আজ সকালে খুলনার কয়রা উপজেলার রহিমা বেগমের চোখে ভেসে উঠল লবণাক্ত পানিতে ডুবে যাওয়া তার তিন বিঘা জমির ছবি। গত পাঁচ বছরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে ৮ সেন্টিমিটার, আর তার ধানের ক্ষেতে ঢুকেছে লোনা জল। রহিমার মতো লক্ষ কৃষকের কণ্ঠে আজ একটাই প্রশ্ন: “এই জলবায়ু পরিবর্তন কি শুধু বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয়, নাকি আমাদের বিলুপ্তির কারণ হবে?”
জলবায়ু পরিবর্তন শব্দটি এখন শুধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনের এজেন্ডা নয়—এটি বাংলাদেশের প্রতিটি নদী, মাঠ, বাড়ির উঠোনে আঘাত হানছে। আইপিসিসির (IPCC) ২০২৩ সালের রিপোর্ট বলছে, বিশ্বে কার্বন নিঃসরণ বন্ধ না হলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ১৭% ভূমি সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। কিন্তু এটা শুধু ভবিষ্যতের ভয় নয়, আজই চোখের সামনে ঘটে চলেছে অমোঘ বাস্তবতা।
জলবায়ু পরিবর্তন আসলে কী?
জলবায়ু পরিবর্তন মানে শুধু তাপমাত্রা বাড়া নয়—এটি পৃথিবীর আবহাওয়া চক্রের আমূল পরিবর্তন। সূর্যের তাপ আটকে রাখার জন্য প্রাকৃতিকভাবেই কিছু গ্যাস (গ্রিনহাউস গ্যাস) বায়ুমণ্ডলে থাকে। কিন্তু কলকারখানা, যানবাহন, বন উজাড়ের ফলে অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেনের মতো গ্যাস বায়ুমণ্ডলে জমা হচ্ছে। ফলে সূর্যের তাপ ফিরে যেতে পারছে না, গরম হচ্ছে পৃথিবী।
কীভাবে কাজ করে এই প্রক্রিয়া?
১. গ্রিনহাউস প্রভাব: প্রাকৃতিকভাবে CO₂, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে তাপ ধরে রাখে।
২. মানবসৃষ্ট বৃদ্ধি: শিল্প বিপ্লবের পর (১৮৫০ সাল থেকে) CO₂ মাত্রা বেড়েছে ৪৭% (NOAA, ২০২৪)।
৩. তাপমাত্রায় প্রভাব: গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১.২°C (বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর, ২০২৩)।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উদ্বেগ: বিশ্বের শীর্ষ ১০টি জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ৭ম স্থানে (Germanwatch, ২০২৪)। কারণ, এখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব উভয়ই বিপজ্জনক পর্যায়ে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: বাংলাদেশে যেভাবে বদলে দিচ্ছে জীবন
১. সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উপকূলীয় বিপর্যয়
পরিসংখ্যান:
- ১৯৯৩-২০২৩ পর্যন্ত বাংলাদেশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে গড়ে ৭.৮ মিমি/বছর (সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস – CEGIS)।
- ২০৫০ সাল নাগাদ ৪০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে (বিশ্বব্যাংক)।
বাস্তব অভিজ্ঞতা:
সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মো. হারুন অর রশিদ বললেন, “গত ১০ বছরে আমাদের গ্রামে ৩ বার বাড়ি বদলাতে হয়েছে। লবণ পানি ঢুকে জমি অনুর্বর হয়ে গেছে। এখন মাছ ধরার ট্রলারেই থাকি।”
২. চরম আবহাওয়ার ঘটনা বৃদ্ধি
- ঘূর্ণিঝড়: ২০২০-২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশে ৮টি বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে (সিডিএমপি)। মে ২০২৪-এর ঘূর্ণিঝড় রেমালে প্রাণ হারান ১৬ জন।
- বন্যা: ২০২২ সালের সিলেট বন্যায় দেশের ৭০% এলাকা ডুবে যায়, ক্ষতি হয় ১.২ বিলিয়ন ডলার (আইওএম)।
- খরা: উত্তরবঙ্গে ২০২৩ সালে বৃষ্টিপাত কমেছিল ৪০%, আমন ধানের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে ২৫% (কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর)।
৩. কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তায় হুমকি
বাংলাদেশের ৬০% মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। জলবায়ু পরিবর্তন এই ভিত্তিকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে:
ফসল | প্রভাব | সম্ভাব্য ক্ষতি (২০৫০ সাল নাগাদ) |
---|---|---|
ধান | লবণাক্ততা, বন্যা, খরা | উৎপাদন হ্রাস: ১৭% (IRRI) |
মাছ | প্রজনন ক্ষেত্র হারানো | উৎপাদন হ্রাস: ৩০% (WorldFish) |
সবজি | তাপমাত্রাজনিত রোগ | উৎপাদন হ্রাস: ১৫% (FAO) |
৪. স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অর্থনৈতিক প্রভাব
- তাপপ্রবাহ: ২০২৪ এপ্রিলে রাজশাহীতে তাপমাত্রা ৪২.৭°C রেকর্ড করা হয়, হাসপাতালে ভর্তি হন ৩০০+ মানুষ।
- ম্যালেরিয়া-ডেঙ্গু: কক্সবাজারে ২০২৩ সালে ম্যালেরিয়ার ঘটনা বেড়েছে ৪০% (আইসিডিডিআর,বি)।
- অর্থনীতি: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জিডিপি ক্ষতির পরিমাণ ২০৩০ সাল নাগাদ বছরে ২% (পরিকল্পনা কমিশন)।
বাংলাদেশ কীভাবে মোকাবেলা করছে?
জাতীয় পদক্ষেপ
১. মুজিব ক্লাইমেট প্রসপেরিটি প্ল্যান (MCPP):
- ২০৪১ সালের মধ্যে কার্বন-নিরপেক্ষতা অর্জনের লক্ষ্য।
- নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ৩০% বৃদ্ধি।
২. বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০:
- ৮০ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলাধার উন্নয়নে ফোকাস।
- পরিকল্পনা কমিশনের ওয়েবসাইটে বিস্তারিত
৩. স্থানীয় অভিযোজন:
- হাওড় অঞ্চলে ভাসমান কৃষি (ধাপ চাষ) – বরিশালে ৫০,০০০ কৃষক প্রশিক্ষিত।
- সুন্দরবন সংলগ্ন অঞ্চলে মৌয়ালদের জন্য বিকল্প জীবিকা (মধু সংগ্রহ, ইকো-ট্যুরিজম)।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
- ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (CVF)-এ বাংলাদেশের নেতৃত্ব।
- গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার প্রাপ্তি (২০২৩)।
আপনি ব্যক্তিগতভাবে কী করতে পারেন?
১. জ্বালানি সাশ্রয়:
- এসি ১°C কম ব্যবহারে ১০% বিদ্যুৎ সাশ্রয়।
- সৌরশক্তি ব্যবহারে উৎসাহ (IDCOL-এর সুবিধা নিন)।
২. টেকসই কৃষি:
- লবণ-সহিষ্ণু ধানের জাত (ব্রি ধান ৬৭) চাষ।
- বাড়িতে ভার্টিক্যাল গার্ডেন তৈরি।
৩. সচেতনতা ছড়িয়ে দিন:
- স্কুল-কলেজে জলবায়ু ক্লাব গঠন।
- জলবায়ু ট্রাস্টের কার্যক্রমে স্বেচ্ছাসেবী হোন।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়—এটি আমাদের প্রত্যেকের অস্তিত্বের লড়াই। রহিমা বেগম আজও তার জমি ফিরে পেতে লড়ছেন, কিন্তু সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। আইপিসিসির সর্বশেষ রিপোর্ট সতর্ক করেছে: “এখনই পদক্ষেপ না নিলে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে ২০৭০ সালের মধ্যে।” আপনার প্রতিটি ছোট পদক্ষেপ—একটি গাছ লাগানো, প্লাস্টিক ব্যবহার কমানো—একত্রে বিশাল পরিবর্তন আনতে পারে। আজই শুরু করুন, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যেতে।
জেনে রাখুন
জলবায়ু পরিবর্তন কি প্রাকৃতিক নাকি মানুষের সৃষ্টি?
জলবায়ু পরিবর্তন প্রাকৃতিকভাবেও ঘটে, কিন্তু বর্তমান দ্রুত পরিবর্তনের জন্য ৯৫% দায়ী মানুষের কার্যকলাপ। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো, বন উজাড় ও শিল্পায়নের ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রা বিগত ৮ লাখ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ (NASA, ২০২৩)।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় প্রভাব কোনটি?
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও লবণাক্ততা প্রবেশ প্রধান হুমকি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের ৩০% উপকূলীয় জমি ফসল উৎপাদনের অনুপযোগী হয়ে পড়বে (বুয়েটের গবেষণা, ২০২৪)।
জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বাংলাদেশের সেরা কৌশল কী?
অভিযোজন ও প্রশমন উভয় কৌশল জরুরি। অভিযোজনে বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র, লবণ-সহিষ্ণু ফসল চাষ; প্রশমনে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও সবুজ শিল্পায়ন (পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি পেপার)।
সাধারণ মানুষ কীভাবে অবদান রাখতে পারে?
শক্তি সাশ্রয়, পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য ব্যবহার, বৃক্ষরোপণ ও জলবায়ু-বান্ধব কৃষি চর্চার মাধ্যমে। প্রতি পরিবার মাসে ১০ কেজি কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতে পারে শুধু LED বাল্ব ব্যবহার করে (প্রকাশ অ্যান্ড এনার্জি ফাউন্ডেশন)।
জলবায়ু উদ্বাস্তু কারা?
যারা বন্যা, ঘূর্ণিঝড় বা লবণাক্ততায় বাড়ি-জমি হারিয়ে অন্যত্র পুনর্বাসিত হয়। ২০২৩ পর্যন্ত বাংলাদেশে ৫০ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে জলবায়ু উদ্বাস্তু (IDMC রিপোর্ট)।
জলবায়ু ন্যায়বিচার কেন গুরুত্বপূর্ণ?
বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশের অবদান মাত্র ০.৪৭%, কিন্তু ক্ষতির শিকার সবচেয়ে বেশি। জলবায়ু ন্যায়বিচারের দাবি হলো উন্নত দেশগুলোর উচিত ক্ষতিপূরণ ও প্রযুক্তি হস্তান্তর করা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।