ধর্ম ডেস্ক : চলছে হজের মৌসুম। হাজি সাহেবরা রবের প্রেমে ছুটে চলছেন কাবার পানে। ধন্য হচ্ছেন অফুরন্ত কল্যাণের বারিধারায় অবগাহন করে। চক্ষু শীতল করছেন মহান আল্লাহর অনন্য সব নিদর্শন দর্শনে।
মক্কায় অবস্থিত হাজারো নিদর্শনের মধ্যে জমজম কূপ অন্যতম। প্রায় চার হাজার বছর আগে আল্লাহর কুদরতি ইশারায় গড়ে ওঠা এই কূপ নিয়ে মুসলিম তো বটেই, অমুসলিমদের মধ্যেও রয়েছে সীমাহীন কৌতূহল। লিখেছেন মোস্তফা কামাল গাজী
কূপের ইতিহাস
বরকতময় এ কূপ গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে আশ্চর্য এক ইতিহাস। তখন ছিল হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর নবুয়তকাল। আরবের মরু অঞ্চলে মানুষকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেওয়ার কাজে নিমগ্ন তিনি। আল্লাহর পক্ষ থেকে একের পর এক কঠিন পরীক্ষা দিচ্ছেন এবং অত্যন্ত সফলভাবে উত্তীর্ণ হচ্ছেন। হজরত ইসমাইল (আ.) জন্ম নেওয়ার পর আরো কঠিন এক পরীক্ষার সম্মুখীন হলেন। নির্দেশ এলো, প্রিয় পুত্র ইসমাইল ও স্ত্রী হাজেরা (আ.)-কে রূঢ় মরুর বুকে নির্বাসনে দিয়ে আসার। আল্লাহর মহান হুকুম পালনার্থে ইবরাহিম (আ.) তাঁর পরিবারকে নির্বাসন দিতে নিয়ে এলেন ধু ধু মরীচিকাময় আরবের একটি উপত্যকায়। এটি ছিল এমন একটি উপত্যকা, যেখানে মানুষ তো দূর, কোনো পশু-পাখিরও অস্তিত্ব ছিল না। শাম থেকে ইয়েমেন এবং ইয়েমেন থেকে শামে যেসব বাণিজ্য কাফেলা যাতায়াত করত, শুধু তারাই ওই উপত্যকায় সাময়িকভাবে তাঁবু স্থাপন করত। এ ছাড়া বছরের বাকি সময় এটি আরব উপদ্বীপের অন্য সব অঞ্চলের মতোই মানবশূন্য হয়ে পড়ে থাকত। এ ধরনের ভীতিপ্রদ অঞ্চলে বসবাস করা একজন নারীর জন্য অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও অসহনীয় ব্যাপার ছিল। মরুভূমির দগ্ধকারী উত্তাপ ও তার উষ্ণ বাতাস হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর চোখের সামনে যেন মৃত্যুর ভয়ংকর ছায়ামূর্তিকে উপস্থাপন করেছিল। এই নিদারুণ পরিস্থিতি দেখে তাঁর মনটা ডুকরে কেঁদে উঠল। তিনি সওয়ারির পশুর লাগাম ধরে অশ্রুসজল চোখে পরিবারের জন্য দোয়া করলেন, ‘হে প্রভু, এ স্থানকে নিরাপদ শহর ও জনপদে পরিণত করো। এর অধিবাসীদের মধ্য থেকে যারা মহান আল্লাহ ও শেষ বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে, তাদের বিভিন্ন ধরনের ফল ও খাদ্য রিজিক হিসেবে প্রদান করো। ’ (সুরা : বাকারা : ১২৬)
হজরত ইবরাহিম (আ.) বিভীষিকাময় মরূদ্যানে প্রিয় পরিবারকে নির্বাসনে রেখে চলে এলেন বিষণ্ন মনে। তপ্ত বালুচরে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের খাদ্য ও পানি ফুরিয়ে গেল এবং হাজেরা (আ.)-এর স্তন্য গেল শুকিয়ে। পানির তৃষ্ণায় হজরত ইসমাইল (আ.) সঙ্গিন অবস্থার সম্মুখীন হয়ে পড়লেন। মা হাজেরা (আ.) ছেলের এ করুণ অবস্থা দেখে দিশাহারা হয়ে পড়লেন। এক ফোঁটা পানির আশায় তিনি এদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলেন। তিনি সাফা পাহাড়ের মরীচিকাকে পানির নহর মনে করে দৌড়ে গেলেন সেখানে। কিন্তু দেখলেন, তপ্ত বালুকাময় প্রান্তর ছাড়া সেখানে কিছুই নেই। সাফা পাহাড়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন মারওয়া পাহাড়ে বইছে স্বচ্ছ পানির স্রোতধারা। তাই দৌড়ে গেলেন সেখানে। কিন্তু সেখানেও মরীচিকা ছাড়া কিছু পেলেন না তিনি। এভাবে একটু পানির আশায় সাফা থেকে মারওয়া ও মারওয়া থেকে সাফা পাহাড়ে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করে একসময় হতাশ হয়ে ফিরে এলেন। এদিকে ইসমাইল (আ.)-এর অবস্থা আরো করুণ হতে লাগল। তিনি ধারণা করলেন, আর কিছুক্ষণের মধ্যে তারা মৃত্যুপথযাত্রী হতে চলেছেন। তাঁদের এ করুণ মুহূর্তে মহান আল্লাহ তাআলা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়া কবুল করলেন। ক্লান্ত-শ্রান্ত মা দেখতে পেলেন, হজরত ইসমাইল (আ.)-এর পায়ের তলদেশ থেকে বইছে স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা। চোখ জুড়ানো এমন দৃশ্য দেখে হজরত হাজেরা (আ.)-এর আনন্দের সীমা রইল না। তাঁর চোখে তখন যেন খুশির দ্যুতি চমকাচ্ছিল। তিনি সে পানি পান করলেন এবং ছেলেকে পান করালেন। সেটিই পরবর্তী সময় জমজম কূপ নামে পরিচিতি লাভ করে।
হজরত হাজেরা (আ.) জমজমের নালায় খেজুর বীজ বুনে দিলেন। বরকতি পানির ছোঁয়া পেয়ে অল্প দিনেই গাছ বড় হয়ে গেল এবং ফল ধরতে শুরু করল। ধু ধু মরু প্রান্তরে প্রকৃতির সবুজ অরণ্যের খোঁজ পেয়ে বিভিন্ন ধরনের পাখি এসে বাসা বাঁধল হাজেরা (আ.)-এর লাগানো খেজুরডালে। জুরহম গোত্র বাণিজ্যিক কাজে এ পথ ধরে শাম যাচ্ছিল। আকাশে পাখির ওড়াউড়ি দেখে ভাবল, আশপাশে নিশ্চয় কোথাও পানির ঝরনা আছে। খুঁজতে খুঁজতে তারা হজরত হাজেরা (আ.)-এর কাছে পৌঁছল। এমন সুন্দর পরিবেশে মুগ্ধ হয়ে তারা হাজেরা (আ.)-এর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সেখানেই স্থায়ী বসবাস শুরু করে। হজরত ইসমাইল (আ.) সেখানেই বেড়ে ওঠেন এবং পরবর্তী সময় জুরহম গোত্রের এক নারীকে বিয়ে করেন।
এভাবে কাটল অনেক বছর। তত দিন পর্যন্ত মক্কা নগরীর শাসন কর্তৃত্ব ও জমজম কূপের দখলদারি জুরহম গোত্রের হাতেই ছিল। কিন্তু পবিত্র মক্কা নগরীতে জনগণের আমোদ-প্রমোদের প্রসার ঘটলেও তাদের শৈথিল্য, উদাসীনতা ও চারিত্রিক দুর্বলতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেলে আল্লাহর গজব নেমে আসে। ফলে একসময় জমজম কূপের পানি শুকিয়ে যায়। এদিকে খোজয়া গোত্র জুরহম গোত্রকে আক্রমণ ও ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছিল। জুরহম সরদার মাদ্দাদ ইবনে আমর কাবা শরিফের জন্য হাদিয়াস্বরূপ সোনার দুটি হরিণ এবং কয়েকটি তলোয়ার তৈরি করেছিলেন। তিনি যখন নিশ্চিত হলেন শিগগিরই খোজয়া গোত্র আক্রমণ করবে এবং তিনি তাদের কাছে পরাজিত হয়ে ক্ষমতা হারাবেন তখন খোজয়া গোত্র যেন সোনার তৈরি হরিণ ও তলোয়ারের অধিকারী না হতে পারে, তাই তিনি সেগুলোকে জমজম কূপে নিক্ষেপ করে মাটি দিয়ে তা ভরাট করে ফেলেন। একদিন সত্যি খোজয়া গোত্র আক্রমণ করল এবং জুরহম গোত্র তাদের কাছে পরাজিত হয়ে দেশ ত্যাগ করে চলে গেল ইয়েমেনে। নবী করিম (সা.)-এর চতুর্থ ঊর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ কুসাই বিন কিলাবের মক্কার শাসন কর্তৃত্ব অর্জন করার আগ পর্যন্ত খোজয়া গোত্র মক্কা নগরী দখল করে রাখে। কিছুদিন পর কুসাই বিন কিলাব থেকে শাসনভার চলে আসে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দাদা আবদুল মুত্তালিবের হাতে। তিনি জমজম কূপ ফের খননের ইচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু কূপটির আসল অবস্থান কেউ জানত না। অনেক অনুসন্ধানের পর সেটির তথ্য মিলল অবশেষে। তিনি পুত্র হারিসকে সঙ্গে নিয়ে কূপ খননের কাজে লেগে গেলেন। খননকালে জুরহম গোত্রের পুঁতে রাখা সোনার তৈরি হরিণ ও তলোয়ার আবদুল মুত্তালিবের হাতে চলে আসে। তিনি সেগুলো দিয়ে পবিত্র কাবাঘরের দরজা নির্মাণ করেন। (তারিখে ইয়াকুবি : ১/২০৬, সিরাতে ইবনে হিশাম : ১/ ৪৫)
জমজম কূপের ফজিলত
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জমজমের পানি যে যেই নিয়তে পান করবে, তার সেই নিয়ত পূরণ হবে। যদি তুমি এই পানি রোগমুক্তির জন্য পান করো, তাহলে আল্লাহ তোমাকে আরোগ্য দান করবেন। যদি তুমি পিপাসা মেটানোর জন্য পান করো, তাহলে আল্লাহ তোমার পিপাসা দূর করবেন। যদি তুমি ক্ষুধা দূর করার উদ্দেশ্যে তা পান করো, তাহলে আল্লাহ তোমার ক্ষুধা দূর করে তৃপ্তি দান করবেন। এটি জিবরাইল (আ.)-এর পায়ের গোড়ালির আঘাতে হজরত ইসমাইল (আ.)-এর পানীয় হিসেবে সৃষ্টি হয়েছে। ’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৪৩)
জমজমের পানি পানের নিয়ম
১. দাঁড়িয়ে পান করা
২. তিন শ্বাসে পান করা
৩. পানের সময় এই দোয়া পড়া—
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা ইলমান নাফিআ, ওয়া রিজকান ওয়াসিয়া, ওয়া শিফাআন মিন কুল্লি দা-ইন। ’
অর্থ : ‘হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে কল্যাণকর জ্ঞান, প্রশস্ত রিজিক এবং যাবতীয় রোগ থেকে আরোগ্য কামনা করছি। ’ (দারা কুতনি : ৪৬৬)
বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে জমজমের পানি
বিজ্ঞানী মাশারো ইমোটো জমজমের পানি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেছেন, ‘জমজম পানির মতো গুণ ও বিশুদ্ধতা পৃথিবীর অন্য কোনো পানিতে পাওয়া যাবে না।’ তিনি জমজমের পানি পরীক্ষা করতে নানো নামের প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। এর দ্বারা জমজম পানির ওপর গবেষণা করে দেখতে পান যে যদি জমজম পানির এক ফোঁটা সাধারণ পানির এক হাজার ফোঁটায় মিশ্রিত হয়, তবু সাধারণ পানি জমজম পানির সমান গুণ লাভ করতে পারবে না। জমজম পানির প্রতি ফোঁটায় এই পরিমাণ খনিজ পদার্থ রয়েছে, যা অন্য কোনো পানিতে পাওয়া যাবে না। তিনি অন্য আরো কিছু পরীক্ষা করে দেখতে পান, জমজম পানির গুণ বা উপকরণ পরিবর্তন করা যায় না। এমনকি তিনি জমজম পানির পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করেন। কিন্তু কোনো পরিবর্তন হয়নি, সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ ছিল পানি।
তিনি আরো দেখতে পান, যদি নিয়মিত এই পানির ওপর কোরআন পাঠ করা হয়, তাহলে এটি সব ব্যাধির চিকিৎসার ক্ষমতা লাভ করে। সুবহান আল্লাহ! নিশ্চয়ই আল্লাহর এটি একটি বিশেষ কুদরত।
জমজম কূপের বর্তমান চিত্র
বাদশাহ আবদুল আজিজ বিন সৌদের হাতে বর্তমানে জমজম কূপ আধুনিক রূপ নিয়েছে। কূপের পূর্ব ও দক্ষিণে পানি পান করানোর জন্য দুটি স্থান নির্মাণ করেন তিনি। দক্ষিণ দিকে ছয়টি এবং পূর্ব দিকে তিনটি ট্যাপ লাগান। কাবাঘরের ২১ মিটার দূরে অবস্থিত কূপটি থেকে ২০ লক্ষাধিক ব্যারেল পানি প্রতিদিন উত্তোলিত হয়। কূপটি বর্তমানে আন্ডারগ্রাউন্ডে রয়েছে। কূপের পানিবণ্টনের জন্য ১৪০৩ হিজরিতে সৌদি বাদশাহর এক রাজকীয় ফরমান অনুযায়ী হজ মন্ত্রণালয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ইউনিফায়েড ‘জামাজেমা দপ্তর’ গঠিত হয়। এই দপ্তরে একজন প্রেসিডেন্ট, একজন ভাইস প্রেসিডেন্টসহ মোট ১১ জন সদস্য ও পাঁচ শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী নিয়োজিত আছেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।