জুমবাংলা ডেস্ক : কার্তিক-অগ্রহায়ণ দুই মাস হেমন্তকাল। ঋতুচক্রে এখন অগ্রহায়ণ চলমান। এ বছর হেমন্তের মাঝামাঝি থেকেই হালকা শীত পড়তে শুরু করে। একইসঙ্গে প্রকৃতিতে শিশিরবিন্দু জানান দেয় শীতের আগমনী বার্তা। সকাল ও রাতে তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশায় মোড়ানো থাকছে উত্তরাঞ্চল।
আর সেই শীতের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক থাকা খেজুর রস থেকে এরই মধ্যে বগুড়ায় খেজুর রসের পাটালি গুড় তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন গাছিরা। খেজুরের পাটালি গুড় তৈরি যেন এক মহাযজ্ঞ।
বগুড়ার কয়েকটি উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, খেজুর রস থেকে গুড় তৈরিতে গাছিদের নানান কর্মকাণ্ড।
প্রকৃতির পালাবদলে এখন গ্রামের ঘরে ঘরে খেজুর রসের পিঠা, পায়েস, গুড়ের মুড়ি-মুড়কি ও নানা ধরনের মুখরোচক খাবার তৈরি করার ধুম পড়েছে। সম্প্রতি দিন যত যাচ্ছে শীতের আবহ বেড়েই চলছে। শীতের আগমনে বেশ কিছুদিন ধরেই শুরু হয়েছে খেজুর রস সংগ্রহের কাজ। প্রতি বছরের মতোই কার্তিক মাস (অক্টোবর-নভেম্বর) থেকে রস সংগ্রহের জন্য খেজুর গাছ প্রস্তুতের কাজ করে আসছেন গাছিরা।
বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বগুড়া জেলার ১২টি উপজেলার মধ্যে কাহালু, শেরপুর, নন্দীগ্রাম, শাজাহানপুর, আদমদীঘি বরেন্দ্রখ্যাত উপজেলা হিসেবে পরিচিত। এসব উপজেলাসহ অন্যান্য উপজেলা মিলে বগুড়ায় প্রায় ৪৪ হাজারের মতো খেজুর গাছ রয়েছে। তবে কালের আবর্তে খেজুর গাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, এ জেলায় চিরাচরিত সনাতন পদ্ধতিতেই মাটির ভাঁড়ে রাতভর রস সংগ্রহ করা হয়। ভোরের সূর্য ওঠার আগে গাছিরা রস ভর্তি মাটির ভাঁড় গাছ থেকে নামিয়ে পরে মাটির হাঁড়িতে কিংবা টিনের বড় তাওয়ায় জ্বাল দেওয়া হয়। এতে রস শুকিয়ে তৈরি করা হয় গুড় ও লালি। নতুন খেজুর রসের গুড়-পাটালি তৈরির পর তা চলে যাচ্ছে বাজারে। রস সংগ্রহ, গুড় তৈরি ও বাজারে বিক্রি করতে এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন গাছিরা।
প্রায় দশ বছর ধরে বগুড়ায় খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করে পাটালি গুড় তৈরি করছেন রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলার আরপাড়া গ্রামের গাছি ফজলু মিয়া। এবারও পাটালি গুড় তৈরির কাজে চলে এসেছেন বগুড়ার কাহালু উপজেলার হালতা গ্রামে। মো. মিন্টু আলী তার সঙ্গে গুড় তৈরির কাজ করে আসছেন নিয়মিতভাবে। তবে এ বছর তারা দুইজন আলাদাভাবে দল গঠন করে করছেন রস আহরণ ও পাটালি গুড় তৈরির কাজ।
গাছি ফজলু মিয়া ও মিন্টু আলী জানান, এ বছর তারা দুইজন আলাদাভাবে দল গঠন করে পাটালি গুড় তৈরি করছেন। তারা দুইজন এবার মোট প্রায় ৩০০টি খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করার জন্য উপযোগী করেছেন। সংখ্যায় অনেক বেশি গাছ হওয়ায় তারা আশ্বিনের শুরুতে বগুড়ায় এসে গাছ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করেছেন। প্রস্তুত করা প্রতিটি গাছ থেকে সপ্তাহে দুই-তিনদিন রস সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি গাছে শুরুতে এক থেকে দুই কেজি করে রস সংগ্রহ হলেও আস্তে আস্তে তা বাড়ে। প্রতিদিন ধাপে ধাপে গাছের রস সংগ্রহ করেন তারা।
তারা জানান, প্রায় ১০ বছর ধরে তারা বগুড়া কাহালু উপজেলায় নিয়মিত আসেন খেজুর রস থেকে গুড় তৈরির কাজে। এটিই তাদের ব্যবসা। স্থানীয় বাসিন্দাদের খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে, তা থেকে পাটালি গুড় ও স্থানীয় ভাষায় লালিগুড় তৈরি করে বাজারে বিক্রি করছেন তারা। গত বছর তারা দুইজন একত্রে মোট ১৬০টি গাছের রস সংগ্রহ করেছেন। রস উৎপন্ন করতে গাছের পরিচর্যায় প্রচুর সময় লাগে, তাই সব মিলিয়ে চার মাস তাদের বগুড়ায় থাকতে হয় তাদের।
তারা আরও জানান, প্রথম দিকে প্রতিদিন আনুমানিক পাঁচ কেজি করে পাটালি গুড় তৈরি হয়। তারপর মাঝামাঝি থেকে পুরো মৌসুমে প্রতিদিন ৫০ কেজি থেকে ১২০ কেজি পাটালি ও লালি গুড় তৈরি করা হয়। মানভেদে প্রতি কেজি পাটালি গুড় পাইকারদের কাছে বিক্রি হয় ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা। লালিগুড় মানভেদে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি করা হয়।
গাছ মালিকদের বিষয়ে জানতে চাইলে মিন্টু আলী জানান, রস থেকে গুড় তৈরির জন্য স্থানীয়দের মোট ১২০টি গাছের মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করা আছে তার। এর মধ্যে কোনো ব্যক্তির একটি, দুটি, পাঁচটি বা ১৫-২০টি, আবার কারোও ২০-৩০টি করে গাছ রয়েছে। তাদের এ মৌসুমে প্রতিটি গাছের জন্য ২৮০-৩০০ টাকা বা দেড় থেকে দু’কেজি লালি গুড় দিতে হবে এমন চুক্তি করা হয়েছে। তবে এবছর গুড় তৈরির স্থানটার জন্য ভাড়া গুনতে হচ্ছে না তার।
গাছি ফজলু মিয়া জানান, খেজুর গাছ তৈরির প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পর থেকেই মূলত রস নামানোর পর্ব শুরু হয়। গাছের মাথার নির্দিষ্ট স্থানে বাঁশের বানানো দুটি চোখা বাঁশের তৈরি পেরেক পোঁতা হয়। সঙ্গে দড়ি বা সুতা বেঁধে মাটির পাত্র ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। পাত্রের ভেতর রস পড়ার জন্য বাঁশের তৈরি নালার মতো ভিন্ন একটি খুঁটি পুঁতে দেওয়া হয় সেই গাছের সঙ্গে। এভাবেই গাছির নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে খেজুর রস।
তিনি ও মিন্টু প্রতিদিন দুপুরের দিকে নির্দিষ্ট গাছগুলোতে উঠে তাতে হাঁড়ি ঝুলিয়ে আসেন। এরপর রাত ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার দিকে তারা ঘুম থেকে উঠে গাছ থেকে রস নামানোর প্রস্তুতি নেন। ভোর হতেই সব গাছের রস সংগ্রহ করে তা টিনের বড় তাওয়ায় জ্বালিয়ে পাটালি গুড় ও লালি তৈরির কাজে নেমে পড়েন।
গাছিরা জানান, গুড় তৈরির জন্য শুরুতে টিনের তাওয়াতে রস দিয়ে আগুনে তাপানো হয়। এ সময় তাওয়াতে থাকা রস অনবরত নাড়তে হয়। তারা জ্বালানি হিসেবে খড়, খেজুর ও তাল গাছের শুকনো ডাল-পাতা ব্যবহার করেন। রস জ্বালের ঘণ্টাখানেক পর রস ঘন হয়। এরপর তা নামিয়ে একটি গোলাকার হাঁড়িতে ঢেলে বাঁশের একটি সরু লাঠি দিয়ে ঘোরানো হয়। এক পর্যায়ে সেগুলোর ঘনত্ব আরও বেশি হয় এবং তা কাঠের তৈরি চারকোনা বিশিষ্ট বক্সের মধ্যে ঢেলে ঘণ্টা খানেক সময় রেখে দিলেই হয়ে যায় পাটালি গুড়।
বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী পরিচালক কৃষিবিদ মো. ফরিদুর রহমান জানান, মূলত নভেম্বর থেকে শুরু করে মোটামুটি ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত খেজুর রস সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। ইতোমধ্যেই জেলার বিভিন্ন উপজেলায় গাছিরা এই রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরিতে মাঠে নেমে পড়েছেন। সাধারণত বাণিজ্যিকভাবে কেউ খেজুর গাছ লাগায় না। প্রাকৃতিকভাবেই এসব খেজুরগাছ জন্ম নিয়েছে। পতিত জমি, ভিটা, জমির আইলসহ বিভিন্ন স্থানে এসব খেজুর গাছের দেখা মেলে।
মানুষের ধারণা খেজুর গাছের বয়স বাড়ার কারণে সব গাছ থেকে রস উৎপাদনও হয় না। আবার কিছু কিছু খেজুর গাছ আছে দেখতে অনেক মোটা তাজা হলেও সেই গাছ থেকে রস পাওয়া যায় না। এ কারণে অনেকে গাছ কেটে ফেলে। বগুড়া জেলায় একটা সময় বিপুল সংখ্যক খেজুর গাছ ছিল। মানুষ সিংহভাগ খেজুর গাছ কেটে ফেলেছেন। অবশিষ্ট যে গাছগুলো রয়েছে সেগুলো থেকে গাছিদের মাধ্যমে তৈরি সুস্বাদু পাটালি গুড় মানুষের চাহিদা মেটাচ্ছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।