জাহিদ ইকবাল : খিলক্ষেত ফুট ওভারব্রিজ। ঢাকার বুকে এক ব্যস্ত ধমনী। যেখানে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ লোক যাতায়াত করে। অথচ, এই অতি গুরুত্বপূর্ণ জনপথটি আজ পরিণত হয়েছে এক ‘লজ্জার মঞ্চে’, এক অন্তহীন ‘চোর-পুলিশ’ খেলার অনিয়মিত আসরে। পথচারীর অবাধ চলাচলের অধিকার, একটি জনবহুল এলাকার শৃঙ্খলা এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা— সবকিছুই যেন এই সামান্য ওভারব্রিজটির নিচে চাপা পড়ে মুখ লুকাচ্ছে। যখন গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায়, তখনো কানে বাজতে থাকে ১৬ আগস্টের সেই ওপেন হাউজ ডে-র প্রতিধ্বনি— যেখানে শত শত মানুষ কেবল একটিই দাবি তুলেছিলেন: ‘খিলক্ষেত ওভারব্রিজ বাস স্ট্যান্ডকে হকার ও ভিক্ষুক মুক্ত করুন!’
পরিবর্তনের প্রত্যাশা যখন নিছক এক স্বপ্নকথা
৫ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশে আমরা যখন পরিবর্তনের এক সোনালী স্বপ্নে বিভোর ছিলাম, তখন বুক বেঁধেছিলাম এক নতুন সুশৃঙ্খল বাংলাদেশের আশায়। আমরা ভেবেছিলাম, এবার হয়তো প্রশাসন জনগণের প্রত্যাশাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে। ভেবেছিলাম, পুরনো দিনের সেই ‘যেমন চলছে চলুক’ মানসিকতা থেকে মুক্তি মিলবে। নিকুঞ্জে খিলক্ষেত থানা পুলিশের উদ্যোগে আয়োজিত সেই ‘ওপেন হাউজ ডে’ আমাদের সেই আশা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। হাজারো মানুষের সামনে খিলক্ষেত বাস স্ট্যান্ডকে ‘হকার ও ভিক্ষুক মুক্ত এলাকা’ ঘোষণার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলো। সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে খবর প্রকাশিত হলো।
কিন্তু হায়! বাংলাদেশের বাস্তবতার কাছে সেই ঘোষণা যেন এক নিছক ‘স্বপ্নকথা’ হয়েই রইল।
এলাকাবাসী গভীর হতাশার সাথে দেখছেন, সেই ‘বিশ্ব বেহায়া’ হকার ও ভিক্ষুক গোষ্ঠী, যাদের উচ্ছেদের জন্য জনমানুষ এত আকুল, তারা এক মুহূর্তের জন্যও পিছু হটেনি। পুলিশের একটি ‘টোকেন অপারেশন’ হলেই তারা উঠে যায়। কিন্তু সেই অভিযান শেষ হওয়ার সাথে সাথেই— ঠিক যেন মৌমাছির ঝাঁকের মতো— তারা পুনরায়, সগৌরবে এবং লজ্জাহীনভাবে ওভারব্রিজ ও ফুটপাত দখল করে বসে পড়ে। এই দৃশ্য দেখতে দেখতে এলাকার মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে: এটা কি কোনো সমাধান? নাকি কেবলই লোক দেখানো এক প্রহসন? এই চোর-পুলিশের খেলায় ভুক্তভোগী তো কেবলই সাধারণ পথচারী ও এলাকাবাসী।
যখন পুলিশও অসহায়ত্বের কথা জানায়
সবচেয়ে মর্মস্পর্শী এবং হতাশাজনক দিকটি হলো, যখন এই বিষয়ে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও খিলক্ষেত থানা পুলিশের কাছে একটি স্থায়ী ও কার্যকর সমাধানের অনুরোধ করা হলো, তখন তাদের কাছ থেকে এলো এক অপ্রত্যাশিত উত্তর— ‘আমরা অসহায়। আপনারা (এলাকাবাসী) সবাই মিলেই এগিয়ে আসুন।’
এই কথাগুলো শুনে বুকটা ভেঙে যায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে অভাগা দেশের চিত্র। যে দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেদের অপারগতার কথা এভাবে প্রকাশ্যে ঘোষণা করে, সেই দেশের সাধারণ মানুষ ভরসা রাখবে কার ওপর? জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাদের মৌলিক সাংবিধানিক দায়িত্ব, তারাই যখন ‘অসহায়ত্বের’ বুলি আওড়ান, তখন
ভুক্তভোগী জনমানুষের কাঁধে কে দেবে আশা ভরসার হাত? তাহলে কি আমরা ধরেই নেব, জনদুর্ভোগ লাঘব করার ন্যূনতম দায়িত্ববোধটুকুও এই প্রশাসনিক কাঠামোয় অবশিষ্ট নেই? নাকি এই অপারগতার আড়ালে লুকিয়ে আছে অন্য কোনো ‘অদৃশ্য শক্তির’ হস্তক্ষেপ, যার কাছে প্রশাসনের হাত-পা বাঁধা?
অভাগা দেশ, অভাগা আমরা সবাই
খিলক্ষেত ওভারব্রিজ আজ শুধুমাত্র একটি অবৈধ দখলের স্থান নয়, এটি আমাদের সামগ্রিক প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং ব্যর্থতার এক জ্বলন্ত প্রতীক। এই দৃশ্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়, গতানুগতিক যে ধারায় বাংলাদেশ ছিল— সেই ধারাতেই আমরা পড়ে আছি। পরিবর্তন হয়নি অফিস, আদালত, থানা-পুলিশ, কিংবা জনসেবার মানসিকতা।
যে কোনো সুস্থ সমাজে, জনগণের সম্মিলিত দাবির মুখে প্রশাসন দ্রুত এবং কার্যকর ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু আমাদের দেশে, দাবি ওঠে, প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। এই অব্যবস্থা, এই দায়বদ্ধতার অভাব আমাদের সমাজকে তিলে তিলে ক্ষয় করে দিচ্ছে।
খিলক্ষেতের পথচারীর ভিড়ে যখন অসহায়ের মতো মাথা নিচু করে চলতে হয়, তখন কেবলই মনে হয়, আমরা সবাই অভাগা! এই জন্মভূমি নামক দেশটাতে যে যেভাবে পারে বেঁচে রয়, বেঁচে থাকে। আইন, শৃঙ্খলা আর অধিকারের কথা এখানে কেবলই বইয়ের পাতায় লেখা থাকে।
যদি এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান না হয়, যদি ফুটপাত ও ওভারব্রিজ জনমানুষের জন্য মুক্ত না হয়, তাহলে ওপেন হাউজ ডের মতো অনুষ্ঠান আয়োজনের সার্থকতা কোথায়? প্রশাসনকে এই নীরবতা ভাঙতে হবে।
জনগণের দেওয়া ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত প্রশাসনকে জনগণের সেবায় নিজেদের ‘অসহায়ত্ব’ ঝেড়ে ফেলে স্থায়ী, কঠোর এবং অবিচল পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায়, পরিবর্তনের স্বপ্ন ভেঙে যাবে, আর খিলক্ষেতের ‘চোর-পুলিশ’ খেলা চিরকাল চলতে থাকবে— আমাদের সকল অধিকারকে পদদলিত করে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও সমাজকর্মী।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।