জুমবাংলা ডেস্ক : মিরপুরে শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা। এরপর ডায়মন্ড প্যাকেজিংয়ে হেলপারের কাজ নেন মো. সুমন। তখন তার বয়স ছিল ১৬। ২০১০ সালের ৩১ আগস্ট সন্ধ্যায় মিরপুর-১১ নম্বর বাজার এলাকায় জুয়া (তিনতাস) খেলায় বসেন। সেখানে ১০০ টাকার বাজি হেরে মোবাইলটি খোয়ান। মোবাইল খোয়ানোর ভয়ে সুমন আর পরিবারে ফেরেনি। শুরু হয় তার নানা সংগ্রামী গল্প।
এরপর কখনো রাত কেটেছে বায়তুল মোকাররম মসজিদের বারান্দায়, বাসে, কখনো ফুটপাতে। কখনো ফুলের মার্কেটে কাজ, বাসের হেলপার, হোটেলের বাবুর্চি, চটপটি কিংবা পপকর্নের ব্যবসায় ব্যস্ত সময় কাটান সুমন। সবশেষ বাসের ড্রাইভিং পেশায় যোগ দেন। এরই মধ্যে গত চার বছর আগে বিয়েও করেন সুমন। সেখানে তার সন্তানের জন্মও হয়।
এর মধ্যে সুমনের সন্ধানে বাবা মোজাফফর হোসেন থানায় জিডি করেন, মামলাও করেন। তদন্ত ভার থানা, ডিবি, সিআইডির হাত বদলে সর্বশেষ আসে পিবিআইয়ের হাতে। কিন্তু ১২ বছরে কেউ সন্ধান দিতে পারেনি তার। সুমনও নিজ উদ্যোগে আর ফেরেনি পরিবারে।
তবে সবশেষ সুমনের স্ত্রীর সহযোগিতা আর পিবিআইয়ের লেগে থাকা তদন্তে দীর্ঘ ১২ বছর ঘরছাড়া সুমন ফিরে আসে পরিবারে।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) বিশেষ পুলিশ সুপার মো. জাহাঙ্গীর আলমের তদারকিতে গত ২৩ মে সন্ধ্যায় রাজধানীর কদমতলী থানাধীন মদিনাবাগ এলাকা থেকে সুমনকে উদ্ধার করে তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম।
মঙ্গলবার (২৪ মে) দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁও ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পিবিআইয়ের (ঢাকা মেট্রো-উত্তর) বিশেষ পুলিশ সুপার মো. জাহাঙ্গীর আলম।
তিনি বলেন, ২০১০ সালের ৩১ আগস্ট সকাল ৮টায় বাবা মোজাফ্ফর (৫২) ছেলে সুমন (১৭) নিয়ে বাসা থেকে তার কর্মস্থল ডায়মন্ড প্যাকেজিং গার্মেন্টে যান। এরপর আর বাসায় ফেরেনি সুমন।
বাবা মোজাফ্ফর ছেলের সন্ধান চেয়ে ৫ অক্টোবর পল্লবী থানায় একটি জিডি করেন। এর মধ্যে বাবার কাছে তথ্য আসে সুলায়মান হোসেন (২৮), শাওন পারভেজ (১৮), রুবেল (২০), সোহাগ (২০) ও মানিক (২৫) নামে ক’জন মিলে সুমনকে অপহরণ করেছে। এতে সন্দেহবশত বাদী হয়ে ২০১০ সালের ২৯ অক্টোবর পল্লবী থানায় একটি অপহরণ মামলা করেন তিনি। মামলা নং-৯০।
মামলার শুরুতে তদন্ত করেন পল্লবী থানার এসআই হাবিবুর রহমান। এরপর মহানগর ডিবি পুলিশ ২০১০ সালের ৩০ অক্টোবর দায়িত্ব নেয়। পুলিশ ডিবি পল্লবী জোনাল টিমের মানবপাচার প্রতিরোধ টিমের পরিদর্শক আয়নাল হক ভিকটিমের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন উদ্ধার করেন। মামলার এজাহারনামীয় সুলাইমান, পারভেজকে গ্রেফতার করেন, পুলিশ রিমান্ডে নেন, জিজ্ঞাসাবাদও করেন। কিন্তু সুমনের খোঁজ মেলেনি। পরে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের আদেশে মামলাটির তদন্তভার সিআইডির ওপর অর্পণ করা হয়।
সিআইডি ২০১২ সালের ২৫ এপ্রিল মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে। ইন্সপেক্টর শেখ মতিয়ার রহমান মামলার ভিকটিমকে উদ্ধারের চেষ্টায় সমগ্র বাংলাদেশে বেতার বার্তা পাঠান। অপহণের অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আসামীদের নির্দোষ হিসেবে সিআইডি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করলে বাদীর নারাজি আবেদন করেন। আদালতের নির্দেশে পুনরায় ডিবিতে ন্যস্ত হয় তদন্তভার।
ডিবি পশ্চিমের এসআই শাহীন মোহাম্মদ আমানুল্লাহ গত ২০১৩ সালের ২৫ জুলাই তদন্তভার নেন। এর মধ্যে অনেক তদন্তকারী কর্মকর্তার বদলি হয়। ভিকটিম উদ্ধারের চেষ্টাও চলে। তদন্তকালে ভিকটিম উদ্ধারসহ জড়িত আসামি শনাক্ত না হওয়ায় পল্লবী থানার চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করেন। তবে বরাবরের মতো বাদী আবারো নারাজি দেন। আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্তভার যায় পিবিআইতে।
পিবিআই ঢাকা মেট্রো-উত্তরের পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম গত ২০১৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করেন। তদন্তকালে জানতে পারেন, মামলার ভিকটিম নিখোঁজ হওয়ার ১১ দিন পর একটি মোবাইল নম্বর হতে বাদীর সঙ্গে কথা বলেছেন নিখোঁজ সুমন। ভিকটিমের অবস্থান সর্ম্পকে জানতে চাইলে কোনো উত্তর না দিয়েই ফোনটি রেখে দেয়। এরপর থেকে মোবাইল নম্বরটি বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর তদন্তকালে ওই মোবাইল নম্বরের মালিক শনাক্ত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) সেনিটারি ইন্সপেক্টর আব্দুল হাই (৪৫) জানান, মোবাইল সিমটি তার নামে থাকলেও তিনি ব্যবহার করতেন না। তার দুঃসম্পর্কের ভাগ্নে সালাউদ্দিনের শাহবাগ থানার সামনে ফ্লেক্সিলোডের দোকান। সালাউদ্দিন জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, অনেক অপরিচিত লোকজন দুই টাকা মিনিটে কথা বলতো। কে কখন কল করেছিল তা তিনি শনাক্ত করতে পারেননি।
অপহরণের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় ভিকটিম সুমনকে উদ্ধার করতে না পারলেও পিবিআই ভবিষ্যতে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করা হবে উল্লেখ করে চলতি বছরের ৯ মার্চ পল্লবী থানার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
এর মধ্যে ভিকটিমের সন্ধান মেলে। গত ২৩ মে পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম বিজ্ঞ আদালতে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার আবেদন করেন। বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশে পুনরায় মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করেন। তদন্তকারী বিশেষ টিম তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় ভিকটিম সুমনকে শনাক্তপূর্বক ২৩ মে রাতে কদমতলী থানাধীন মদিনাবাগ এলাকা থেকে উদ্ধার করেন।
সুমন জানান, তিনি শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়, মিরপুরে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। এরপর তিনি ডায়মন্ড প্যাকেজিং এ হেলপার হিসাবে কাজ করেন। ঘটনার দিন মিরপুর-১১ নম্বর বাজার এলাকার চার রাস্তার মোড়ে ৩ তাসের জুয়া খেলায় ১০০ টাকা ধরে হেরে যায়। তার কাছে টাকা না থাকায় তার কাছ থেকে জোরপূর্বক মোবাইল নিয়ে জুয়ারিরা রেখে দেয়।
মোবাইলের বিষয়ে বাবাকে কি উত্তর দেবে, এই ভয়ে বাসায় না ফিরে মিরপুর থেকে গুলিস্তান যায়। সারাদিন গুলিন্তানে ঘোরাফেরা করে। রাতেও বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা করে। পরদিন সকালে বায়তুল মোকাররম মসজিদে শুয়ে থাকেন।
এরপর থেকে কখনো রাত কাটে বায়তুল মোকাররম মসজিদের বারান্দায়, কখনো বাসে, কখনো ফুটপাতে। কখনো ফুলের মার্কেটে কাজ, বাসের হেলপার, হোটেলের বাবুর্চি, চটপটি কিংবা পপকর্নের ব্যবসায় ব্যস্ত সময় কাটান সুমন। রুমা অ্যাকুরিয়াম সেন্টার, পপুলার অ্যাকুরিয়াম সেন্টার ঘুরে ইউসেফ টেকনিক্যাল স্কুল ও বারডেম হাসপাতালের যাত্রী আনা নেওয়া করতো।
ইউসেফ স্কুলের এক ছাত্রীর মায়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান সুমন। প্রায় তিন বছর আগে আগের স্বামীকে তালাক দিয়ে সুমনকে বিয়ে করেন ওই ছাত্রীর মা। এর মধ্যে তাদের একটি ছেলেসন্তান হয়। স্ত্রীকে নিয়ে রায়েরবাগ এলাকার বিভিন্ন স্থানে বসবাস করে আসছিলেন সুমন।
বিশেষ পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, যে সময় সুমন নিখোঁজ হয় তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৬। আজ তার বয়স ২৮। ১৬ বছরের এক তরুণের মোবাইল খোয়ানোয় ভয় আতঙ্কিত হওয়াই স্বাভাবিক। তবে পরিবারের উচিত আরও সহনশীল হওয়া। সন্তানদের ভুলক্রটি সংশোধন করে আগলে রাখা। আর চোরাই মোবাইল দিয়ে নানা অপকর্ম হয়। চোরাই মোবাইল কিনে ব্যবহারের কারণে সুলাইমান নামে ব্যবসায়ীকে জেলে যেতে হয়। যদিও আজ এই মামলায় সব আসামিই নির্দোষ হিসেবে প্রমাণিত হলো।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।