আলমগীর খন্দকার: ডাকাতিয়া নদীর তীর ঘেঁষে বিস্তীর্ণ বাগান। সে বাগানে থরে থরে ফলে আছে নানা ফল। এর কিছু চেনা, অনেকগুলোই অচেনা। চেনা ফলগুলোরও জাত অজানা। অচেনা, অজানা হবেই বা না কেন? এরা যে বিদেশি! চেনা, অচেনা নানা উন্নত জাতের বিদেশি ফলের এই বাগান তৈরি করেছেন কৃষি উদ্যোক্তা হেলাল উদ্দিন।
হেলাল উদ্দিনের ব্যতিক্রমী এই বাগান তৈরির গল্পটাও কিছুটা আলাদা। এই গল্প অনুপ্রেরণা হতে পারে আরও অনেকের। জুমবাংলা এই ব্যতিক্রমী গল্পটাই শুনতে চেয়েছিল হেলাল উদ্দিনের কাছে।
যে জমিতে হেলাল তাঁর বাগান করেছেন সেটি ছিল পরিবেশবিধ্বংসী ইটভাটা। ভাটার কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যেত চারপাশ। আশপাশের মাঠে ভালো ফসল ফলত না। ফসলের মাঠ যেন বাঁচার জন্য হাঁসফাঁস করত।
মাঠের এই বাঁচার আকুতি যেন শুনতে পেতেন হেলাল। শুনতে পাবেন-ই না বা কেন, তিনি যে আজন্ম সবুজ অন্তপ্রাণ! তাই তো সেই ভাটা ভরাট করে ফেললেন বালি দিয়ে। উষর সেই মরু-বালিতে গড়ে তুললেন সবুজের সমারোহ। বিদেশ থেকে আনা নানা জাতের ফলের চাষ করতে শুরু করলেন। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে সেখানে যেন এক মরূদ্যান গড়ে তুলেছেন হেলাল।
হেলালের সেই মরূদ্যানের নাম ফ্রুটস ভ্যালি এগ্রো। এটি চাঁদপুরের শাহতলী এলাকায়। ডাকাতিয়ার কোলঘেঁষে তৈরি এই মরূদ্যান এখন জেলার অন্যতম কৃষিপর্যটন এলাকায় পরিণত হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এখান থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বিদেশি বিভিন্ন উন্নত ফলের জাত।
ফ্রুটস ভ্যালির রূপকার হেলাল বলেন, তাঁর বাগানে দুর্লভ হলুদ ড্রাগন, ক্যানসাররোধী করোসলসহ বিদেশের উন্নত ৪১ প্রজাতির ফলগাছ আছে। তিনি চান, এখান থেকে দেশের কৃষি উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে এসব ফল বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য ছড়িয়ে পড়ুক। এতে দেশে ফলের উন্নত প্রজাতি যেমন বাড়বে, তেমনি বিদেশ থেকে এসব ফলের আমদানিনির্ভরতাও কমবে। দেশ সমৃদ্ধ হবে।
হেলাল উদ্দিন পেশায় সাংবাদিক। কর্মজীবনে তিনি দৈনিক যুগান্তরের বাণিজ্য ও অনলাইন বিভাগের প্রধানসহ বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ পদ অলঙ্কৃত করেছেন।
সাংবাদিকতা থেকে কৃষিউদ্যোক্তা কীভাবে– এমন প্রশ্নের জবাবে হেলাল জানান, তিনি বালকবেলা থেকে কৃষির প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। বিশেষ করে ফুল-ফল তাঁর বিশেষ পছন্দের। ঢাকায় তাঁর বাসায়ও ছাদবাগান রয়েছে। এর মধ্যে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে তিনি একপর্যায়ে বাণিজ্য বিভাগের দায়িত্ব পান। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষিউদ্যোক্তাদের খবরাখবর আরও নিবিড়ভাবে অনুসরণ করার সুযোগ পান। এতে একপর্যায়ে তাঁর মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা কৃষিউদ্যোক্তা সত্তাটি জেগে ওঠে। তিনি কৃষি নিয়ে কিছু করার তাগিদ খুঁজে পান।
কৃষি নিয়ে কাজ করলেও গতানুগতিক উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছে ছিল না হেলালের। তিনি চাইতেন ভিন্ন কিছু করবেন। তিনি খেয়াল করলেন, দেশে স্ট্রবেরি, ড্রাগনসহ নানা বিদেশি ফলের বাজার তৈরি হচ্ছে। প্রতি বছর অনেক টাকার ফলফলাদি আমদানি করতে হয়। ফলে হেলাল বিদেশি দামি ফল চাষের ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে উঠলেন।
হেলালকে এই ক্ষেত্রে যেন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল ডাকাতিয়া নদীর তীরে অবস্থিত তাঁদের পৈত্রিক ইটভাটাটি।
তিনি জুমবাংলাকে বলেন, ‘ভাটাটির কারণে আশপাশে ভালো ফসল হতো না। ফলে সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে সেটি বালি দিয়ে ভরাট করি। সেই বালি মাটিতে বাগান করার পরিকল্পনা হাতে নিই। কৃষি কর্মকর্তাসহ অনেকেরই এটি পছন্দ হলো না। তাঁরা যুক্তি দিলেন, বালি মাটিতে ফলন ভালো হবে না। আমি ভাবলাম, ছাদের টবে মাটি ভরে যদি বাগান করা যায়, এখানে কেন নয়?’
এই ভেবে বলা চলে একক প্রচেষ্টায়ই সাংবাদিক হেলাল বাগান গড়ে তোলেন। বিভিন্ন দেশ ঘোরার কারণে তিনি যেখানে যত দুর্লভ ও উন্নত জাতের চারা পেয়েছেন, তার সমাহার ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। এখন এসব ছড়িয়ে দিচ্ছেন।’
মরু-বালিতে কৃষির সফল উদ্যোক্তা হেলালের ভাবনা, তিনি যদি বালি মাটিতে বাগান গড়ে তুলতে পারেন, তবে দেশের বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলেই বা এসবের চাষ হবে না কেন? সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে এসব চরে সফল প্রকল্প গড়ে তোলা যেতে পারে। এতে দেশ কৃষিতে আরও এগিয়ে যাবে।
ফ্রুটস ভ্যালি এগ্রো নামের একটি ফেসবুক পাতাও রয়েছে। সেটি ঘেঁটে দেখা যায়, নানা জাতের গাছে ধরে আছে অচেনা জাতের ফল। বাহারি রঙের এসব ফল বাগানের শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। এসব ফলচাষ ও চারা সংগ্রহের উপায়ও বাতলে দেওয়া আছে সেখানে।
হেলাল জানান, বর্তমানে বাগানে নতুন ৪১ জাতের বিদেশি ফল চাষ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৪৯ জাতের আম, ১৭ জাতের সাইট্রাস, ৭ জাতের অ্যাভোকাডো রয়েছে। আছে ১১ জাতের খেজুর, ২১ জাতের আঙুর, ৪ জাতের রাম্বুটান, ৭ জাতের ড্রাগন, ৬ জাতের করে জাম ও কাঠলিচু।
এসব জাত বিশ্বখ্যাত উচ্চমূল্যের ফল হিসেবে বিবেচিত বলে জানান হেলাল। তিনি বলেন, এসব ফল দেশের প্রচলিত জাত থেকে আলাদা। দেশের বাজারে যেসব ফল পাওয়া যায়, তার চেয়ে এসব ফলের জাত উন্নত। স্বাদে, গন্ধেও এগুলো ব্যতিক্রমী। ফলে বাজারের সঙ্গে এসব মেলানো যাবে না।
হেলাল জানান, তিনি ২০২০ সালের নভেম্বরে ডাকাতিয়া নদীর তীরে সাড়ে ৩ একর জমিতে এই বাগান গড়ে তোলেন। তাঁর আশা, তাঁর মাধ্যমে এসব ফলের জাত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ুক। দেশ এসব ফলের আমদানি থেকে সরে এসে উৎপাদন করুক। এতে দেশ যেমন নতুন ফল পাবে, তেমনি সমৃদ্ধ হবে অর্থনীতি।
হেলাল উদ্দিন যেভাবে উষর জমিতে মরূদ্যান গড়েছেন, তাঁর মতো আরও উদ্যোক্তা তৈরি হয়ে এগিয়ে আসলে গোটা দেশ একদিন ফুলে-ফলে ভরে উঠবে, পরিণত হবে স্বর্গোদ্যানে– এমন আশা তো করাই যায়!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।