জুমবাংলা ডেস্ক : কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান প্রায় ১২ দশমিক ২২ শতাংশ, যার বাজারমূল্য অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা। বিদেশে দিন দিন ইলিশের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার ও বৃষ্টিপাত কম হওয়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ইলিশ আহরণের ওপর। তবে আশার কথা হচ্ছে ভারি বৃষ্টিপাত হওয়ার পর বেশ কয়েকদিন যাবৎ জেলেদের জালে ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ। মাসের শেষ দিকে রেকর্ড পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়ার আশা করছেন মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, বোট মালিক ও জেলেরা।
মৎস্য খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইলিশের আহরণ মিঠা পানির পরিবর্তে এখন লোনা পানিতেই বাড়ছে। প্রজনন সরে যাচ্ছে মোহনার নিম্নাঞ্চলে। অবাধে জাটকা নিধন ও নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নির্দিষ্ট মৌসুমে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পরিবর্তন ঘটছে ইলিশ শিকারের মৌসুমের। ২০২২ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী মৎস্য খাতে জিডিবি প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৮ শতাংশ। আর কৃষিজ জিডিপির ২১ দশমিক ৮৩ শতাংশ মৎস্য খাতের অবদান। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জাতীয় পর্যায়ে ৫০ দশমিক ৮০ লাখ মেট্রিক টন মৎস্য উৎপাদনের লক্ষ্য রেখেছে সরকার।
সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তরের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিগত ২০২১-২২ অর্থবছরে উন্মুক্ত জলাশয়, চাষ, সমুদ্র থেকে মৎস্য আহরিত হয়েছে ৪৭ লাখ ৫৮ হাজার মেট্রিক টন। এরমধ্যে পাঁচ লাখ ৬৭ হাজার টন ইলিশ। নদী থেকে দুই লাখ ৪৫ হাজার টন আর গভীর সমুদ্র থেকে তিন লাখ ২২ হাজার টন ইলিশ আহরিত হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তথ্য এখনো প্রকাশ করেনি মৎস্য অধিদপ্তর। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ উৎস (নদী) থেকে ইলিশ আহরণ ছিল দুইলাখ ৫১ হাজার মে. টন এবং সাগর থেকে তিন লাখ ১৪ হাজার মে. টন।
সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তর চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক শওকত কবির চৌধুরী বলেন, এবার ইলিশ শিকারের মৌসুমে বৃষ্টিপাত কম ছিল এবং আবহাওয়া প্রতিকূল থাকায় সাগরযাত্রা ব্যাহত হয়েছিল জেলেদের। তাই ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার পর আশানুরূপ মাছ আহরণ করতে পারেনি তারা। বিগ সিজন (ইলিশ ধরার মৌসুম) জুলাইয়ের শেষ থেকে আগস্ট হলেও এবার আগস্টের শেষ থেকে জেলেদের জালে ইলিশ ধরা পড়ছে। আমাদের সার্ভিল্যান্স চেকপোস্টের তথ্যমতে, গত এক সপ্তাহে ফুল ভলিউমে ইলিশ পাচ্ছে জেলেরা। ১২ থেকে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৩০ টনের মতো ইলিশ আহরণ করেছে নৌযানগুলো। এখন আবারও সাগরে সতর্কতা সংকেত। কয়েকদিন পর আরও ভাল পরিমাণ মাছ আহরিত হবে। অবশ্য মৎস্য অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তার মতো বোট মালিকেরাও একই কথা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, গত সপ্তাহে ভালো ফিশিং হয়েছে। সামনে আরও বাড়বে।
সোমবার ফিশারিঘাট বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, ইলিশের দাম নাগালের বাইরে। তবে বড় আকারের ইলিশের তুলনায় বেশিরভাগই মাঝারি ও ছোট মাছ। এক কেজি ওজনের ইলিশ পাইকারিতেই বিক্রি হচ্ছে ১১শ’ থেকে ১২শ’ টাকায়। চাহিদার তুলনায় ইলিশ না আসায় দামও বেশি। যার ফলে খুচরা পর্যায়ে এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৩শ’ থেকে ১৫শ’ টাকায়।
সোনালী যান্ত্রিক মৎস্য শিল্প সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক বাবুল সরকার জানান, নদী ও সাগরের ইলিশ মিলিয়ে গত সপ্তাহে প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয় টন ইলিশ এসেছে। কেননা আমাদের বাজারে পদ্মা ও চাঁদপুর থেকে যেমন ইলিশ আসে, একইভাবে গভীর সাগর থেকে আহরণ করা ইলিশও আসে। যে পরিমাণ মাছ এসেছে এটি আমাদের চাহিদার ২০ ভাগের ১ ভাগও নয়। এখন সাগরে সিগন্যাল। বোটগুলো সব তীরে নোঙর করেছে। কক্সবাজার, টেকনাফ, কুতুবদিয়া, ভোলার মনপুরাসহ বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চলে মাছ ধরার নৌযানগুলো এখন ফিরে এসেছে। আবহাওয়া অনুকূলে আসলেই জেলেরা মাছ ধরতে যাবে। আশা করছি আগামী সপ্তাহ থেকে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ টন ইলিশ আসবে।
হঠাৎ করে ইলিশ নিয়ে হাহাকার দেশজুড়ে। নিষেধাজ্ঞার পরও কেন পর্যাপ্ত ইলিশ মিলছে না এ নিয়ে বিশেজ্ঞরা জানিয়েছেন বিভিন্ন মত। তাদের মতে, বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে লোনা ও স্বাদু পানিতে বিচরিত মাছের বাস্তুসংস্থানের পরিবর্তন হয়েছে। যার সঙ্গে মাছের প্রজননচক্র, মাছের দেশান্তর গতিবেগ এবং জীবনচক্র প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত। একইভাবে ইলিশের প্রজননও জলবায়ু পরিবর্তন এবং জলজ দূষণের কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
৪৩-৪৪ কেজিতে মণ, ডিজিটাল পদ্ধতি চালুর দাবি ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা কলাপাড়া থেকে জানান, কোন রাখ-ঢাক নেই। কেউ ৪২-৪৩ কেজি, আবার কেউ ৪৪ কেজি পর্যন্ত নিচ্ছে একমণ ইলিশে। দখিণের বৃহৎ ইলিশের মোকাম আলীপুর-মহিপুরে চলছে এসব। ওজন করা হচ্ছে পুরনো পদ্ধতির লোহার দাঁড়িপাল্লায়।
অধিকাংশের নেই ওজনের ডিজিটাল পদ্ধতির মিটার। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ জলদস্যুতার ঝুঁকি মোকাবিলা করে জীবনবাজি রেখে গভীর সমুদ্রের আহরিত ইলিশ বিক্রি করতে গিয়ে হাজারো জেলেরা ওজনে চরমভাবে প্রতারিত হচ্ছে। আড়ত মালিকরা মণপ্রতি দুই থেকে চার কেজি ইলিশ বেশি হাতিয়ে নিচ্ছে। একশ’ মণ মাছ বিক্রি করলে আরও চার-পাঁচ মণ বেশি বিনা টাকায় হাতিয়ে নিচ্ছে। আড়ত থেকে দাদন নেয়াসহ বিভিন্ন সমস্যার প্রেক্ষিতে জেলেরা এই জিম্মি দশা থেকে মুক্ত হতে পারছেন না।
মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, গত ছয় দিনে ইলিশের বৃহৎ মোকাম আলীপুর-মহীপুরে অন্তত ১২ হাজার মণ ইলিশের আমদানি হয়েছে। রবিবার রাতের তথ্য এটি। যা থেকে বিনা টাকায় অন্তত এক হাজার মণ ইলিশ হাতিয়ে নিয়েছে আড়ত মালিকরা। যার বাজার মূল্য অন্তত তিন কোটি টাকা। ভুক্তভোগী জেলে ও ট্রলার মালিকরা এর থেকে মুক্তি চেয়েছেন। মহিপুর মৎস্য আড়ত মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রাজু আহম্মেদ রাজা জানান, একটু ত্রুটি-বিচ্যুতি যা আছে আমরাও তা জেনেছি। তবে আগামী দুই-একদিনের মধ্যেই সমিতির সভার মধ্য দিয়ে জেলেদের সমস্যার সঠিক সমাধান হবে ইনশাআল্লাহ। কলাপাড়ার ইউএনও মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, তিনিও বিষয়টি আজকেই কেবল জেনেছেন। জেলেরা যেন প্রতারিত না হয় এজন্য ইলিশ বেচাকেনায় ওজনে ডিজিটাল পদ্ধতি চালুর জন্য যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।