দেশের উচ্চশিক্ষা খাতে এবার দেখা দিতে পারে নজিরবিহীন বৈপরীত্য- একদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে হুড়োহুড়ি, অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে থাকবে খালি আসন। কারণ, এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল গত দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে হতাশাজনক, যা উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ চিত্রকেই বদলে দিয়েছে।

বাংলাদেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডে গড় পাসের হার মাত্র ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে মাত্র ৬৯ হাজার ৯৭ জন। গত বছরের তুলনায় পাসের হার কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ এবং জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী কমেছে ৭৬ শতাংশেরও বেশি। ফলে দেশের প্রায় ১৩ লাখ আসনের বিপরীতে উচ্চশিক্ষার উপযুক্ত শিক্ষার্থী রয়েছে মাত্র ৭ লাখ ২৬ হাজার ৯৬০ জন। অর্থাৎ, প্রায় ৬ লাখ আসন ফাঁকা থাকবে বলে আশঙ্কা করছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।
ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে কার্যক্রম চালু আছে ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের। এসব প্রতিষ্ঠানে মোট আসন প্রায় ৫০ হাজার। এ ছাড়া সরকারি মেডিক্যাল কলেজে রয়েছে ৫ হাজার আসন। অর্থাৎ, যোগ্য শিক্ষার্থীদের একটি ক্ষুদ্র অংশই সরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষাার সুযোগ পাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. হাফিজুর রহমান বলেন, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সীমিত হওয়ায় প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- বাকি লাখ লাখ শিক্ষার্থীর গন্তব্য কোথায়? এখানেই বেসরকারি ও বিকল্প উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব বাড়ছে।
দেশে এখন কার্যক্রম চালু রয়েছে প্রায় ১২০টিরও বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের। এ ছাড়া অসংখ্য বেসরকারি মেডিক্যাল, ডেন্টাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেও ভর্তি মৌসুমে শিক্ষার্থী আকর্ষণে হিমশিম খেতে হয়। এবারের ফল সেই সংকটকে আরও প্রকট করবে।
ইউজিসির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- প্রতিবছর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গড়ে ৪ লাখের বেশি আসন খালি থেকে যায়। এবারে সেই সংখ্যা ৬ লাখ ছাড়াতে পারে।
বাংলাদেশ প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি অ্যাসোসিয়েশনের এক সদস্য বলেন, আমরা শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত করতে প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু ফলের এমন ধস কেউ কল্পনাও করেনি। এবার হয়তো স্কলারশিপ ও ছাড়ের দৌড়েই শিক্ষার্থী টানতে হবে।
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী নাহিদুল ইসলাম। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছেন। তিনি বলেন, প্রথম লক্ষ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ওখানে না হলে জাহাঙ্গীরনগর বা রাজশাহীতে চেষ্টা করব। প্রাইভেটে পড়ার সামর্থ্য নেই।
অন্যদিকে রাজধানীর এক কলেজের শিক্ষার্থী তাসনিম সুমাইয়া বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে না হলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব। কিন্তু শুনছি, অনেক জায়গায় ক্লাসেই শিক্ষার্থী পাওয়া যায় না, এটা চিন্তার বিষয়।
রাজধানীর মিরপুরের অভিভাবক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ছেলেকে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে দিতে চাই। কিন্তু প্রাইভেটে পড়াতে গেলে বছরে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা খরচ হয়। এটা আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে অসম্ভব।
শিক্ষাবিদ মোজাম্মেল হক চৌধুরী মনে করেন, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিট না বাড়ালে শিক্ষার্থীরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যেতে বাধ্য হবে। তবে সেসব প্রতিষ্ঠানের মান ও খরচ নিয়ন্ত্রণ না করলে শিক্ষার্থী সংকট বাড়তেই থাকবে।
ইউজিসির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এসএমএ ফায়েজ বলেন, এইচএসসি ফলের ধসের কারণে এ বছর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থী ঘাটতি দেখা দেবে। আমরা চাই, তারা মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করে ভর্তি কৌশলে নতুনত্ব আনুক। তিনি আরও বলেন, এই পরিস্থিতি শুধু ভর্তি সংকট নয়, এটি উচ্চশিক্ষা নীতির অদূরদর্শিতা ও মানবসম্পদ পরিকল্পনার ঘাটতির প্রতিফলন। পাবলিক ও প্রাইভেট- দুই খাতের ভারসাম্য এখন সময়ের দাবি।
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় এবার দেখা দিতে যাচ্ছে এক নতুন বাস্তবতা- যেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে স্বপ্ন, আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো লড়বে শিক্ষার্থী টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ। শিক্ষা বিশ্লেষকদের মতে, শিক্ষার্থী খরা কেবল ভর্তি সমস্যা নয়, এটি দেশের উচ্চশিক্ষাা কাঠামোর গভীর অসামঞ্জস্যের প্রতিচ্ছবি। এখন সময় এসেছে শিক্ষানীতি পুনর্বিবেচনার, যাতে শিক্ষার সুযোগ ও মান- দুটোই হয় সমানভাবে নিশ্চিত।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



