জাহিদ ইকবাল : বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দীর্ঘকাল ধরে একটি ধারণা প্রচলিত ছিল যে, কারওয়ান বাজারের সেই কাঁচঘেরা ভবন দুটিই এদেশের ক্ষমতার আসল উৎস। রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, সবারই ধারণা ছিল প্রথম আলো আর ডেইলি স্টার কেবল পত্রিকা নয়, বরং তারা একটি ‘শ্যাডো গভর্নমেন্ট’ বা ছায়া সরকার। প্রথাগত শাসনব্যবস্থার বাইরেও তারা এতটাই প্রভাবশালী ছিল যে, মনে করা হতো—তাদের আশীর্বাদ বা ‘সবুজ সংকেত’ ছাড়া বাংলাদেশে কেউ ক্ষমতায় বসতে পারে না, আবার ক্ষমতা ধরে রাখতেও পারে না।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে এই প্রতিষ্ঠান দুটির ভূমিকা ছিল অনুঘটকের মতো। বিশেষ করে উত্তাল জুলাইয়ে যখন প্রথম আলো সাহসিকতার সাথে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা এবং মাঠের বাস্তবতা তুলে ধরছিল, তখন সেটি আন্দোলনের দাবানলে ঘি ঢেলে দিয়েছিল। ৫ই আগস্টের পর যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাবশালী নেতাদের সেখানে নিয়মিত যাতায়াত করতে দেখা গেল, তখন সেই প্রভাবশালী ইমেজেরই প্রতিফলন ঘটেছিল জনমনে।

কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাপ্রবাহ ক্ষমতার এই প্রথাগত ধারণাকে এক প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়েছে। আজ প্রশ্ন উঠেছে—ক্ষমতাধর আসলে কে?
পাওয়ার শিফট: কলম বনাম সোশ্যাল মিডিয়া
যাদের একটি সম্পাদকীয়তে প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা কাঁপতেন, তারা আজ নিজ কার্যালয়ের ওপর প্রকাশ্য হামলা ও লুটপাটের মুখে এক প্রকার অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছেন। ধানমন্ডি ৩২-এর মতো জায়গায় যখন সেনাবাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিল, তখন আমরা এক অদ্ভুত ক্ষমতার সমীকরণ দেখলাম। সেখানে পরিস্থিতি শান্ত করতে হ্যান্ড মাইকে শোনানো হলো প্যারিস প্রবাসী পিনাকী ভট্টাচার্যের অডিও বার্তা। পিনাকী নির্দেশ দিলেন, আর মারমুখী জনতা শান্ত হয়ে ফিরে গেল—এই দৃশ্যটি ক্ষমতার এক নতুন সংজ্ঞার জন্ম দিয়েছে। যার ভয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি বাহিনী আজ তটস্থ থাকে, তাকেই কি এখনকার সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করতে হবে?
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা ও বিচারহীনতা
সবচেয়ে বড় বিতর্কের জায়গা তৈরি হয়েছে গণমাধ্যম কার্যালয়ে হামলার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, হামলা যখন চলছিল, তখন তারা নিবৃত্ত করার বদলে সময়ক্ষেপণের পথ বেছে নিয়েছে। এটি কি কোনো মহলের অঘোষিত নমনীয়তা নাকি পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণ? যেখানে হামলাকারীরা পরিচয় গোপন না করে, ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে তাণ্ডব চালাল, সেখানে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো প্রতিরোধ বা তাৎক্ষণিক আইনি ব্যবস্থা না থাকাটা বিস্ময়কর। সিসিটিভি ফুটেজ এবং লাইভ ভিডিওতে হামলাকারীদের চেহারা স্পষ্ট থাকা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার না করা কি এক প্রকার নীরব সমর্থন নয়?
সংস্কার নাকি প্রতিহিংসা?
প্রথম আলোর যে ভবনটি আক্রান্ত হয়েছে, সেখানে প্রথমা প্রকাশনী, মার্কেটিং এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের কার্যক্রম চলত। এটি সরাসরি গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের একটি মহড়া। অথচ এই ঘৃণ্য অপরাধকে এক শ্রেণির মানুষ ‘সংস্কার’ বা ‘জনরোষ’ বলে জায়েজ করার চেষ্টা করছে। তথাকথিত ‘তৌহিদী জনতা’ যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পাত্তা না দিয়ে একের পর এক স্থাপনা ভাঙচুর করে এবং রাষ্ট্র সেখানে দর্শক হয়ে থাকে, তখন আইনের শাসন নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
আজ প্রথম আলো বা ডেইলি স্টার পত্রিকা বের করে নিজেদের অস্তিত্বের প্রমাণ দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু যে প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপত্তার ভিত্তিটি নড়ে গেছে, তা কি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে? লুট হওয়া সম্পদ উদ্ধার কিংবা পরিকল্পনাকারীদের বিচারের আওতায় না আনা পর্যন্ত এই ক্ষত শুকাবে না।
ক্ষমতা এখন আর কেবল কারওয়ান বাজারের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে নেই, নেই কেবল সচিবালয় বা গণভবনের চার দেওয়ালে। ক্ষমতা আজ বিভ্রান্ত গণমানুষের আবেগে, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যালগরিদমে এবং আইন অমান্য করার দুঃসাহসে। যদি রাষ্ট্র দ্রুত তার কঠোর ও নিরপেক্ষ অবস্থান নিশ্চিত করতে না পারে, তবে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। ‘সত্যই সাহস’ স্লোগানধারী একটি প্রতিষ্ঠান যখন স্রেফ প্রতিবাদ মিছিলেই সীমাবদ্ধ থাকে এবং রাষ্ট্র যখন অপরাধীদের ধরতে নির্লিপ্ত থাকে, তখন বুঝতে হবে ক্ষমতা এখন আর তথ্যের বা যুক্তির হাতে নেই। এই অস্থির ক্ষমতার পালাবদল বাংলাদেশকে এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
লেখক পরিচিতি : সিনিয়র সাংবাদিক ও সমাজকর্মী।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



