৩০৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রাজধানী ঢাকায় প্রায় দুই কোটি ৪০ লাখ মানুষের বসতি। এই ঘনবসতি ইট-পাথরের শহরে অবিরাম হচ্ছে বায়ুদূষণ ও শব্দ দূষণ। ফলে বাসিন্দারা বছরে হাতেগোনা কয়েকদিনও নির্মল বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না। সম্প্রতি বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এক গবেষণার তথ্য বলছে, গত ৯ বছরে রাজধানীবাসী মাত্র ৩১ দিন নির্মল বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পেরেছেন।
এই সময়ে ৮৫৩ দিন অস্বাস্থ্যকর, ৬৩৫ দিন খুব অস্বাস্থ্যকর ও ৯৩ দিন দুর্যোগপূর্ণ বাতাস গ্রহণ করেছেন ঢাকাবাসী। এতে থেকে বোঝা যাচ্ছে ঢাকায় নির্মল বাতাসের কী অপর্যাপ্ততা। তবে, এক প্রহর সময় নিয়ে গেলে এই শহরেই মিলবে নির্মল নিঃশ্বাস নেওয়ার অন্যতম স্থানের। একই সঙ্গে প্রচুর দুর্লভ প্রজাতির উদ্ভিদের দেখা মিলবে।
সেখানে রয়েছে নানা ঐতিহ্য-ইতিহাসে সমৃদ্ধ বৃক্ষরাজির সমাহারও। সেই স্থানটির হলো ঢাকার ওয়ারীতে অবস্থিত বলধা গার্ডেন। ভাওয়াল জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী ১৯০৯ সালে ৩.৩৮ একর জায়গার ওপর এই গার্ডেনটি নির্মাণ করেন। প্রকৃতপক্ষে ফুল ও উদ্ভিদের একটি মিউজিয়াম হলো এই গার্ডেন।
অনেকে বলেন থাকেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য এই বলধা গার্ডেন। ১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাগানটি পরিদর্শনে এসেছিলেন ও জাপান থেকে সংগৃহীত ফুলের অপূর্ব সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার বিখ্যাত ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতাটি রচনা করেন এই বলধা গার্ডেনে বসে। তখন তিনি এ গার্ডেনের বহু বিদেশি ফুলের বাংলা নামকরণ করেছিলেন। যা পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। রবীন্দ্রনাথের এই কবিতা অবলম্বনে সজল সমাদ্দার ছবি নির্মাণ করেছেন ইনফোকেয়ারের প্রযোজনায়।
বেড়াতে এসে তখন কবি এখানকার জয় হাউসে উঠেছিলেন। এক রাত কাটিয়েছিলেনও তিনি। বলধা গার্ডেন দেখে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, পৃথিবীর বহু রাজা-মহারাজার বাড়িতে কত রকম ফুলের বাগানই তো দেখলাম কিন্তু বলধা গার্ডেনের মতো বাগান কোথাও দেখিনি। শুধু কবিগুরুর স্মৃতিধন্য জায়গা হওয়ায় এখনো অনেক র্দশনার্থীর আগ্রহের কমতি নেই।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, কিছুটা বৃষ্টিস্নাত দিন থাকায় গার্ডেনটিতে দর্শনার্থীর সংখ্যা তুলনামূলক অন্যদিনের চেয়ে কম। এদের মধ্যে কেউ কেউ প্রেমিক যুগল, বন্ধু-বান্ধব, আবার কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদেরও নিয়ে এসেছেন। সবাই যার যার মতো করে প্রাণবন্ত সময় কাটাচ্ছেন, নেই কোনো হকার কিংবা ভিক্ষুকের জ্বালাতন। এদের কেউ আড্ডা দিছেন, ছবি তুলছেন কেউবা আবার বৃক্ষের পরিচিতি জানছেন।
এদের মধ্যে নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক প্রেমিক যুগল জানান, এখানে তারা প্রায় আসেন আড্ডা দেন এবং সুন্দর সময় কাটান। তবে অতীতের চেয়ে বর্তমানে গার্ডেনের ব্যবস্থাপনা ভালো হয়েছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে মানুষজনের আসা বাড়ছে বলে জানান তারা।
খানিক পরেই গার্ডেনের পরিদর্শক হাফিজুর রহমান প্রায় একই কথা বলেন। হাফিজ বলেন, গার্ডেনে আগের চেয়ে পরিবেশ অনেক ভালো হয়েছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে মানুষজনের আসা বাড়ছে। এছাড়া আমরা সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখতে গার্ডেনের নানা স্থানে সর্তকবার্তা দিয়ে রেখেছি।
বলধা গার্ডেনটি বর্তমানে দুটি অংশে বিভক্ত ‘সিবলী’ ও ‘সাইকী’। এরমধ্যে সাধারণ র্দশার্থীরা যেতে পারেন সিবলী অংশে যেখানে মূল আকর্ষণ হচ্ছে ঘাট বাঁধানো পুকুর, সূর্যঘড়ি, জয় হাউস, ক্যামেলিয়া, অশোক, আফ্রিকান টিউলিপস ও শঙ্খনদসহ হাজার হাজার বৃক্ষ। এছাড়া বাগানের অন্যতম আর্কষণ ‘সেঞ্চুরি প্লান্ট’। ফুল ফোটে শতবর্ষে একবার। এখানে আরো আছে বাওবাব গাছ। মধ্য আফ্রিকার আদিবাসীরা মিসরের ফারাওদের অনেক আগে থেকেই এই গাছের খোঁড়লে মৃতদেহ রেখে মমি বানাত। সিবলী অংশ প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ও বিকাল ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে।
অন্যদিকে সাইকি অংশটি হচ্ছে উদ্ভিদ শিক্ষা ও গবেষণার অন্যতম স্থান। যেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গবেষণার জন্য আসেন। এই অংশের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে— লাল, নীল, সাদা, হলুদ, জাতের শাপলায় ভরা অনেক শাপলা হাউস, বিরল প্রজাতির দেশি বিদেশি ক্যাকটাস, অর্কিড হাউজ, এনথুরিয়াম, বিচিত্র বকুল, আমাজান লিলি ও সুড়ঙ্গসহ একটি ছায়াতর ঘর। তাই বৃক্ষপ্রেমীরা বলছেন, বৃক্ষ সম্পর্কে জানতে হলে এখানে আসার বিকল্প নাই।
গার্ডেনে দায়িত্বররা জানান, জমিদার নারায়ণ চন্দ্র চৌধুরী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে নানারকম ফুলগাছ ও ঔষধি গাছসহ অন্যান্য উদ্ভিদ এনে রোপণ করেছেন নিজের তৈরি এ গার্ডেনটিতে। এই গার্ডেনে যেমন দেশ বিদেশের বিভিন্ন উদ্ভিদ আছে, ঠিক তেমনই দেশ বিদেশের খ্যাতিমান লোকেরা বলধা গার্ডেন দেখতে আসতেন।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এনে রোপণ করা উদ্ভিদের সম্ভার বলধা গার্ডেন উদ্ভিদ ও ফুলের জাদুঘর নামে খ্যাত। গার্ডেনে প্রধানত বিভিন্ন ধরনের অর্কিড, ক্যাকটাস, গ্রীনহাউসের গাছপালা, জলজ উদ্ভিদ, গোলাপ, শিলালগ্ন প্রজাতি ও দেয়ালের লতা, বৃক্ষশালা ও বিবিধ গাছগাছালি রয়েছে। সব মিলিয়ে এখানে ৮০০ প্রজাতির প্রায় ১৮ হাজার উদ্ভিদ আছে। এখানকার প্রায় সবগুলোই উদ্ভিদই বিদেশ থেকে আনা এবং খুবই দুষ্প্রাপ্য। দেশ বিদেশের অনেক খ্যাতিমান লোকেরা বলধা গার্ডেন দেখতে আসতেন।
কবি রবীন্দ্রনাথ বাগানটি দেখতে এসে জাপান থেকে সংগ্রহ করে আনা ‘ক্যামেলিয়া’ ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার বিখ্যাত ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতাটি রচনা করেছিলেন। বাগানের দেখার মতো উদ্ভিদ হচ্ছে ‘সেঞ্চুরি প্ল্যান্ট’ এটি শতবর্ষে মাত্র একবার ফুটে। মিশরের ফারাওদের মমি করে রাখার জন্য যে উদ্ভিদ ব্যবহার করা হতো সেই ঐতিহাসিক ‘বাওবাব’ গাছটিও এখানে আছে। এটি উপমহাদেশের মধ্যে এমন একটি ঐতিহাসিক উদ্ভিদ উদ্যান যা দর্শনাথীদের জন্য খুবই আকর্ষণীয় স্থান।
দর্শনার্থীদের বিষয়ে জানতে চাইলে টিকেট বিক্রেতা শামীমুল আমীন বলেন, ‘প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০০ জনের মতো দর্শনার্থী আসেন। তবে শীতকালে দর্শনার্থীর কিছুটা বাড়ে। তবে যেকোনো সময় আমরা স্কুল-কলেজের ড্রেস পরিহিত স্টুডেন্ট জুটিকে ঢুকতে দিই না।’ বর্তমানে বলধা গার্ডেনটি জাতীয় বোটানিক্যাল গার্ডেনের একটি অংশ।
জানতে চাইলে সার্বিক বিষয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনের পরিচালক শওকত ইমরান আরাফাত বলেন, ‘আমরা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে দর্শনার্থীদের ভালো পরিবেশ দেওয়ার চেষ্টা করছি। এরই অংশ হিসেবে ই-টিকেটিংসহ নানা বিষয়ে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।