লোয়ান সামিটে অংশগ্রহণ করেছি। আরেকটা সাক্ষাৎকারে কথা বলেছি আমার বাবার লেখা উপন্যাসের মধ্যে কোনটা আমার সবচেয়ে প্রিয়- তা নিয়ে। এটাকে ভিজুয়াল মিডিয়ায় রূপ দেয়ার জন্য কে হতে পারেন সবচেয়ে যোগ্য সহযোগী। এই সব সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তরুণ সঞ্চালকরা। আর সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময়ই বোঝা গিয়েছে তাঁরা আমার কাজ নিয়ে খোঁজ খবর নিয়েছেন। বড় বড় প্রতিষ্ঠান থেকেও আমি সেটাই আশা করি।
আমি যেসব কাজ করেছি, যতটুকু করেছি এবং যেখান থেকে আমি এসেছি- সব কিছু নিয়ে আমি খুব বিনয়ের সাথেই গর্বিত। আমার নিজের অর্জন বা সাফল্য নিয়ে কথা বললে দেখি অনেকেই খুব বিরক্ত হয়। কিন্তু সম্পূর্ণ অজানা একজন মানুষের সাফল্যে কেন তাদেরকে এত বিরক্ত করে সেটাও বুঝিনা! আমার মনে হয়, আমাদের শেখানো হয়, আমাদের অর্জনের কথা শুধুমাত্র সিভিতে লেখা যাবে, মুখে বলা যাবে না। মুখে বলার মানে হল, ‘সে খুব অহংকারী’, ‘বড় বড় কথা বলে’ অথবা ‘নিজেকে কি মনে করে’। এই ধারনাগুলি পাল্টানো দরকার। নিজেদের অর্জনের কথা মাথা উঁচু করেই বলা উচিত।
আমি আমার পরিবার নিয়ে প্রচণ্ডভাবে গর্বিত। আমি আমার বাবাকে ভালোবাসি আর কখনোই আমার জীবনে তাঁর প্রভাবকে অস্বীকার করি না। ‘আলোর মশাল’ লেখাটায় আমি লিখেছিলাম, কিভাবে আমার বাবা আমার জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে দিয়েছেন আর কেমন করে ছোটবেলার আমি তাঁর মতন হওয়ার চেষ্টা করতাম। কিভাবে আর কেনই বা আমি আমার বাবা বা মার প্রভাবকে অস্বীকার করবো!
যখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি, আমার একটা লেখা পড়ে, আমার মার মনে হয়েছিল এই স্কুল আমার সৃজনশীলতাকে ঠিক মতন মূল্যায়ন করছে না- তিনি আমার স্কুল বদলে দিয়েছিলেন। মা আমার ১৩ বছর বয়সে একটা ডিজিটাল ক্যামেরা কিনে দিয়েছিলেন। সেটা দিয়ে আমি আমার প্রথম শর্ট ফিল্ম বানানো শুরু করি। আমি যা কিছু তৈরি করি, সব কিছুতে আমি আমার মার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আমার তো বাবাকে কৃতজ্ঞতা জানানো লাগে না, আমার নামের সাথেইতো আছেন সব সময়। কিন্তু আমার মার নাম আছে আমার সমস্ত নির্মাণে, সব কিছুতেই। মাকে ছাড়া আমি কখনোই আজকের জায়গায় আসতে পারতাম না।
আমার দেখা শ্রেষ্ঠ সিনেমাগুলো আমি দেখেছি আমার বাবার সাথে। বাবা আমার চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করে দিয়েছেন। আমার মা, সেই ভালোবাসার ছবি তৈরির পাশে আছেন। আমি বলতে দ্বিধা করবো না, আমার বাবার অর্জনের পিছনেও আমার মার ভূমিকা অপরিসীম। আমার মনে হয়, হুমায়ূন আহমেদ বা নুহাশ হুমায়ূন কেউই সামনে এগিয়ে যেতে পারতো না, গুলতেকিন খানকে ছাড়া।
তাই আমার অনুরোধ থাকবে, কেউ আমার জীবনে আমার বাবার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করার সাথে সাথে মার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন করুন। আর যদি বাক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলতে চান, অনুগ্রহ করে আগে থেকেই জানিয়ে রেখেন। আমি প্রস্তুত থাকবো। ধন্যবাদ।”
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।