ধর্ম ডেস্ক : মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ। হজরত মুহাম্মদ (স.) এবং সাহাবারা তাদের জীবনে দেখিয়েছেন এ উৎসবের তাৎপর্য। প্রিয় নবীজি (সা.) মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় এসে দেখেন, সেখানকার লোকেরা বছরে দুটি উৎসব পালন করেন। আনন্দ-ফূর্তির মধ্যে পুরো দিন কাটান। দিনভর খেলাধূলায় ব্যস্ত থাকেন।
নবীজি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কিসের উৎসব পালন কর? লোকেরা বলল, আমরাতো জাহেলি যুগ থেকেই এই উৎসব পালন করে আসছি। তবে কেন করছি তাতো বলতে পারবো না। নবীজি বললেন, আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ দুটি দিন নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ঈদুল ফিতর আর ঈদুল আজহা। দিন দুটি তোমরা এ রকম আনন্দ-উল্লাসে কাটাবে। তবে তোমাদের আনন্দ-ফূর্তি তো আর তাদের মতো হবে না। এই দুটি দিন ইবাদতেরও। আনন্দের মধ্যেও ইবাদত হতে পারে। তোমরা দুই ঈদে নামাজ পড়বে; আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবে আর সবাইকে নিয়ে আনন্দ-উল্লাসে দিন কাটাবে। সাহাবারা এই খবরে আনন্দিত হলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে এই খবর ছড়িয়ে পড়লো মদিনার ঘরে। সবার চোখে-মুখে খুশির বন্যা। দ্বিতীয় হিজরি থেকে শুরু হলো ঈদের প্রচলন। মুসলমানরা বছরে দুটি দিন আনন্দের পাশাপাশি ইবাদতের মধ্যে কাটাতে থাকলেন।
সেই ঈদ আমাদের পর্যন্ত এসে হাজির। আমরাও প্রতি বছর দুটি ঈদ পালন করি। সারা বছর প্রতীক্ষায় থাকি কবে আসবে ঈদ; মনখুলে আনন্দ করবো; সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হবে। ঈদের আনন্দতো আনন্দই; কোনো কিছুর সঙ্গেই তুলনা চলে না এই আনন্দের। ঈদ মানেই নতুন জামা। ঈদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ফিরনি-সেমাই; মিষ্টি-পোলাও আরো কত কি! ঈদ এলেই আমরা বেড়াতে বের হই। সারা বছর দেখা-সাক্ষাৎ না হলেও ঈদে অনেকের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। আব্বু-আম্মু, ভাই-বোন, পাড়-প্রতিবেশী সবাইকে নিয়েইতো ঈদ। আর ঈদ মানেই তো আনন্দ। সে আনন্দ মানে না কোনো বাধা। সারা বছর কষ্টে দিন কাটলেও ঈদের একদিন তো আমরা সবাই আনন্দ করি। মনে শত কষ্ট থাকলেও ঈদের দিন কেউ মুখ গোমড়া করে বসে থাকে না।
যেমন ছিল মদিনার সেই ঈদ
আমরা যে ঈদ পালন করি এর সূচনা মদিনা থেকে। এখন থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে। প্রিয় নবীজি (সা.) ঈদ পালন করতেন সাহাবায়ে কেরামদের নিয়ে। আজ ঈদ নিয়ে যত মাতামাতি হয় ততটা ছিল না সে সময়। আজ ঈদকে কেন্দ্র করে যে বিশাল খরচপাতি হয় এর ছিটেফোঁটাও ছিল না তখন। ঈদে আমরা এখন যত আনুষ্ঠানিকতা পালন করি সে সময় তা ছিল না। তবে সেই ঈদে ছিল প্রাণ। সেই ঈদ ছিল নির্মল ও স্বচ্ছ। লোক-দেখানো কোনো ভাব ছিল না সেই ঈদে। সবার অন্তর ছিল স্বচ্ছ; মনে ছিল নিখাদ আনন্দ। নতুন জামা, খাওয়া-দাওয়ার বিশাল আয়োজন না থাকলেও সেই ঈদে আনন্দের কোনো কমতি ছিল না। প্রিয়নবীজিকে কাছে পাওয়াই ছিল সাহাবায়ে কেরামের আসল ঈদ। নবীজির ইমামতিতে দুই রাকাত নামাজ কত প্রশান্তির তা কি ভাবা যায়!
তাই বলে সেই ঈদ নিরস ছিল এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। নবীজির রসবোধ; তার কৌতুক তো কোনো অংশেই কম ছিল না। মা আয়েশা (রা.) বলেন, ঈদের দিন নবীজি ঘরে এলেন। তখন আমার কাছে দুটি মেয়ে গান গাইছিল। তাদের দেখে নবীজি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়লেন। আমার বাবা আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এ অবস্থা দেখে আমাকে ধমকাতে লাগলেন। বললেন, নবীজির কাছে শয়তানের বাঁশি! এ কথা শুনে রাসূল (সা.) বললেন, মেয়ে দুটিকে গাইতে দাও।
আরেক ঈদের বর্ণনা দিয়ে মা আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, ঈদের দিন আবিসিনিয়ার কিছু লোক লাঠি-শোঠা নিয়ে খেলা করছিল। নবীজি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আয়েশা তুমি কি দেখতে চাও? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি আমাকে তার পেছনে দাঁড় করিয়ে দিলেন, আমার গাল তার গালের উপর রাখলাম। তিনি তাদের উৎসাহ দিয়ে বললেন- হে বনি আরফেদা, তোমরা শক্ত করে ধর। এরপর আমি যখন ক্লান্ত হয়ে গেলাম তখন তিনি বললেন, তোমার দেখা হয়েছে তো? আমি বললাম হ্যাঁ। তিনি বললেন: তাহলে এবার যাও।
মদিনা ছিল তখন অনেক কম লোকের বসবাস। অন্য ধর্মের লোকেরাও বাস করতো সেই শহরে। নবীজির মসজিদে তাকে কেন্দ্র করেই জমে উঠত ঈদ। মদিনার অলিতে গলিতে বিরাজ করতো ঈদের আনন্দ। অনেক দূন থেকেও সাহাবারা ছুটে আসতেন নবীজির পেছনে নামাজ আদায় করতে। নবীজি ছোট-বড় সবার আনন্দের প্রতি নজর রাখতেন। ঈদে বালিকা আয়েশা রা.-এর আবদার তিনি পূরণ করেছেন। শিশু হাসান-হোসাইনের ঈদ আনন্দের ভাগিদার হতেন রাসূল সা.। মদিনার ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গেও আনন্দ করতেন নবীজি। শরিয়তের সীমা অতিক্রম না করলে তিনি কোনো আনন্দ-ফূর্তিতে বাধা দিতেন না। ঈদের দিন কিছু ভালো খাবারের ব্যবস্থা রাসুলের ঘরেও হতো। সাহাবায়ে কেরামও নিজের সাধ্যমতো ভালো খাবারের ব্যবস্থা করতেন। মদিনার অলিতে-গলিতে শিশুরা মেতে উঠতো ঈদ আনন্দে। কত পবিত্র সেই আনন্দ; কী স্বচ্ছ সেই ফূর্তি।
ঈদের দিনে নবীজির আমল
নবীজি সা. দিনে বের হয়ে দু’রাকাত ঈদের সালাত আদায় করেছেন। ঈদের দিন নবীজি গোসল করতেন। আতর-খুশবু মাখতেন। ভালো কাপড় পরতেন। রাসূল সা. ও সাহাবায়ে কেরাম ঈদের জামাতে যেতেন পায়ে হেঁটে। যেতেন এক পথে, ফিরতেন অন্য পথে। মুখে থাকতো তাকবির ধ্বনি। পথে পথে সালাম ও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন। ঈদুল ফিতরে নামাজের আগে মিষ্টি জাতীয় কিছু খেয়ে বের হতেন।
আর ঈদুল আজহায় নামাজের জন্য বের হওয়ার আগে কিছুই খেতেন না। নবীজির এই আমলই সবার জন্য সুন্নত। ঈদে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানোও রাসূলের সুন্নত। সাহাবায়ে কেরাম ঈদের দিন পরস্পরকে বলতেন, ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা’ অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা আমাদের ও আপনার ভালো কাজগুলো কবুল করুন। নবীজি দুই ঈদেই ঈদগাহে যাওয়ার আগে সর্বোত্তম পোশাক পরতেন। ঈদের খুতবা পড়া এবং শোনা উভয়টিই সওয়াবের। নবীজি সাহাবায়ে কেরামকে খুতবা শোনার তাগিদ দিতেন। ঈদের নামাজ শেষে রাসূল (সা.) দোয়া করতেন কেঁদে কেঁদে। সঙ্গে চোখের পানি ফেলতেন সাহাবায়ে কেরাম।
ঈদের দিনের করণীয় কিছু দায়িত্ব
ঈদের আনন্দে নিজের আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ নেয়া, তাদের বাড়িতে যাওয়া নবীজির সুন্নত। রাসূল (সা.) বলেন, ‘পরকালে যার বিশ্বাস আছে সে যেন আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখে।’ আর সুখ-দুঃখ দুটি মুহূর্তেই আত্মীয়-স্বজনের পাশে থাকা ইসলামের শিক্ষা। এজন্য ঈদের দিনে পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যেতে হয়। তাদেরকেও নিজের বাড়িতে আদর-আপ্যায়ন করতে হয়। এছাড়া কারো সঙ্গে মনোমালিন্য থাকলে ঈদের দিন তা ধরে রাখা যাবে না। খোলামেলা মন নিয়ে সবার সঙ্গে মিশতে হবে। কোনো মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে মনোমালিন্য যেন তিন দিনের বেশি না থাকে সে নির্দেশ রাসূল (সা.) দিয়েছেন। দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য দূর করার চেষ্টাও ধর্মীয় দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।
ঈদ মানেই আনন্দ। তবে আনন্দের মাত্রা যেন শরিয়তের সীমা অতিক্রম না করে সে দিকেও খেয়াল রাখতে বলেছেন রাসূল (সা.)। আমরা অনেকেই মনে করি, এই দিনে যা খুশি তাই করবো। না, ইসলাম সেই অনুমতি দেয়নি। অন্য সময় যা অবৈধ ঈদের দিনও তা অবৈধই। ঈদের আনন্দটা সবাইকে নিয়ে করতে হবে। যারা অভাব-অনটনের কারণে ঈদ-আনন্দে অংশ নিতে পারছে না তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। প্রয়োজনে নিজে কম খেয়ে, কম টাকার জামা পরে পাড়া-প্রতিবেশীর অভাব মোচন করতে হবে। এটাই নবীজির আদর্শ, এটাই তাঁর সুন্নত।
নবীজি যখন এতিমের বাবা
এক ঈদে নবীজি বের হলেন নামাজ পড়ানোর জন্য। রাস্তার পাশে শিশুরা খেলছিল। কিন্তু মাঠের এক কোণে বসে কাঁদছিল একটি শিশু। পরনে তার ছেঁড়া-ময়লা কাপড়। নবীজির চোখে পড়ল শিশুটি। তিনি শিশুটির কাছে গেলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কাঁদছো কেন? ছেলেটি জানালো, তার মা বেঁচে নেই, বাবাও যুদ্ধে মারা গেছেন। নিকটজন বলতে কেউ নেই। ঈদের আনন্দ করার মতো তার কেউ নেই।
নবীজির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ছেলেটি কান্নায় ভেঙে পড়লো। নবীজির চোখও ছলছল করতে লাগলো। ছেলেটির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, তোমার মা-বাবা নেই তাতে কী! আজ থেকে আমি তোমার বাবা, আর আয়েশা তোমার মা। ফাতেমা তোমার বোন। হাসান-হোসাইন তোমার খেলার সাথী। এতে কি তুমি সন্তুষ্ট! ছেলেটি বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! এতকিছু পেয়েও কি সন্তুষ্ট না হয়ে পারি!
এরপর নবীজি ছেলেটিকে বাসায় নিয়ে গেলেন। গোসল করিয়ে সুন্দর জামা পরতে দিলেন। পেট ভরে খাওয়ালেন। এবার ছেলেটির মুখে ফুটে উঠল তৃপ্তির হাসি। সে ফিরে এলো মাঠে। অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশে গেল আনন্দে। তার খেলার সাথীরা কিছুটা হতবাক হলো। সবাই জানলো, আজ থেকে নবীজি এই ছেলেটির বাবা। তিনিই তার অভিভাবক। এত বড় ছায়া যার মাথায় তার কি কোনো দুঃখ-কষ্ট থাকতে পারে!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।