জুমবাংলা ডেস্ক : ঈশ্বরদীতে এবারেই প্রথম পলিনেট হাউজে বিশ্বমানের উন্নত ক্যাপসিকামের বাম্পার ফলন হয়েছে। আকৃতি ও রং দেখে কৃষি কর্মকর্তারাও হতবাক। কৃষি বিভাগের তত্বাবধানে ছলিমপুর ইউনিয়নের বক্তারপুর গ্রামে জাতীয় পদকপ্রাপ্ত ও এআইপ খেতাবপ্রাপ্ত কৃষক শাজাহান আলী বাদশা ওরফে পেঁপে বাদশার ১ বিঘা জমিতে ক্যাপসিকামের আবাদ হয়েছে। ৪টি ক্যাপসিকামের ওজন হয়েছে প্রায় এক কেজি। ঈশ্বরদীতে এই প্রথম বিদেশি সবজি ক্যাপসিকামের চাষাবাদ শুরু হলো।
অনুকূল আবহাওয়া, উপযুক্ত মাটি এবং কৃষি বিভাগের সার্বিক সহযোগিতায় বাদশা বাণিজ্যিকভাবে এ সবজিটির চাষ করেছেন। আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় পেঁপে বাদশার এক বিঘা জমিতে ‘পলিনেট হাউজ’ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। আর এই পলিনেট হাউজে উৎপাদিত উন্নতমানের ক্যাপসিকাম দেখার জন্য কৃষক ও পাইকারী বিক্রেতারা প্রতিদিন ভীড় জমাচ্ছেন। এক বিঘার ক্যাপসিকাম বিক্রি করে বিশ লাখেরও বেশী টাকা আয় হবে বলে কৃষক ও কৃষি বিভাগ আশা পোষণ করেছেন।
ক্যাপসিকাম
ক্যাপসিকাম বা মিষ্টি মরিচ সারা বিশ্বেই একটি জনপ্রিয় সবজি। বাংলাদেশেও এর জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। মিষ্টি মরিচের আকার ও আকৃতি বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। তবে সাধারণত ফল গোলাকার ও ত্বক পুরু হয়। এ মিষ্টি মরিচ আমাদের দেশীয় প্রচলিত সবজি না হলেও সরকার ইদানিং এর চাষাবাদ প্রসারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। মিষ্টি এ মরিচের বিদেশে রপ্তানির সম্ভাবনাও প্রচুর। গোটা বিশ্বে টম্যাটোর পরেই দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সবজি হচ্ছে মিষ্টি মরিচ।
মিষ্টি মরিচের পুষ্টিমান ও ব্যবহার
পুষ্টিমানের দিক থেকে মিষ্টি মরিচ একটি অত্যন্ত মূল্যবান সবজি। ভিটামিন ’সি’ প্রচুর পরিমাণে থাকার কারণে এবং অতি সহজেই টবেও চাষ করা যায়। অনেক আগে থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ক্যাপসিকাম চাষ করা হচ্ছে। ক্যাপসিকাম লাল, হলুদ ও সবুজ বর্ণে পাওয়া যায়। এর আরেক নাম বেল পিপার। এখন আমাদের দেশেও এটি বেশ জনপ্রিয় একটি খাদ্য উপাদানে পরিণত হয়েছে।
জানা গেছে, ১০০ গ্রামের একটি ক্যাপসিকামে রয়েছে ৮৬০ মিলিগ্রাম প্রোটিন, ৪ দশমিক ৬ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ১ দশমিক ৭০ মিলিগ্রাম চর্বি, ৮০ মিলিগ্রাম ভিটামিন-সি, ৩৭০ আইইউ ভিটামিন-এ। এ ছাড়া সামান্য পরিমাণ ভিটামিন-ই, ভিটামিন-কে, ভিটামিন-বি৬, থায়ামিন, লেবোফেবিস ও ফলিক এসিড পাওয়া যায়। খনিজ উপাদানের মধ্যে ১০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, আয়রন ৩৮০ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ১৭৫ মিলিগ্রাম ও ফসফরাস ২০ মিলিগ্রাম পাওয়া যায়। এ ছাড়া জিংক, কপার, ম্যাঙ্গানিজ ও ফোরাইড সামান্য পরিমাণে পাওয়া যায়।
পলিনেট হাউজ
সবজি চাষের জন্য দেশের সবচেয়ে উপযোগী রাজশাহী বিভাগ। বিভাগের পাবনা জেলার ঈশ্বরদীর কৃষকরা আছেন শীর্ষে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে কৃষিক্ষেত্রে বেড়েছে ঝুঁকি। এ অবস্থায় ক্রমেই হুমকির মুখে পড়ছে কৃষি। তাই কৃষিকে বাঁচাতে নতুন নতুন গবেষণা শুরু করেছে কৃষি বিভাগ। এরই একটি অংশ ‘পলিনেট হাউজ’। কৃষি বিভাগ বলছে, জলবায়ু ঝুঁকির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৃষি বিজ্ঞানের নতুন উদ্ভাবন ইতোমধ্যে কৃষকদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে। সবজি চাষসহ আধুনিক কৃষিকাজের জন্য এখন নতুন প্রযুক্তি ‘পলিনেট হাউজের’ জুড়ি নেই।
ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মিতা সরকার বলেন, কৃষিতে নতুন সংযোজন হয়েছে ‘পলিনেট হাউজ’। এর মাধ্যমে শীতকালীন সবজি যেমন গ্রীষ্মকালে উৎপাদন করা যাবে, তেমনি গ্রীষ্মকালের সবজিও শীতে উৎপাদন করা যাবে। হাতের মুঠোয় নতুন এই প্রযুক্তি চলে আসায় কৃষককে কোনো বেগ পেতে হবে না। ‘পলিনেট হাউজ’ প্রযুক্তির মাধ্যমে আদ্রতা নিয়ন্ত্রণ, ভারী বৃষ্টি, তীব্র দাবদাহ, কীটপতঙ্গ, ভাইরাসজনিত রোগ ইত্যাদির মতো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নিরাপদে থাকবে সব ধরনের কৃষিপণ্য। প্রতি গাছের গোড়ায় পানির ব্যবস্থার সাথে সাথে ডিপ ও মিস্ট ইরিগেশন এই প্রযুক্তিতে রয়েছে।
তিনি জানান, এতে উন্নতমানের পলি ওয়ালপেপার ব্যবহার করা হয়েছে। লোহার অ্যাঙ্গেলের ওপর পলিপেপার দিয়ে তিনটি শেডে এই পলিনেট হাউজ নির্মাণ হয়েছে। ব্যয় হয়েছে প্রায় ২০ লাখ টাকা। স্থায়িত্বকাল ১০ বছরেরও বেশী ধরা হয়েছে। তবে ৪ বছর পর পলি পরিবর্তনে ২ লাখ টাকা খরচ হতে পারে। শাজাহান আলী বাদশাকে প্রথমবারে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে পলিনেট হাউজ তৈরীর পুরো খরচ দেওয়া হয়েছে। এই টাকা শোধ দিতে হবে না। প্রকল্পের মাধ্যমে পৌর এলাকার আরআরপি এ্যগ্রো ফার্ম এবং মুলাডুলির সড়ইকান্দিতে আরও দুটি পলিনেট হাউস তৈরী করে দেওয়া হচ্ছে।
তবে পলিনেট হাউজে চাষাবাদের ব্যয় কৃষককেই করতে হয়েছে। ভারতের ব্যাঙ্গলোর থেকে ৫০ হাজার টাকা খরচ করে উন্নতমানের ক্যাপসিকামের বীজ আনা হয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, এরসাথে সার ও অল্প পরিমাণে কীটনাশকের খরচ হয়েছে। এক বিঘা জমিতে ক্যাপসিকাম চাষে ২ লক্ষাধিক টাকার মতো ব্যয় হলেও বিপুল পরিমাণে মুনাফা অর্জন হবে। পলিনেট হাউজে ক্যাপসিকাম, ব্রকলি, রকমেলন, রঙিন (হলুদ) তরমুজ, রঙিন ফুলকপি, বাঁধাকপি, লেটুস ও অন্যান্য অসময়ের সবজির পাশাপাশি চারা উৎপাদনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া গ্রীষ্মকালেও ফলবে শীতকালীন সবজি। এর মধ্যে টমেটো, ফুলকপি, বেগুন, গাজর ইত্যাদি আছে। অসময়ে সবজি চাষের জন্য পলিনেট হাউস আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির নতুন সংযোজন বলে জানান তিনি।
ক্যাপসিকাম অর্থকরী ও লাভজনক ফসল জানিয়ে মিতা সরকার আরও জানান, পেঁপে বাদশার পলিনেট হাউজে প্রায় ৩,৫০০টি ক্যাপসিকামের গাছ রয়েছে। প্রতি গাছে ১০টি করে ক্যাপসিকামের ফলন এবং ৪-৫টিতে এক কেজি ওজন হয়েছে। হিসেব করে দেখা গেছে, বাজার দর অনুযাযী এক বিঘা থেকে ২০ লক্ষাধিক টাকা আয় অর্জন হবে। এতে এক বছরেই পলিনেট হাউজ তৈরীর খরচ ওঠানো সম্ভব ।
ক্যাপসিকাম চাষি এআইপি শাজাহান আলী বাদশা বলেন, আমাদের দেশের গড়ম আবহাওয়া, রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমন বেশী হওয়ায় উন্মুক্ত স্থানে ক্যাপসিকামসহ অসময়ের বিশেষ করে শীতকালীন সবজি চাষ করা সম্ভব হয়না। অসময়ের সবজির দাম পাওয়া যায় বেশী। পলিনেট হাউজে প্রাকৃতিক দূর্যোাগসহ রোগবালাই, পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করা যায়। উন্নতমানের বীজের সমস্যার কারণে পার্শ্ববর্তী ভারত হতে বীজ আমদানিতে ব্যয় বেশী পড়েছে। ক্যাপসিকাম রোপণ থেকে ওঠানো পর্যন্ত ৪ মাস সময় লাগে। এরপর বিক্রি শুরু হয়। প্রথম দফায় ওঠানোর পর আবারও ওই গাছে ক্যাপসিকাম ফলে। পলিনেট হাউজে ক্যাপসিকামের আবাদ শেষ করে গ্রীস্মকালীন টমেটো চাষ করলে ভালো ফলন এবং অসময়ে ১২০-১৩০ টাকা কেজি দরে টমেটো বিক্রি করা যায়। ক্যাপসিকাম কেনার জন্য পাইকাররা এবং আবাদ দেখার জন্য অন্যান্য কৃষকরা তার জমিতে ভীড় করছেন বলে জানিয়েছেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।