মানুষের কষ্টের টাকা ব্যাংকে জমা থাকে এই ভরসায় যে প্রয়োজনে তা সহজেই পাওয়া যাবে। কিন্তু শরিয়াভিত্তিক পাঁচটি ব্যাংক একীভূত হওয়ার আলোচনায় থাকায় গ্রাহকদের সেই ভরসা এখন ভেঙে পড়েছে। অনেকেই নিজের শাখা থেকে টাকা তুলতে না পেরে এক শাখা থেকে অন্য শাখায় ছোটাছুটি করছেন।
চাহিদামতো টাকা তো দূরের কথা, অনেক সময় নিজের সঞ্চয়ের সামান্য অংশও মিলছে না। এতে প্রয়োজন মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন আমানতকারীরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা এই সংকট শুধু ব্যক্তিগত নয়, ভেঙে দেবে দেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক নিরাপত্তা এবং বাড়াবে বৈষম্য।
লক্ষ্মীপুরের গৃহিণী রিমা বেগমের উদাহরণই ধরা যায়। নিজের সঞ্চয় তেমন বেশি নয়। তবুও সামান্য টাকার জন্য ঢাকায় আসতে হয়েছে তাকে। খিলগাঁও শাখায় গেলেও টাকা পাননি, শেষে যেতে হয়েছে মতিঝিলে।
তিনি অভিযোগ করেন, ‘বিপদের দিনে যাতে কাজে লাগে সেজন্যই টাকা জমিয়েছি। কিন্তু এখন জরুরি প্রয়োজনে তুলতেই পারছি না। আমরা অসহায়।’
অন্যদিকে মেয়ের বিয়ের জন্য ছয় বছর ধরে টাকা জমিয়েছিলেন আমির হোসেন। শেষ কিস্তির টাকা পাবেন কি না এ নিয়ে ছিল বড় দুশ্চিন্তা। অবশেষে দুই মাস অপেক্ষার পর টাকা পান তিনি। বললেন, ‘ভীষণ টেনশনে ছিলাম। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর রহমতে পেয়েছি।’
রিমা কিংবা আমির হোসেনের মতো আরও অনেকেই প্রতিদিন মতিঝিলের শাখাগুলোতে ভিড় করছেন। কিন্তু সেখানেও শাখার দুরবস্থা চোখে পড়ছে। কোনো কোনো ব্যাংক মাসে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা করে দিচ্ছে গ্রাহকদের। কেউ কেউ সে টাকাতেই সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার অনেকেই ফিরছেন খালি হাতে।
এই পাঁচ দুর্বল শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকের ভাগ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে লাখ লাখ আমানতকারীর ভাগ্য। কেউ জমিয়েছেন হজের টাকা, কেউবা সন্তানের বিদেশে পড়াশোনার স্বপ্ন পূরণের জন্য। কারও হয়তো জরুরি চিকিৎসার খরচ বা সপ্তাহের ওষুধ কেনার টাকা। কিন্তু ব্যাংকের অনিশ্চয়তার কারণে এসব স্বপ্ন ও প্রয়োজন থমকে গেছে।
খিলগাঁও তালতলার একটি শাখায় প্রতি সপ্তাহে মাত্র এক হাজার টাকা তুলতে আসেন আলী সাহেব। তার অভিযোগ, ‘টাকাই দিতে পারছে না। অফিসারদেরও বেতন দিতে পারছে না। শেয়ারহোল্ডাররা কিছুই ভাবছে না।’
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ব্যাংক খাতের এই দুরবস্থা কেবল ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, বরং দেশের অর্থনীতির ওপরও বড় আঘাত আনবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শাহাদাৎ হোসেন সিদ্দিকী বলেন, ‘এতে মানুষের কল্যাণ ব্যাহত হচ্ছে। সমাজের সামগ্রিক চাহিদাও ধসে পড়ছে। এক-তৃতীয়াংশ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ মানে এক-তৃতীয়াংশ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও ব্যর্থ। এর সঙ্গে দারিদ্র্য, বঞ্চনা এবং নানা খরচ জড়িয়ে আছে।’
শুধু অর্থনীতিবিদরাই নন, আইন বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, আমানতকারীদের স্বার্থকে অবহেলা করার সুযোগ নেই। দুর্নীতির মাধ্যমে লোপাট হওয়া অর্থ কোথায় গেছে, তা খুঁজে বের করে ফিরিয়ে আনতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম. সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘এই টাকা কেউ নিজের নামে রাখে না। কারও শালি, কারও শাশুড়ি, কারও শ্বশুর বা স্ত্রী হঠাৎ ধনী হয়ে যায়। সেই টাকা খুঁজে বের করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে আনতে হবে। যেন দুর্নীতির সম্পদ কেউ ভোগ করতে না পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।’
আর্থসামাজিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, শুধু ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতার জন্য নয়, দেশের অর্থনীতির স্বার্থেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় এই সমস্যার সমাধান করা জরুরি।
সূত্র : সময় নিউজ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।