গত জুন মাসে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে মাঠে নামলেন রহিমা বেগম। বৃষ্টির অপেক্ষায় জমিতে ধান রোপণের দিন গুনছিলেন। কিন্তু আকাশ ফাটলেও বৃষ্টি এল না। উল্টো লবণাক্ত জলে ভেসে গেল ফসলি জমি। “এই বুড়ি বয়সে নতুন করে বাপের বাড়ি চলে যেতে হবে?”—কণ্ঠে তার হতাশার ছায়া। রহিমার গল্প কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: জীবনধারায় পরিবর্তন আজ বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের নিত্যসঙ্গী। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বর্ষণ, চরম তাপপ্রবাহ—প্রতিটি প্রাকৃতিক বিপর্যয় আমাদের খাদ্যাভ্যাস, বাসস্থান, স্বাস্থ্যবিধি এমনকি পারিবারিক রীতিতেও ডালপালা গজিয়ে উঠছে এক অদৃশ্য শিকড়ের মতো। আইপিসিসির সর্বশেষ রিপোর্ট (২০২৩) সতর্ক করেছে: বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর শীর্ষে। কিন্তু সংখ্যায় নয়, এই প্রতিবেদনের হৃদয় নিংড়ানো সত্য লুকিয়ে আছে লক্ষ রহিমার চোখের জলে, ভাঙা ঘরের ইটে, লবণে পোড়া জমির ফাটলে। চলুন, জলবায়ু নামক এই অদৃশ্য শক্তির সামনে আমাদের প্রতিদিনের জীবন কীভাবে নতজানু হচ্ছে—তা একসঙ্গে অনুসন্ধান করি।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: জীবনধারায় পরিবর্তন—একটি নির্মম বাস্তবতা
২০১৯ সালে সিডরের ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়ানো সুন্দরবন-সংলগ্ন গ্রাম আজ আবারও হুমকিতে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে বছরে ৬-৮ মিমি হারে (বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র, ২০২৩)। ফল? লবণাক্ততা ঢুকে পড়েছে ১০৫টি উপজেলায়, যা দেশের মোট আবাদি জমির ৩০% গ্রাস করেছে। খুলনার কয়রায় ধানের জমিতে এখন চাষ হয় চিংড়ি। “লবণ পানিতে ধান মরে, তাই বিকল্প খুঁজতে বাধ্য হচ্ছি,” বললেন কৃষক জামাল উদ্দিন। শুধু কৃষিই নয়, নিত্যদিনের জীবনযাত্রায় ঢুকে পড়েছে পরিবর্তনের ছোবল:
- খাদ্যাভ্যাসের রূপান্তর: ঢাকার বাসিন্দা সুমি আক্তারের রান্নাঘরে এখন সপ্তাহে তিনদিন সামুদ্রিক মাছ। নদীর মিঠাপানির ইলিশের দাম ১,২০০ টাকা কেজি ছুঁয়েছে (বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, ২০২৪)।
- বাসস্থানের নতুন সংজ্ঞা: বরগুনায় ‘ভাসমান বাড়ি’ এখন স্থায়ী সমাধান। বাঁশের ভেলায় তৈরি ঘরে থাকেন ২০০+ পরিবার।
- স্বাস্থ্য সুরক্ষার চ্যালেঞ্জ: রাজশাহীতে তাপমাত্রা ৪৫°C ছাড়ালে হাসপাতালে ভর্তি বেড়েছে ৭০% (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মে ২০২৪)।
বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিভঙ্গি:
“জলবায়ু পরিবর্তন শুধু পরিবেশগত বিষয় নয়, এটি মানবিক সংকট,” বলছেন ড. সালিমুল হক, আইইউসিএন-এর জলবায়ু বিশেষজ্ঞ। “একটি শিশু আজ যে গ্রামে জন্ম নিচ্ছে, তার কৈশোর পেরোতেই সেই গ্রাম সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যেতে পারে।”
কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তায় ধস: টিকে থাকার লড়াই
লবণাক্ততার থাবা: ফসলের মৃত্যু, পেশার রূপান্তর
খুলনা-বরিশালের উপকূলীয় অঞ্চলে একসময়ের সোনালি ধানক্ষেত আজ সাদা লবণের চাদরে ঢাকা। বাংলাদেশ লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণ গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য বলছে: লবণাক্ত জমি ২০০০ সালের তুলনায় ৪০% বেড়েছে। এই সংকট মোকাবিলায় কৃষকরা বেছে নিচ্ছেন অভিনব পথ:
পরিবর্তিত চাষাবাদ পদ্ধতি | অঞ্চল | সাফল্যের হার |
---|---|---|
সালাইন-প্রতিরোধী ধান (ব্রি ধান-১০০) | সাতক্ষীরা | ৭০% ফলন বৃদ্ধি |
ভাসমান বেডে সবজি চাষ | পিরোজপুর | বছরে ৩ ফসল |
কাঁকড়া চাষ | সুন্দরবন অঞ্চল | রপ্তানিতে ২০০ কোটি টাকা আয় |
ফলের বাগানে বিষাদের ছায়া
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমবাগানে ফুটেছে নতুন সমস্যা। অনিয়মিত বৃষ্টিতে আমের মুকুল ঝরে পড়ছে। “২০ বছর বয়সী গাছটাও এবার মাত্র ৫০ কেজি আম দিয়েছে,” অভিমান মধু মিয়ার কণ্ঠে। হর্টিকালচার এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের সমীক্ষা বলছে: ফলের উৎপাদন ১৫% কমেছে গত পাঁচ বছরে।
স্বাস্থ্যঝুঁকি: শরীরে-মনে জলবায়ুর আঘাত
তাপপ্রবাহ: নীরব ঘাতক
এপ্রিল ২০২৪। ঢাকার মিরপুরে এক দিনে ২৩ জনের মৃত্যু। কারণ—হিটস্ট্রোক। আইসিডিডিআর,বি-এর গবেষণা চমকে দেয়:
“তাপমাত্রা ১°C বাড়লে ডায়রিয়া রোগী বাড়ে ৫.৭%, আর শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে ২.৫%।”
মশাবাহী রোগের নতুন রাজ্য
চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ডেঙ্গু এখন সারা বছরই। ২০২৩ সালে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩২১,০০০—ইতিহাসের সর্বোচ্চ (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর)। ডা. তাহমিনা শিরিনের পর্যবেক্ষণ ভয়ানক: “মৌসুমি বৃষ্টির প্যাটার্ন বদলে গেছে। মশার লার্ভা এখন ডিসেম্বরেও পাওয়া যায়।”
অভিবাসন: জলবায়ু উদ্বাস্তুদের করুণ গাথা
ঘর ছাড়ার বেদনা
বরিশালের লালমোহনে জোয়ারের পানি এখন উঠে আসে রান্নাঘরে। শেফালী বেগমের পরিবার গত বছর ঢাকার মিরপুরে এসে আশ্রয় নিয়েছে। “গরুর গোয়াল ভেঙে সমুদ্রে তলিয়ে গেল… ভিটেমাটি ছাড়া হলো চার পুরুষের,”—কথাগুলো তার গলায় আটকে যায়। ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের হিসাব: প্রতি বছর ৫-৭ লাখ মানুষ ঘরছাড়া হয় শুধু জলবায়ুর কারণে।
শহরে বাড়তি চাপ
ঢাকার কাওরান বাজারে এখন প্রতিদিন ভোর ৫টায় লাইনে দাঁড়ান দক্ষিণের জেলার মানুষ। “গ্রামে ফসল নষ্ট, শহরে দিনমজুরি”—বললেন মো. ইলিয়াস। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন (২০২৩) সতর্ক করে: জলবায়ু অভিবাসীদের কারণে ঢাকার ৬০% বস্তি অদূর ভবিষ্যতে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে।
অভিযোজন: প্রকৃতির সাথে সমঝোতার শিল্প
প্রাচীন জ্ঞানের আধুনিক প্রয়োগ
খুলনার দাকোপে নারিকেল বাকলের তৈরি ভাসমান বেডে লাউ চাষ দেখালেন রোকেয়া বেগম। “দাদীর কাছ থেকে শেখা পদ্ধতি,”—তিনি হাসলেন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এই পদ্ধতিকে স্বীকৃতি দিয়েছে “জলবায়ু-স্মার্ট কৃষি” হিসেবে।
প্রযুক্তির সহায়তা
- সোলার প্যানেল চালিত সেচ: রাজশাহীতে ৫০০+ কৃষক ব্যবহার করছেন, ডিজেল খরচ কমেছে ৭০%।
- মোবাইল অ্যাপ ‘কৃষি বন্ধু’: ১০ লাখ ব্যবহারকারী পাচ্ছেন আবহাওয়া ও চাষাবাদ সংক্রান্ত রিয়েল-টাইম তথ্য।
সরকারি উদ্যোগ:
জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (NAP)-এর আওতায় ৮টি মন্ত্রণালয় যৌথভাবে কাজ করছে। খসড়া হয়েছে “জলবায়ু অভিবাসন নীতি ২০২৪”, যাতে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব।
জলবায়ু ন্যায়বিচার: আমাদের দায় ও দায়িত্ব
বৈশ্বিক দায় এড়ানোর খেলা
বাংলাদেশ কার্বন নিঃসরণ করে মাত্র ০.৫৬%, কিন্তু ক্ষতির ৯০% বহন করে। কপ-২৮ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জোরালো প্রশ্ন: “ক্ষতিপূরণ ছাড়া কীভাবে টিকবে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো?
ব্যক্তিগত স্তরে কী করা যেতে পারে?
- জল সংরক্ষণ: বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ট্যাংক বসান (প্রতি বর্ষায় ৫০,০০০ লিটার সংরক্ষণ সম্ভব)।
- স্থানীয় পণ্য কিনুন: আমদানিকৃত খাবারের পরিবহনে কার্বন নিঃসরণ ৩ গুণ বেশি।
- গাছ লাগান: একটি পূর্ণবয়ষ্ক গাছ বছরে শোষণ করে ২১ কেজি CO₂।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: জীবনধারায় পরিবর্তন এখন কোনো ভবিষ্যতের হুমকি নয়—এটি আমাদের বর্তমানের কাঁধে চেপে বসা এক কঠিন বাস্তবতা। রহিমার জমি হয়তো ফিরে পাবে না তার হারানো উর্বরতা, শেফালীর ভিটেমাটি হয়তো সমুদ্রগর্ভেই থাকবে। কিন্তু এই সংকট মোকাবিলায় আমাদের হাতে আছে অভিযোজনের অসাধারণ ক্ষমতা, আছে প্রজন্মের জ্ঞান, আছে একে অপরের প্রতি দায়বদ্ধতা। প্রতিটি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, প্রতিটি স্থানীয় সবজির বাজার, প্রতিটি গাছের চারা—এই ছোট ছোট জয়গুলোই তৈরি করবে একটি জলবায়ু-স্থিতিশীল বাংলাদেশ। আসুন, আজই শুরু করি। প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ নয়, সমঝোতার পথে হাঁটি। আপনার পাড়ায় একটি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ প্রকল্প শুরু করুন—এই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিন।
জেনে রাখুন
১. জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে বাংলাদেশের কৃষিকে প্রভাবিত করছে?
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রার উর্ধ্বগতি ঘটছে। এতে ধান, গমসহ প্রধান ফসলের উৎপাদন কমেছে ১৫-২০%। অনেক অঞ্চলে কৃষকরা ধান চাষ ছেড়ে চিংড়ি বা লবণ চাষে ঝুঁকছেন। বিশেষজ্ঞরা সালাইন-প্রতিরোধী ফসলের জাত উদ্ভাবনে কাজ করছেন।
২. জলবায়ু উদ্বাস্তু কী? বাংলাদেশে এদের সংখ্যা কত?
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষদের জলবায়ু উদ্বাস্তু বলে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ এ অবস্থায় রয়েছেন। প্রতি বছর প্রায় ৫ লাখ মানুষ ঘরছাড়া হন। এদের অধিকাংশই ঢাকা বা চট্টগ্রামের বস্তিতে আশ্রয় নেন।
৩. জলবায়ু পরিবর্তনের স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় কী করা উচিত?
তাপপ্রবাহে হাইড্রেশন বজায় রাখুন, সকাল ১১টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত রোদ এড়িয়ে চলুন। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সপ্তাহে একবার বাড়ির আশেপাশের পানি জমে থাকা স্থান পরিষ্কার করুন। গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে হিটস্ট্রোক ম্যানেজমেন্ট ইউনিট স্থাপন করা জরুরি।
৪. সাধারণ মানুষ কীভাবে অভিযোজনে ভূমিকা রাখতে পারেন?
বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, ছাদে বা বারান্দায় সবজি চাষ (কন্টেইনার গার্ডেনিং), স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত খাবার কেনা—এসব ছোট পদক্ষেপ বড় পরিবর্তন আনে। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো, গাছ লাগানো এবং পরিবেশবান্ধব যানবাহন ব্যবহারও গুরুত্বপূর্ণ।
৫. বাংলাদেশ সরকারের উল্লেখযোগ্য অভিযোজন প্রকল্পগুলি কী?
বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড (BCCTF) থেকে ৮০০+ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রধান উদ্যোগগুলির মধ্যে রয়েছে: উপকূলে সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ, ভাসমান স্কুল, লবণাক্ততা-সহিষ্ণু ফসলের গবেষণা। সাম্প্রতিক “মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান” ২০৪১ সালের মধ্যে জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
৬. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য কোথায় পাব?
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট (BCCT) ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে নিয়মিত তথ্য আপডেট হয়। বিশ্বব্যাংক, আইপিসিসি-র গ্লোবাল রিপোর্ট এবং স্থানীয় গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (CEGIS)-এর প্রতিবেদনও সহায়ক।
লেখক: ড. ফারহানা ইসলাম, পরিবেশ বিজ্ঞানী ও জলবায়ু নীতি বিশ্লেষক
সূত্র:
- বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট (BCCT) – bcct.gov.bd
- IPCC Sixth Assessment Report (2023) – ipcc.ch
- বিশ্বব্যাংক: Climate Migration in Bangladesh (2023)
- বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল – barc.gov.bd
- স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২৪
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।