ধর্ম ডেস্ক : শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ধর্ম ইসলাম শ্রমিকদের প্রতি সুবিচারের নির্দেশ দিয়েছে। ইসলাম শ্রমের প্রতি যেমন মানুষকে উৎসাহিত করেছে, তেমনি শ্রমিকের সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পূর্ণ প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর নামাজ সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করো।’ (সুরা : জুমুআ, আয়াত : ১০)
অত্র আয়াতে আল্লাহ ফরজ নামাজ আদায়ের পর রিজিকের সন্ধানে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
এক হাদিস শরিফে এসেছে, ‘ফরজ ইবাদতগুলোর পর হালাল উপার্জন ফরজ দায়িত্ব।’ (তিরমিজি)
অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘হালাল উপার্জনগুলোর মধ্যে তা সর্বোত্তম, যা কায়িক শ্রম দ্বারা অর্জন করা হয়।’ (মুসলিম)
অন্য হাদিসে এসেছে—‘নিজ হাতের শ্রমে উপার্জিত জীবিকার চেয়ে উত্তম আহার কেউ কখনো গ্রহণ করেনি।’ (বুখারি, হাদিস : ২০৭২)
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (সা.) শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষকে অত্যন্ত সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতেন।
কারণ যারা মানুষের সুখের জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিজেদের তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেয়, তারা তো মহান আল্লাহর কাছেও মর্যাদার অধিকারী। শ্রমের মর্যাদা বোঝাতে গিয়ে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কারো জন্য নিজ হাতের উপার্জন অপেক্ষা উত্তম আহার্য আর নেই। আর আল্লাহর নবী দাউদ (আ.) স্বহস্তে জীবিকা নির্বাহ করতেন।’(বুখারি, হাদিস : ২৭৫৯)
শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম বদ্ধপরিকর। আর একজন শ্রমিকের সবচেয়ে বড় অধিকার বা দাবি হলো, তার শ্রমের যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক লাভ করা। এ জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা শ্রমিককে তার শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই পারিশ্রমিক দিয়ে দাও। (ইবনু মাজাহ, হাদিস : ২৪৪৩)
মালিকের করণীয়
ইসলামে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক হবে পিতা-সন্তানের মতো। নিজের পরম আত্মীয়ের মতোই শ্রমিকের সঙ্গে আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণ করা, পরিবারের সদস্যদের মতোই তাদের আপ্যায়ন করা, শ্রমিকের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার প্রতিটি মুহূর্তের প্রতি মালিকের খেয়াল রাখা এবং তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনা করা মালিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। শ্রমিককে তার প্রাপ্য পূর্ণভাবে যথাসময়ে প্রদান করাও মালিকের একটি প্রধান দায়িত্ব।
অনেক সময় শ্রমিকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মালিকরা উপযুক্ত মজুরি না দিয়ে যৎসামান্য মজুরি দিয়ে শ্রমিকদের অধিকার বঞ্চিত করেন। এ ধরনের মালিকদের সম্পর্কে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘মহান আল্লাহ বলেন, কিয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হবে। তাদের মধ্যে একজন হলো—যে শ্রমিকের কাছ থেকে পূর্ণ শ্রম গ্রহণ করে অথচ তার পূর্ণ মজুরি প্রদান করে না।’ (বুখারি, হাদিস : ২৯৮৪)
শ্রমিকের কর্তব্য
অন্যদিকে একজন শ্রমিকের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো, চুক্তি মোতাবেক মালিকের প্রদত্ত কাজ অত্যন্ত নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে সম্পাদন করা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ ওই শ্রমিককে ভালোবাসেন যে সুন্দরভাবে কার্য সমাধা করে।’ (সহিহুল জামে, হাদিস : ১৮৯১)
কিন্তু কোনো কোনো শ্রমিক মালিকের কাজে ফাঁকি দিয়ে নিয়মিত হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে বেতন উত্তোলন করে থাকে, যা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এ জন্য তাকে কিয়ামতের মাঠে অবশ্যই বিচারের সম্মুখীন হতে হবে।
আর যদি শ্রমিক তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করে, তাহলে তার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) দ্বিগুণ পুরস্কারের কথা ঘোষণা করে বলেন, ‘তিন শ্রেণির লোককে দ্বিগুণ সওয়াব প্রদান করা হবে। তাদের মধ্যে এক শ্রেণি হলো—ওই শ্রমিক যে নিজের মালিকের হক আদায় করে এবং আল্লাহর হকও আদায় করে।’ (মেশকাত, হাদিস : ১১)
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরো বলেন, সৎ শ্রমিকের জন্য দুটি প্রতিদান রয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘যেই সত্তার হাতে আবু হুরায়রার প্রাণ তাঁর কসম! যদি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ, হজ ও আমার মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহারের ব্যাপারগুলো না থাকত, তাহলে আমি শ্রমিক হিসেবে মৃত্যুবরণ করতে পছন্দ করতাম।’ (বুখারি, হাদিস : ২৫৮৪)
শ্রমিকের জন্য আবশ্যক
শ্রমিকদের যে বিষয়টি মনে রাখা আবশ্যক তা হলো—বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তিস্বাধীনতা আছে। সুতরাং মে দিবসে যেকোনো ব্যক্তির যানবাহন চালানোর বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট খোলা রাখারও অধিকার আছে। তাতে বাধাদানের অধিকার কারো নেই।
কিন্তু আমাদের দেশে মে দিবসে যদি কেউ যানবাহন চালায় বা দোকানপাট খোলা রাখে তাহলে উচ্ছৃঙ্খল কিছু শ্রমিককে গাড়ি ভাঙচুর করতে এবং দোকানপাট জোর করে বন্ধ করে দিতে দেখা যায়, যা আদৌ সমর্থনযোগ্য নয়। অনুরূপভাবে হরতাল-ধর্মঘটও বর্জন করা আবশ্যক।
পরিশেষে বলা যায়, এ সুন্দর পৃথিবীর রূপলাবণ্যে শ্রমিকদের কৃতিত্বই অগ্রগণ্য। কিন্তু শত আক্ষেপ! সভ্যতার কারিগর এই শ্রেণি সর্বদাই উপেক্ষিত, অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত। উদয়াস্ত উষ্ণ ঘামের স্যাঁতসেঁতে গন্ধ নিয়ে খেটে যে শ্রমিক তার মালিকের অর্থযন্ত্রটি সচল রাখে, সেই মালিকেরই অবিচারে শ্রমিকদের অচল জীবনটি আরো দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
এটাকে সেই মৌমাছির সঙ্গে তুলনা করা যায়, যারা দীর্ঘ পরিশ্রমের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করে চাকে সঞ্চয় করে, কিন্তু তার ভাগ্যে এক ফোঁটা মধুও জোটে না। সুতরাং সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় মালিক-শ্রমিকের বৈরিতাপূর্ণ সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে ইসলামী অর্থব্যবস্থা ও শ্রমনীতি বাস্তবায়ন করে তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। আর এ জন্য সর্বাগ্রে উচিত ইসলাম প্রদর্শিত মালিক-শ্রমিক নীতিমালার পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ ও বাস্তবায়ন। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোক। আমিন!
লেখক : মুফতি ইয়াসীন আরাফাত
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।