সেদিন সকালবেলা মসজিদে গেলাম। সামনের সারিতে দাঁড়ানো ছোট্ট সাকিব, বয়স আট কি নয় হবে। ইমাম সাহেবের পিছনে দাঁড়িয়ে সে সুরা আল-বাকারার শেষ আয়াতগুলো তেলাওয়াত করছে – নিখুঁত উচ্চারণে, গভীর আবেগে। তার কণ্ঠে শোনা যাচ্ছিল না কোনও দ্বিধা, কোনও টেনে-আনা মুখস্থ করা। মনে হচ্ছিল যেন সে আয়াতগুলোকে স্পর্শ করছে, তার অন্তরে ধারণ করছে। চোখে জল এসে গেল। কতজনই না স্বপ্ন দেখে পুরো কুরআনুল কারিম হিফজ করার, কিন্তু পথের কষ্ট, সময়ের অভাব আর পদ্ধতির জটিলতায় সেই স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। কুরআন মুখস্থ করার কৌশল শুধু একটি দক্ষতাই নয়, এটি একটি আত্মার রূপান্তরের যাত্রা। আর এই যাত্রাকে সহজ, আনন্দময় ও ফলপ্রসূ করে তোলার জন্যই আজকের এই আলোচনা। ভয় পাবেন না, বয়স বা পূর্ব অভিজ্ঞতা কোনও বাধা নয়। শুধু দরকার সঠিক পদ্ধতি, অটুট ধৈর্য আর একটুখানি দৃঢ় সংকল্প। চলুন, জেনে নিই কিভাবে আপনি এই পবিত্র জ্ঞানকে আপনার হৃদয়ে ধারণ করতে পারেন।
Table of Contents
কুরআন মুখস্থ করার কৌশল: আপনার যাত্রাকে করুণাময় করে তোলার সহজ পদ্ধতি!
কুরআন মুখস্থ করা শুধুমাত্র শব্দগুলোকে মনে রাখার বিষয় নয়। এটি আল্লাহর বাণীর সাথে একটি গভীর সম্পর্ক স্থাপনের প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াকে সহজ ও টেকসই করার জন্য কিছু প্রমাণিত ও কার্যকরী পদ্ধতি অনুসরণ করা অপরিহার্য। এই বিভাগে আমরা এমনই কিছু সহজ পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, যা যেকোনো বয়সের, যেকোনো পটভূমির মানুষকে তার হিফজের স্বপ্ন পূরণে সাহায্য করবে:
- নিয়্যতের শুদ্ধতা: যাত্রার মূল ভিত্তি:
- সর্বপ্রথম এবং সর্বাগ্রে গুরুত্বপূর্ণ হল আপনার নিয়্যত (ইচ্ছা) পরিশুদ্ধ করা। মুখস্থ করার পেছনে উদ্দেশ্য কি? শুধু সমাজে সম্মান লাভের জন্য? নাকি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, তাঁর বাণীকে বুঝা এবং জীবনে বাস্তবায়ন করার জন্য? হাদিসে এসেছে: “নিশ্চয়ই সকল আমল নিয়্যতের উপর নির্ভরশীল।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)। একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়্যতই আপনাকে ধৈর্যশীল ও স্থির রাখবে যখন কঠিন সময় আসবে। প্রতিদিন শুরু করার আগে এই নিয়্যতটি স্মরণ করুন।
- নিয়মিততা: ক্ষুদ্র পদক্ষেপের জয়গান:
- কুরআন মুখস্থ করার কৌশল এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হল নিয়মিততা। প্রতিদিন অল্প পরিমাণ (যেমন: ৩-৫ লাইন বা ১/৪ পৃষ্ঠা) নির্দিষ্ট সময়ে মুখস্থ করুন। এটা প্রতিদিন ১০ পৃষ্ঠা মুখস্থ করার চেষ্টা করে এক সপ্তাহ পর হাল ছেড়ে দেওয়ার চেয়ে শতগুণ ভালো। মনে রাখবেন: নিয়মিত ছোট ছোট অগ্রগতি শেষ পর্যন্ত বিশাল সাফল্যের দিকে নিয়ে যায়। আপনার দৈনন্দিন রুটিনের সাথে হিফজের সময়কে অটুটভাবে জুড়ে দিন – ফজরের নামাজের পর, দুপুরের বিরতিতে বা এশার নামাজের আগে।
- গুণগত তেলাওয়াত: শোনা এবং বলা:
- মুখস্থ শুরুর আগে সঠিক উচ্চারণ (তাজবিদ) শেখা অপরিহার্য। একজন যোগ্য ক্বারী বা উস্তাযের কাছে শুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত শিখুন। প্রতিদিন যা মুখস্থ করবেন, তা প্রথমে মনোযোগ সহকারে শুনুন (অডিও রেকর্ডিং, ক্বারিদের তেলাওয়াত)। তারপর বারবার উচ্চস্বরে তেলাওয়াত করুন। কান দিয়ে শুনা এবং জিহ্বা দিয়ে উচ্চারণ – এই সমন্বয় স্মৃতিতে গভীর ছাপ ফেলে। নিজের তেলাওয়াত রেকর্ড করে শুনলে ভুলগুলো সহজে ধরতে পারবেন।
- বুঝে মুখস্থ করা: অর্থের সাথে সংযোগ:
- শুধু শব্দ নয়, আয়াতের অর্থও জানার চেষ্টা করুন। বাংলা তাফসীর বা সহজ ব্যাখ্যা পড়ুন। আয়াতের অর্থ ও প্রেক্ষাপট জানলে তা শুধু মুখস্থ করাই সহজ হয় না, হৃদয়েও গেঁথে যায়। এটি আপনার ঈমানকেও শক্তিশালী করবে। যখন আপনি জানবেন যে “ইন্না মাআল উসরি ইউসরা” (নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে সহজ আছে) আয়াতটি মুখস্থ করছেন, তখন জীবনের প্রতিকূলতার মাঝেও তা আপনাকে আশা ও সাহস জোগাবে।
- পুনরাবৃত্তি ও রিভিশন: স্মৃতিকে সুদৃঢ় করা:
- কুরআন মুখস্থ করার কৌশল এ পুনরাবৃত্তিই হল সাফল্যের চাবিকাঠি। শুধু নতুন অংশ মুখস্থ করলেই হবে না, পূর্বে মুখস্থ করা অংশের নিয়মিত রিভিশন (দোহার) দিতে হবে। প্রতিদিন নতুন অংশ মুখস্থ করার আগে অন্তত গত দুই দিনের মুখস্থকৃত অংশ রিভিশন করুন। প্রতি সপ্তাহে সপ্তাহের সব অংশ একত্রে রিভিশন করুন। প্রতি মাসে মাসের সব অংশ রিভিশন করুন। “আল-হিফযু ফিল লিসান ফিল আদায়াত” – স্মৃতি জিহ্বায় পুনরাবৃত্তির মধ্যে নিহিত।
- সহায়ক পদ্ধতি:
- লিখে ফেলা: মুখস্থ করার সময় আয়াতগুলো হাতে লিখুন। এই কার্যকলাপ দৃশ্য ও স্পর্শ স্মৃতিকে সক্রিয় করে।
- গ্রুপ স্টাডি: বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের সাথে জুট বেঁধে মুখস্থ করুন। একে অপরকে শুনিয়ে দিন, ভুল ধরিয়ে দিন। এটি অনুপ্রেরণাদায়ক ও কার্যকর।
- দোয়া ও ইস্তেগফার: আল্লাহর সাহায্য চাওয়া সর্বদা সর্বোত্তম পন্থা। মুখস্থ শুরুর আগে, চলাকালীন এবং শেষে দোয়া করুন। ভুল হলে বা ভুলে গেলে ইস্তেগফার করুন, হাল ছাড়বেন না। “রাব্বি যিদনি ইলমা” (হে আমার রব, আমার জ্ঞান বৃদ্ধি কর) – এই দোয়া নিয়মিত করুন।
ধাপে ধাপে হিফজ: একটি টেকসই রোডম্যাপ
এখন আসুন, কুরআন মুখস্থ করার কৌশল কে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য একটি ব্যবহারিক ও ধাপে ধাপে গাইডলাইন দেখে নিই। এই কাঠামো আপনাকে বিশৃঙ্খলা এড়িয়ে সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে:
- উপযুক্ত পরিবেশ ও সময় নির্বাচন:
- এমন একটি স্থান বেছে নিন যেখানে শান্তি ও নিরবতা বিরাজ করে, বিক্ষেপ কম। ঘরের একটি নির্দিষ্ট কোণ, মসজিদের কোনও শান্ত অংশ বা লাইব্রেরি হতে পারে। এমন সময় বেছে নিন যখন আপনার মন সতেজ ও আলস্যহীন থাকে। অধিকাংশের জন্যই ফজরের পরের সময়টি অত্যন্ত ফলপ্রসূ। আলোর দিকে খেয়াল রাখুন – পর্যাপ্ত আলো চোখের ক্লান্তি কমায়।
- একক মনোযোগ (Focus):
- হিফজের সময় শুধু হিফজের উপরই মনোনিবেশ করুন। মোবাইল ফোন বন্ধ করে রাখুন বা ‘ডু নট ডিসটার্ব’ মোডে রাখুন। সামাজিক মাধ্যম, টিভি বা অন্যান্য ডিজিটাল বিক্ষেপ থেকে দূরে থাকুন। এই ৩০-৪৫ মিনিট শুধু আপনাকে এবং কুরআনকে কেন্দ্র করেই কাটুক।
- প্রস্তুতি: তাজবিদ রিভিশন ও অর্থ জেনে নেওয়া:
- আজকে যে আয়াত/পৃষ্ঠা মুখস্থ করবেন, সেটির তাজবিদের নিয়মগুলো (গুন, মদ, ইখফা, ইযহার, ইদগাম ইত্যাদি) দ্রুত রিভিশন করুন। আয়াতের বাংলা অর্থ ও মোটামুটি ব্যাখ্যা পড়ে নিন। এটি আয়াতের সাথে আপনার আবেগগত সংযোগ তৈরি করবে এবং মুখস্থ করা সহজতর করবে।
- শ্রবণ ও অনুসরণ:
- প্রথমে একজন প্রসিদ্ধ ক্বারীর তেলাওয়াত (যেমন শায়খ মিশারি রশিদ, শায়খ সুদাইস, শায়খ হুযাইফি বা আপনার পছন্দের অন্য কেউ) মনোযোগ দিয়ে শুনুন। কুরআনের কপি খুলে রেখে তেলাওয়াতের সাথে সাথে আঙ্গুল দিয়ে আয়াতগুলো ট্র্যাক করুন। উচ্চারণ, ওয়াকফ (বিরতি) এবং তরতিল (সুর) গভীরভাবে লক্ষ্য করুন। এই ধাপটি আপনার কান ও চোখকে প্রশিক্ষণ দেয়। Quran.com বা Bayyinah TV অ্যাপে বিশ্বস্ত তেলাওয়াত ও অনুবাদ পাবেন।
- উচ্চস্বরে পঠন ও খণ্ডিত মুখস্থ:
- এবার নিজে উচ্চস্বরে তেলাওয়াত শুরু করুন। পুরো অংশটি একবার বা দুবার পড়ুন। তারপর আয়াতটিকে ছোট ছোট অর্থবহ খণ্ডে ভাগ করুন (যেমন: একটি ফ্রেজ বা শর্তসাপেক্ষ বাক্য)। প্রথম খণ্ডটি বারবার (৫-১০ বার) উচ্চস্বরে পড়ুন যতক্ষণ না আপনি তা না দেখে বলতে পারেন। তারপর পরের খণ্ডে যান। এক খণ্ড মুখস্থ হয়ে গেলে আগের খণ্ডের সাথে মিলিয়ে পড়ুন।
- সম্পূর্ণ অংশ একত্রিতকরণ ও পুনরাবৃত্তি:
- সবগুলো খণ্ড একত্রিত করে সম্পূর্ণ আয়াত বা অংশটি বারবার (কমপক্ষে ১০-১৫ বার) উচ্চস্বরে তেলাওয়াত করুন। চোখ বন্ধ করে বা দৃষ্টি সরিয়ে রেখে বলার চেষ্টা করুন। যতক্ষণ না তা স্বাচ্ছন্দ্যে ও নির্ভুলভাবে আসছে, ততক্ষণ পুনরাবৃত্তি চালিয়ে যান।
- তাত্ক্ষণিক রিভিশন ও লিখন (ঐচ্ছিক তবে কার্যকর):
- মুখস্থ হওয়ার পর পুরো অংশটি না দেখে এক বা দুইবার তেলাওয়াত করুন। তারপর খাতায় লিখে ফেলুন। লিখতে গিয়ে যদি কোথাও আটকে যান, সেটি চিহ্নিত করুন এবং সেই অংশটুকু আবার বিশেষভাবে মুখস্থ করুন। লিখন প্রক্রিয়া স্মৃতিকে দৃঢ় করে।
- গতকালের রিভিশন:
- নতুন অংশ শুরু করার আগে, গতকাল যতটুকু মুখস্থ করেছেন, তা প্রথমে না দেখে তেলাওয়াত করুন। এটি পূর্ববর্তী অংশকে সতেজ রাখতে সাহায্য করে এবং মুখস্থকৃত অংশগুলোর মধ্যে ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।
প্রযুক্তির সাহায্য: আধুনিক যুগের হিফজ সহায়ক
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তির প্রভাব অনস্বীকার্য। কুরআন মুখস্থ করার কৌশল কে আরও সহজ ও কার্যকর করতে বিভিন্ন ডিজিটাল টুলসকে কাজে লাগানো যেতে পারে:
- হিফজ অ্যাপস (Hifz Apps): স্মার্টফোনের জন্য অসংখ্য হিফজ সহায়ক অ্যাপ রয়েছে (যেমন: Memorize Quran for Kids & Adults, Ayat: Al Quran, Quran Progress, Hifz Companion ইত্যাদি)। এগুলোতে আয়াত আয়াত করে মুখস্থ ট্র্যাক করা যায়, রিভিশন শিডিউল সেট করা যায়, নিজের তেলাওয়াত রেকর্ড করে শোনা যায় এবং দৈনিক লক্ষ্য অনুযায়ী অগ্রগতি মনিটর করা যায়। অনেক অ্যাপে গেমিফিকেশন এলিমেন্টও থাকে যা অনুপ্রেরণা বাড়ায়।
- অডিও বুকমার্কিং ও প্লেব্যাক: অডিও প্লেয়ারে (যেমন: Muslim Pro, iQuran, Quran Majeed) আপনার বর্তমান মুখস্থকৃত সূরাগুলোর প্লেলিস্ট তৈরি করুন। রাস্তায় হাঁটার সময়, রান্না করার সময়, কাজের ফাঁকে ফাঁকে এই তেলাওয়াত শুনুন। এটি নিষ্ক্রিয় শোনা (Passive Listening) হিসেবে কাজ করে এবং স্মৃতিকে সতেজ রাখে। বিশেষ করে যে আয়াতগুলোতে আপনি বারবার ভুল করেন, সেগুলোকে রিপিট মোডে শুনুন।
- অনলাইন কোর্স ও ভিডিও টিউটোরিয়াল: ইউটিউবে অসংখ্য যোগ্য উস্তায ও প্রতিষ্ঠান কুরআন মুখস্থ করার কৌশল নিয়ে বিস্তারিত ভিডিও টিউটোরিয়াল, টিপস অ্যান্ড ট্রিকস শেয়ার করেন। Bayyinah Institute, Quran Revolution, Towards Jannah এর মতো চ্যানেলগুলোতে বিশেষজ্ঞ নির্দেশনা পাবেন। আবার Al-Maghrib Institute, Mishkah Academy বা বাংলাদেশের ফারাবি ইনস্টিটিউট অফ ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ এর মতো প্রতিষ্ঠান অনলাইন হিফজ কোর্সও অফার করে।
- ডিজিটাল কুরআন প্ল্যাটফর্ম: Quran.com, Tanzil.net, Al-Quran.info এর মতো ওয়েবসাইটগুলোতে বিভিন্ন ক্বারীর তেলাওয়াত, একাধিক ভাষায় অনুবাদ, তাফসীর এবং শব্দের অর্থ সহ কুরআন পড়া যায়। মুখস্থ করার সময় এগুলো রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কুরআন মুখস্থ করার কৌশল এর জন্য নির্দিষ্ট সূরার নির্দিষ্ট আয়াত খুঁজে পাওয়া এসব প্ল্যাটফর্মে খুব সহজ।
- সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপস: ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ বা টেলিগ্রামে এমন অনেক গ্রুপ আছে যেখানে হাফেজ ও হিফজ শিক্ষার্থীরা একত্রিত হন। এখানে অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়, সমস্যার সমাধান জানা যায়, ভাব বিনিময় করা যায় এবং একে অপরের অগ্রগতির খবর শুনে নিজেও উৎসাহিত হন। তবে এসব গ্রুপে যুক্ত হওয়ার সময় সঠিক আকিদা ও পদ্ধতি অনুসরণকারী গ্রুপ বেছে নিন।
সতর্কতা: প্রযুক্তি সাহায্যকারী, কিন্তু কখনোই একজন যোগ্য ও বাস্তব জীবনের উস্তাযের বিকল্প নয়। তাজবিদের সূক্ষ্মতা, উচ্চারণের শুদ্ধতা এবং নিয়মিত মূল্যায়নের জন্য একজন শিক্ষকের সাথে সরাসরি সংযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তির ব্যবহার যেন শিক্ষক বা নিয়মিত তেলাওয়াতের বিকল্প না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন।
সাধারণ ভুল ও সেগুলো কাটিয়ে ওঠার উপায়
কুরআন মুখস্থ করার পথ মসৃণ নয়। ভুল, ভুলে যাওয়া, হতাশা আসবেই। এই যাত্রায় সাধারণ কিছু বাধা এবং সেগুলো মোকাবেলার কৌশল:
- ভুলে যাওয়া (Forgetting): এটি সবচেয়ে সাধারণ এবং স্বাভাবিক সমস্যা।
- সমাধান: নিয়মিত রিভিশনই একমাত্র সমাধান। রিভিশনের জন্য একটি কঠোর শিডিউল মেনে চলুন (দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক)। যে অংশ বারবার ভুল হয়, সেটি আলাদা করে লিখে ফেলুন, বারবার পড়ুন এবং অডিও শুনুন। ভুলে যাওয়াকে ব্যর্থতা না ভেবে, রিভিশনের সুযোগ হিসেবে নিন।
- মনোযোগের অভাব (Lack of Concentration):
- সমাধান: নির্দিষ্ট সময় বেছে নিন যখন আপনি সবচেয়ে সতেজ থাকেন। পরিবেশ নিশ্চিত করুন (শান্তি, আলো)। শুরু করার আগে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ে দোয়া করুন। ছোট ছোট সেশনে কাজ করুন (২৫ মিনিট হিফজ, ৫ মিনিট ব্রেক – পোমোডোরো টেকনিক)। মোবাইল ফোন সম্পূর্ণ দূরে রাখুন।
- সময়াভাব (Lack of Time):
- সমাধান: দিনের “মৃত সময়” (Dead Time) খুঁজে বের করুন – অফিস যাওয়ার পথে গাড়িতে/রিকশায় (অডিও শুনুন), দুপুরের খাবারের পরের কিছু সময়, রাতের ঘুমানোর আগে ১৫-২০ মিনিট। অল্প হলেও প্রতিদিনের নিয়মিততা বজায় রাখার চেষ্টা করুন। সপ্তাহে একদিন লম্বা সময়ের চেয়ে প্রতিদিন ১৫-৩০ মিনিট অনেক বেশি কার্যকর।
- হতাশা ও প্রেরণাহীনতা (Frustration & Demotivation):
- সমাধান: নিজের অগ্রগতি ট্র্যাক করুন (হিফজ ডায়েরি বা অ্যাপ ব্যবহার করুন)। ছোট ছোট সাফল্য উদযাপন করুন। নিজের সাথে ধৈর্য ধরুন। হাফেজ সাহাবিদের গল্প, হিফজ যাত্রার অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য শুনুন। মনে রাখবেন, হাদিস: “যে ব্যক্তি কুরআন পড়ে এবং তা মুখস্থ করে… সে নবীদের সঙ্গী হবে।” (সহীহ বুখারী)। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন এবং নিয়মিত দোয়া করুন। হিফজ স্টাডি গ্রুপে যোগ দিন, অন্যদের কাছ থেকে উৎসাহ নিন।
- ভুল তাজবিদ ও উচ্চারণ (Incorrect Tajweed):
- সমাধান: শুরু থেকেই সঠিক তাজবিদের উপর জোর দিন। একজন উস্তাযের তত্ত্বাবধানে শিখুন। নিজে নিজে শেখার সময় বিশ্বস্ত তাজবিদ রিসোর্স (বই, ভিডিও) ব্যবহার করুন। নিজের তেলাওয়াত রেকর্ড করে শুনুন এবং উস্তাযকে শুনিয়ে ভুল ধরিয়ে নিন। কুরআন মুখস্থ করার কৌশল এর ভিত্তিই হল শুদ্ধ উচ্চারণ।
- অর্থ না বুঝে মুখস্থ (Memorizing without Understanding):
- সমাধান: প্রতিদিনের মুখস্থকৃত অংশের বাংলা অর্থ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর পড়ার অভ্যাস করুন। সহজ বাংলা তাফসীর গ্রন্থ (যেমন: তাফসীরে ইবনে কাসীরের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ, তাফসীরে জালালাইন, ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়ার তাফসীর) হাতের কাছে রাখুন। অর্থ জানলে মুখস্থ করা যেমন সহজ হয়, তেমনি আমল করার পথও সুগম হয়।
জেনে রাখুন
- প্রশ্ন: আমি বয়স্ক, আমার কি কুরআন মুখস্থ করা সম্ভব?
- উত্তর: একদম সম্ভব! বয়স কখনও কুরআন মুখস্থ করার পথে বাধা নয়। বরং বয়সের সাথে ধৈর্য, অভিজ্ঞতা ও আন্তরিকতা বাড়ে। নিয়মিত অল্প অল্প করে, সঠিক পদ্ধতিতে চেষ্টা করলে আল্লাহ অবশ্যই সাহায্য করবেন। অনেক প্রবীণ ব্যক্তিও সফলভাবে হিফজ সম্পন্ন করেছেন। মূল বিষয় হল নিয়মিততা ও দোয়া।
- প্রশ্ন: প্রতিদিন কতটুকু সময় দিলে ভালো ফল পাওয়া যাবে?
- উত্তর: সময়ের পরিমাণের চেয়ে গুণগত সময় ও নিয়মিততা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন ৩০-৪৫ মিনিট একাগ্রতার সাথে দিলে দীর্ঘমেয়াদে চমৎকার ফল পাওয়া যায়। এই সময়ে নতুন মুখস্থ, রিভিশন এবং অর্থ বোঝার কাজ সেরে ফেলুন। সপ্তাহান্তে একটু বেশি সময় দিতে পারেন। ধীরে ধীরে অগ্রসর হওয়াই উত্তম।
- প্রশ্ন: মুখস্থ করার সময় বারবার ভুলে যাই, এটা কি স্বাভাবিক?
- উত্তর: হ্যাঁ, এটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং প্রতিটি হিফজ শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতা। কুরআন মুখস্থ করার কৌশল এর মূল অংশই হল ভুলে যাওয়ার পর আবার মনে করা। হতাশ হবেন না। নিয়মিত রিভিশন (দোহার) এই সমস্যা দূর করার একমাত্র উপায়। যে আয়াতগুলোতে বেশি ভুল হয়, সেগুলোকে আলাদা নোট করে বারবার পড়ুন এবং শুনুন।
- প্রশ্ন: কোন সূরা দিয়ে শুরু করা উচিত?
- উত্তর: সাধারণত ছোট ও পরিচিত সূরাগুলো দিয়ে শুরু করা ভালো, যেমন: ৩০তম পারার সূরা আন-নাস থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া। এতে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। অনেক শিক্ষক ২৯তম পারা (সূরা আল-মুলক) বা শেষ দশটি সূরা দিয়ে শুরু করার পরামর্শ দেন। আপনার উস্তাযের সাথে পরামর্শ করে একটি কাঠামো ঠিক করুন। সহজ পদ্ধতি হল ছোট থেকে বড়র দিকে যাওয়া।
- প্রশ্ন: হিফজ করার জন্য কি বিশেষ স্মৃতিশক্তি দরকার?
- উত্তর: বিশেষ কোনও জন্মগত স্মৃতিশক্তি কুরআন মুখস্থ করার পূর্বশর্ত নয়। বরং, এটি একটি শেখার দক্ষতা যাকে নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে বাড়ানো যায়। সঠিক পদ্ধতি (শ্রবণ, উচ্চস্বরে পঠন, পুনরাবৃত্তি, অর্থ বোঝা, রিভিশন) এবং অবিচল অধ্যবসায়ই হল আসল চাবিকাঠি। আল্লাহ তাআলা যাকে ইচ্ছা এই সামর্থ্য দান করেন।
- প্রশ্ন: মুখস্থ করার পর দীর্ঘদিন ধরে রাখার উপায় কি?
- উত্তর: হিফজের স্থায়িত্বের মূলমন্ত্র হল নিয়মিত দোহার (রিভিশন)। পুরো কুরআন মুখস্থ করার পরেও আপনাকে নিয়মিত (সাপ্তাহিক বা মাসিক ভিত্তিতে) পুরো কুরআন তেলাওয়াত করে শুনাতে হবে বা নিজে তেলাওয়াত করে যেতে হবে। নামাজে, বিশেষ করে তারাবিহ বা তাহাজ্জুদে মুখস্থকৃত অংশ পড়া, অডিও শোনা এবং অন্যকে শেখানোও স্মৃতি সংরক্ষণে সহায়ক। হিফজ কখনই ‘সমাপ্ত’ হয় না; এটি একটি চলমান রক্ষণাবেক্ষণের প্রক্রিয়া।
আপনার হিফজ যাত্রা শুধু আয়াতগুলোকে স্মৃতিতে ধারণ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি আল্লাহর নৈকট্য লাভের, আপনার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর পথনির্দেশকে ধারণ করার এক মহান প্রয়াস। কুরআন মুখস্থ করার কৌশল বা সহজ পদ্ধতি হিসেবে যা কিছুই আলোচনা করা হোক না কেন, এর কেন্দ্রে রয়েছে একাগ্র ইচ্ছা, অবিচল ধৈর্য, নিয়মিত সাধনা এবং সর্বোপরি আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা। আজই একটি ছোট্ট পদক্ষেপ নিন। একটি আয়াত দিয়ে শুরু করুন। নিয়মিত হোন। ভুলে গেলে আবার শুরু করুন। দেখবেন, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সেই ছোট্ট সাকিবের মতো আপনিও কুরআনের আয়াতগুলোকে আপনার হৃদয়ের গভীরে ধারণ করে ফেলেছেন – আপনার জীবনের আলোকবর্তিকা হয়ে। এখনই সময়, আপনার হিফজের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার। শুরু করে দিন!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।