জুমবাংলা ডেস্ক : ফোন রিসিভ করে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন টিপু সুলতান। ফেরি করে বই বিক্রি করার সময় বিতর্কিত কর্মকাণ্ডগুলো নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে যেসব গণমাধ্যমকর্মী প্রশ্ন করেছেন তাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার শুরু করলেন। কয়েকটা গালিও দিয়ে বসলেন।
মুখভর্তি ধবধবে দাড়ি, টাক মাথার ফর্সা এই মানুষটিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে দেশের অনেকেই এখন চেনেন। যারা নিয়মিত ট্রেন ভ্রমণ করেন বিশেষ করে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের রেলে যাতায়াত করেন তাদের অনেকে আগে থেকেই তাকে চেনেন। কারণ, তিনি মূলত ট্রেনে ফেরি করে বই বিক্রি করেন। কিন্তু এবার অমর একুশে বইমেলায় ফেরি করে বই বিক্রি করে আলোচনায় আসেন টিপু সুলতান।
সামাজিক মাধ্যমে টিপু সুলতানের বহু ভিডিও, ছবি এবং মিম ছড়ি পড়েছে। এগুলোতে দেখা যায়, শুধু ইংরেজি ভাষা এবং নিজের বই নিয়েই নয়, বিভিন্ন ইস্যুতে তাকে কথা বলতে দেখা যায়। তার হুটহাট কথায় অনেকেই মজা পান।
তবে তাকে নিয়ে অনলাইন মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক নেতিবাচক সমালোচনাও আছে। বিশেষ করে, বইমেলায় ঘুরতে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের ইংরেজি শব্দের বানান এবং বাংলা অর্থ জিজ্ঞাসা করে আলোচিত-সমালোচিত হন তিনি। এর মাধ্যমে তিনি শিক্ষার্থীদের বিব্রত এবং হেয় করছেন বলে অনেকে মত দেন।
তবে টিপু সুলতান এই অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি জানান, কাউকে হেয় করার জন্য তিনি এমনটা করেন না। অনেক আগে থেকেই তিনি এরকম কুইজ দেন। কুইজের সঠিক উত্তর দিতে পারলে ফ্রিতে বই দেন। বইমেলায়ও এরকমটা করেছেন।
তিনি বলেন, আমাকে কেউ যখন বলে আঙ্কেল বই দেবেন না? আমি তখন বলি, কুইজের উত্তর দাও, বই পাবা। দেখা যাচ্ছে সেখানে দশজন জড়ো হয়ে যায়।
তিনি দাবি করেন, কেউ যদি ইংরেজি জেনে থাকেন তাহলে তার পলিসি দেখে স্যালুট করতে বাধ্য।
তিনি বলেন, ‘আমি হয়তো অনেক জানি না কিন্তু যে পদ্ধতি তৈরি করেছি সেটার কারণে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসর আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।’
সারাদেশের মানুষও যদি বিপক্ষে লেখে তাতেও টিপু সুলতানকে ঠেকাতে পারবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, সারা বিশ্ব থেকে আমার কাছে অর্ডার আসছে।
কে এই টিপু সুলতান?
জানা গেছে, টিপু সুলতানের বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার বোয়লিয়া ইউনিয়নের সরিষাডুলী গ্রামে। তাহাজ উদ্দিন বিশ্বাস এবং রমেছা খাতুনের চার সন্তানের মধ্যে সবার ছোট। ১৯৭১ সালের ২৩ মে জন্মগ্রহণ করা টিপু সুলতানের বয়স ৫৩ বছর চলে। স্ত্রী এবং দুই সন্তান নিয়ে ঢাকায় বসবাস করেন।
নিজ এলাকার বিভিন্ন স্কুল-কলেজে পড়াশুনা করেছেন তিনি। সরিষাডুলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক এবং পাশের গ্রামের শ্যামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। পরে চুয়াডাঙ্গা পৌর কলেজ থেকে এইচএসসি এবং মিরপুর উপজেলার আমলা সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন।
টিপু সুলতান জানিয়েছেন, ছোটবেলা থেকেই তার লেখক হওয়ার স্বপ্ন ছিল।
১৯৯৪ সালে ঢাকায় এসে নিউ ইস্কাটন রোডে একটি কোম্পানিতে চাকরি শুরু করেন তিনি। সেখানে ১১ মাসের মতো চাকরি করার পর সেতু অ্যাসোসিয়েটস নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে সিসিটিভি ও টেলিকমিউনিকেশনের ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসায়ীক ব্যস্ততার মাঝেই ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম বই ‘রেলপথে বাংলাদেশ’। এই ভ্রমণ গাইডটির ১ লাখ ২৩ হাজার কপি বিক্রীত হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
২০২০ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘বোনাস’ বইটি। এই বই দুটির পাশাপাশি তিনি আটটি মানচিত্র তৈরি করেছেন। তার ‘কুষ্টিয়া জেলার মানচিত্র’ এবং ‘মেহেরপুর জেলার মানচিত্র’-তে প্রতিটি ইউনিয়নের পৃথক ভৌগোলিক এলাকা ও গ্রামের সঠিক অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া প্রতিটি উপজেলার পৃথক ভৌগোলিক এলাকা ও ইউনিয়নের সঠিক অবস্থান তুলে তিনি তৈরি করেছেন ‘বাংলাদেশ প্রশাসনিক মানচিত্র’। ৪০৫টি নদীর গতিপথসহ বাংলাদেশের নদ-নদীর মানচিত্র, ৪৬৬টি স্টেশনের নামসহ ‘রেলপথে বাংলাদেশ মানচিত্র’, গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও ভবনের নামসহ ‘ঢাকা সিটির মানচিত্র’, ভারতের প্রতিটি প্রদেশের পৃথক ভৌগোলিক এলাকা, বিভিন্ন রাজ্যের রাজধানী, গুরুত্বপূর্ণ শহর, হাসপাতালের নাম, ঠিকানা, ই-মেইল ও টেলিফোন নম্বরসহ ‘ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থার মানচিত্র’, পৃথিবীর প্রতিটি দেশের পৃথক ভৌগোলিক এলাকা, রাজধানী ও প্রধান প্রধান শহরের নামসহ ‘পৃথিবীর মানচিত্র’ তৈরি করেছেন তিনি।
ফেরি করে বই বিক্রির শুরুর গল্প বলতে গিয়ে টিপু সুলতান জানান, ২০১৭ সালে ‘রেলপথে বাংলাদেশ’ বইটি ১০ হাজার কপি প্রিন্ট করেন। বিভিন্ন রকমের লিফলেট বিতরণ করে কাজ হলো না। বই বিক্রি হলো না। বই বিক্রি করে দেয়ার জন্য কোনো হকার খুঁজে পেলেন না। বইগুলো বাসায় এনে রেখে দিলেন।
এরপর সিদ্ধান্ত নিলেন নিজেই ফেরি করে বই বিক্রি করবেন। এজন্য তিনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেন এবং ২০১৮ সালে ঢাকা থেকে চিত্রা এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠে বই বিক্রি শুরু করে দেন। এরপর থেকে একই কাজই করে যাচ্ছেন। টিপু সুলতান বলেন, ‘যতদিন বেঁচে থাকব, বইয়ের সঙ্গেই থাকব।’
তবে শুরুতে এই কাজ করতে লজ্জা লাগতো বলে জানান টিপু সুলতান। তিনি বলেন, আমি লেখাপড়া শিখেছি, ঠিকাদার মানুষ। আমার বংশ মর্যাদা আছে, অর্থ আছে; আমি ফেরি করবো সেটা কি শোভা পায়? আমি তখন একটা সেনটেন্স (বাক্য) বললে তাকিয়ে দেখতাম কেউ দেখে ফেললো কি না। দেখে ফেললে আমার নিজেরই লজ্জা লাগতো।
এরপর ধীরে ধীরে তিনি এই কাজে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন এবং পেশা হিসেবেই বেছে নেন। ফেরি করে বই বিক্রির সুবাদে অনেক অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসা এবং উপহার পেয়েছেন বলে জানান তিনি।
আগের ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন টিপু সুলতান। এখন শুধুই নিজের লেখা বই বিক্রি করেন। তিনি বলেন, ‘বই নিয়ে আমি অনেক ব্যস্ত। আমার আর সময় নাই।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।