সকালের হালকা আলোয় জানালার পাশে বসে যখন চোখ বুলাই কুরআনের পাতায়, শুধু কি শব্দগুলো পড়া হয়? না, সেটি তো এক গভীর সাক্ষাৎ। নিজের ভেতরের সেই ‘আমি’-র সাথে, যে প্রতিদিন নানান আবিলতায় জড়িয়ে পড়ে। কত গ্লানি, কত আক্ষেপ, কত অহংকার আর লোভের স্তূপে ঢাকা পড়ে যায় আমাদের মূল সত্তা – সেই ‘রুহ’। ক্লান্ত আত্মা যখন হাঁপিয়ে ওঠে, খোঁজে মুক্তির পথ, তখনই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে কুরআনের আলোকে আত্মশুদ্ধি-র মহৎ অধ্যায়। এটি কেবল কিছু নিয়ম-কানুনের সমষ্টি নয়; এটি একটি জীবনবদলের যাত্রা, নিজের গভীরে ডুব দেওয়ার এক অলৌকিক অভিজ্ঞতা, যার লক্ষ্য পবিত্র কুরআন মাজিদে ঘোষিত সেই চূড়ান্ত গন্তব্য: “নিশ্চয়ই সফলকাম হয়েছে সে, যে শুদ্ধ হয়েছে।” (সূরা আল-আ’লা, আয়াত: ১৪)। এই লেখায় আমরা সেই যাত্রারই পাথেয় খুঁজব, কুরআনের অমোঘ বাণীকে হাতড়ে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আত্মশুদ্ধির আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে তুলব, যেন খুঁজে পাই সেই কাঙ্ক্ষিত রুহানী মুক্তি।
কুরআনের আলোকে আত্মশুদ্ধি: ধারণা ও গুরুত্বের গভীরে
কুরআনের আলোকে আত্মশুদ্ধি বলতে কী বোঝায়? এটা শুধু বাহ্যিক পবিত্রতা বা নামাজ-রোজার পালন নয়। কুরআন আমাদের শেখায়, আত্মশুদ্ধি (তাযকিয়াতুন নাফস) হল অন্তরের গহীনে লুকিয়ে থাকা কুপ্রবৃত্তি (নাফস), কু-চিন্তা, মন্দ অভ্যাস ও পাপের আবরণ সরিয়ে ফেলে সেই স্বচ্ছ আত্মাকে জাগিয়ে তোলা, যার সৃষ্টিই হয়েছে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে: “যে নিজেকে শুদ্ধ করল, সে সফলকাম হল। আর যে নিজেকে কলুষিত করল, সে ব্যর্থ হল।” (সূরা আশ-শামস, আয়াত: ৯-১০)। এই আয়াত দুটিই আত্মশুদ্ধির সাফল্য ও অবহেলার ব্যর্থতার মধ্যে চূড়ান্ত পার্থক্য টেনে দেয়। এটি কোনো ঐচ্ছিক আমল নয়; বরং প্রতিটি ঈমানদারের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। নবীজি (সা.)-এর মিশনকে আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন: “তিনিই সেই সত্তা যিনি নিরক্ষরদের মাঝে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তাঁর আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমাহ। অথচ ইতোপূর্বে তারা ছিল ঘোর পথভ্রষ্টতায়।” (সূরা আল-জুমু’আ, আয়াত: ২)। রাসূল (সা.)-এর এই ‘তাযকিয়া’ বা পবিত্রকরণের কাজটিই হচ্ছে কুরআনের আলোকে আত্মশুদ্ধি-র কেন্দ্রবিন্দু।
কুরআনি পদ্ধতিতে আত্মশুদ্ধির স্তর ও প্রক্রিয়া
কুরআন শুধু লক্ষ্যই নির্দেশ করে না, পথও দেখায়। আত্মশুদ্ধি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যার বিভিন্ন স্তর কুরআন ও হাদিসে বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হয়েছে:
- আত্মসচেতনতা ও স্বীকৃতি (আল-ই’তিরাফ): আত্মশুদ্ধির প্রথম ধাপ হলো নিজের ভুলত্রুটি, দুর্বলতা ও পাপের ব্যাপারে সচেতন হওয়া এবং তা আল্লাহর কাছে স্পষ্টভাবে স্বীকার করা। কুরআনে হযরত আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)-এর ঘটনায় এই সচেতনতার চিত্র ফুটে উঠেছে: “হে আমাদের রব! আমরা আমাদের নিজেদের প্রতি জুলুম করেছি…” (সূরা আল-আ’রাফ, আয়াত: ২৩)। এই আত্মস্বীকৃতি ছাড়া সংশোধন অসম্ভব।
- তওবা ও ফিরে আসা (আত-তাওবাহ আন-নাসূহ): সচেতনতার পর আসে আন্তরিক অনুতাপ ও আল্লাহর দিকে ফিরে আসার অঙ্গীকার। কুরআন তওবাকে গভীরভাবে উৎসাহিত করে: “হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে খাঁটি তওবা কর…” (সূরা আত-তাহরীম, আয়াত: ৮)। খাঁটি তওবা মানে পাপ থেকে বিরত থাকা, তার জন্য অনুতপ্ত হওয়া এবং ভবিষ্যতে তা না করার দৃঢ় সংকল্প।
- আল্লাহর জিকির ও কুরআন চর্চা (আয-যিকর ও তিলাওয়াতুল কুরআন): আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। আল্লাহ বলেন: “যারা ঈমান এনেছে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের অন্তর প্রশান্ত হয়। জেনে রাখো, আল্লাহর স্মরণেই অন্তর প্রশান্ত হয়।” (সূরা আর-রা’দ, আয়াত: ২৮)। নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত, তার অর্থ অনুধাবন (তাদাব্বুর) এবং মর্মার্থ নিয়ে চিন্তাভাবনা আত্মাকে আলোকিত করে, মলিনতা দূর করে।
- নামাজ প্রতিষ্ঠা (ইকামাতুস সালাত): নামাজ শুধু শারীরিক ইবাদত নয়, এটি আত্মার জন্য এক শক্তিশালী পরিশোধন প্রক্রিয়া। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে: “নিশ্চয়ই নামাজ অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে…” (সূরা আল-আনকাবুত, আয়াত: ৪৫)। খুশু-খুজুর সাথে নামাজ আদায় আত্মাকে কুপ্রবৃত্তির প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে সাহায্য করে।
- রোজা পালন (সিয়াম): রোজা শুধু ক্ষুধা-তৃষ্ণার অনুভূতি নয়; এটি আত্মিক সংযম ও শক্তির উৎস। আল্লাহ রোজাকে সরাসরি আত্মশুদ্ধির সাথে যুক্ত করেছেন: “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৩)। রোজা নফসের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।
- দান-সদকাহ (ইনফাক ফী সাবীলিল্লাহ): কৃপণতা ও লোভ আত্মাকে ভারাক্রান্ত করে। দান-সদকাহ সেই ভার লাঘব করে, আত্মাকে উদার ও পরোপকারী করে তোলে। কুরআনে বলা হয়েছে: “তোমরা যা কিছু দান করো তা তোমাদের নিজেদের কল্যাণের জন্যই। তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় যা ব্যয় করো, তার পুরস্কার তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে দেওয়া হবে…” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৭২)।
- সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ (আল-আমর বিল মা’রুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার): নিজের সংশোধনের পাশাপাশি সমাজে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখাও আত্মশুদ্ধির অংশ। এটি আত্মাকে দায়িত্ববোধ ও সমাজসচেতনতায় উদ্ভাসিত করে।
নাফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম: কুরআনিক দৃষ্টিকোণে আত্মশুদ্ধির চ্যালেঞ্জ
কুরআনের আলোকে আত্মশুদ্ধি-র পথ মসৃণ নয়। সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ আমাদের নিজের ভেতরেই বাস করে – ‘নাফস’ বা কুপ্রবৃত্তি। কুরআন নাফসের বিভিন্ন স্তর ও তার চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সতর্ক করেছে:
- নাফসে আম্মারাহ (অনুপ্রেরণাদায়ক প্রবৃত্তি): যে নাফস মন্দের প্রতি ধাবিত হয়: “নিশ্চয়ই মানুষের মন মন্দ কাজেরই পীড়াপীড়ি করে…” (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৫৩)। এই স্তরে আত্মশুদ্ধির সংগ্রাম সবচেয়ে তীব্র।
- নাফসে লাওয়ামাহ (অনুতাপকারী আত্মা): যে নাফস পাপ করার পর অনুশোচনায় ভোগে, নিজেকে ধিক্কার দেয়: “আর আমি শপথ করি সেই আত্মার, যে নিজেকে ধিক্কার দেয়।” (সূরা আল-কিয়ামাহ, আয়াত: ২)। এটা সংশোধনের ইতিবাচক ধাপ।
- নাফসে মুত্মাইন্নাহ (প্রশান্ত আত্মা): আত্মশুদ্ধির চূড়ান্ত লক্ষ্য, যে আত্মা আল্লাহর সান্নিধ্যে শান্তি পেয়েছে: “হে প্রশান্ত আত্মা! ফিরে আস তোমার রবের দিকে, সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে।” (সূরা আল-ফজর, আয়াত: ২৭-২৮)।
কুরআনি আত্মশুদ্ধির পথে শয়তান (ইবলিস) হল আরেক প্রধান শত্রু, যে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে (সূরা আল-হিজর, আয়াত: ৩৯-৪০)। দুনিয়ার মোহ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৮৫), অহংকার (সূরা লুকমান, আয়াত: ১৮), লোভ (সূরা আত-তাকাসুর) এবং কুসংস্কারও বড় বাধা।
রুহানী মুক্তি: কুরআনের আলোকে আত্মশুদ্ধির ফলাফল
কুরআনের আলোকে আত্মশুদ্ধি-র সফল অনুশীলনই মানুষকে নিয়ে যায় সেই কাঙ্ক্ষিত রুহানী মুক্তি-র দোরগোড়ায়। এই মুক্তি কী?
- আল্লাহর নৈকট্য লাভ: আত্মশুদ্ধির মূল লক্ষ্যই হল আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জন। পবিত্র আত্মাই আল্লাহর সান্নিধ্য পাওয়ার যোগ্য। কুরআনে বলা হয়েছে: “যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সামনে দন্ডায়মান হওয়ার ভয় করে এবং নিজের কুপ্রবৃত্তি থেকে বিরত থাকে, জান্নাতই হবে তার আবাসস্থল।” (সূরা আন-নাযি’আত, আয়াত: ৪০-৪১)।
- অন্তরের গভীর শান্তি (ইত্মিন্নানুল ক্বালব): দুনিয়ার সব অস্থিরতা, দুঃশ্চিন্তা ও অশান্তির ঊর্ধ্বে এক অমূল্য প্রশান্তি। “যারা ঈমান এনেছে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের অন্তর প্রশান্ত হয়। জেনে রাখো, আল্লাহর স্মরণেই অন্তর প্রশান্ত হয়।” (সূরা আর-রা’দ, আয়াত: ২৮)।
- কুপ্রবৃত্তি ও পাপের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি: নাফসের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে ইবাদত ও সৎকাজে স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ লাভ করা।
- দুনিয়াবী জীবনে ভারসাম্য ও সফলতা: আত্মশুদ্ধ মানুষ দুনিয়ার মোহে আটকে পড়ে না আবার দুনিয়াকে সম্পূর্ণ ত্যাগও করে না। সে আল্লাহর দেওয়া নিয়ামতের সঠিক ব্যবহার জানেন (সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৭৭)।
- মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের সফলতা: চূড়ান্ত রুহানী মুক্তি তো মৃত্যুর পরই প্রকৃতভাবে পরিপূর্ণ হয়, যখন মুমিন বান্দা আল্লাহর রহমতে জান্নাতে প্রবেশ করে। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৮৫)।
প্রতিদিনের জীবনে কুরআনি আত্মশুদ্ধি: ব্যবহারিক নির্দেশিকা
কুরআনের আলোকে আত্মশুদ্ধি শুধু বইয়ের পাতায় নয়, প্রতিদিনের জীবনে বাস্তবায়নের মাধ্যমেই তা ফলপ্রসূ হয়:
- প্রতিদিনের মুরাকাবা (আত্ম-নিরীক্ষণ): প্রতিদিন রাতে কিছু সময় নিজের কাজকর্ম, কথাবার্তা, চিন্তাভাবনা পর্যালোচনা করুন। কোন পাপ হয়েছে কি? কোন ভালো কাজ ছুটে গেছে কি? হযরত উমর (রা.) বলতেন: “তোমরা মৃত্যুর আগেই নিজেদের হিসাব নাও।”
- অল্প হলেও নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত ও তাদাব্বুর: শুধু তিলাওয়াত নয়, অর্থ বুঝে, প্রতিটি আয়াতের বার্তা নিজের জীবনে প্রয়োগের চেষ্টা করুন। “এটা এক বরকতময় কিতাব, যা আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে এবং বুদ্ধিমানগণ যেন উপদেশ গ্রহণ করে।” (সূরা সাদ, আয়াত: ২৯)। বিশ্বস্ত তাফসির গ্রন্থ (যেমন তাফসীর ইবনে কাসীর, তাফসীর আল-জালালাইন, তাফহীমুল কুরআন – সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী) ব্যবহার করুন। বিশ্বস্ত তাফসিরের জন্য King Fahd Complex for Printing the Holy Quran ওয়েবসাইটের বাংলা বিভাগ দেখুন।
- নামাজে খুশু-খুজু অর্জনের চেষ্টা: নামাজের সময় দুনিয়াবি সব চিন্তা দূরে সরিয়ে আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর অনুভূতি গড়ে তুলুন। নামাজের প্রস্তুতি ও সময়ের হিফাজত করুন।
- মাউসুফাত (অভ্যাস) পরিবর্তনের সংকল্প: একটি করে খারাপ অভ্যাস (যেমন: গীবত, মিথ্যা বলা, রাগ করা, সময় নষ্ট করা) ত্যাগ করার এবং একটি করে ভালো অভ্যাস (যেমন: সত্য বলা, ধৈর্য ধরা, সালাম প্রচার করা, অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসা) গড়ে তোলার দৃঢ় সংকল্প নিন। ধাপে ধাপে এগোন।
- দু’আ ও ইস্তিগফারে অভ্যস্ত হওয়া: আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং তাঁর সাহায্য চান। নবীজি (সা.) দিনে বহুবার ইস্তিগফার করতেন।
- সৎলোকের সাহচর্য: এমন বন্ধু ও পরিবেশ বেছে নিন যারা আপনাকে আল্লাহর পথে উৎসাহিত করে, পাপ থেকে বিরত রাখে। (সূরা আল-কাহফ, আয়াত: ২৮)।
- জবান ও চোখের হিফাজত: অপ্রয়োজনীয়, ক্ষতিকর বা পাপের কথা বলা ও দেখা থেকে নিজেকে রক্ষা করুন। (সূরা আল-মুমিনুন, আয়াত: ৩, সূরা আন-নূর, আয়াত: ৩০-৩১)।
জেনে রাখুন
H2: জেনে রাখুন
- প্রশ্ন: কুরআনের আলোকে আত্মশুদ্ধির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায় কী?
- উত্তর: কুরআন ও সুন্নাহতে আত্মশুদ্ধির জন্য একাধিক পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। তবে এর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আল্লাহর জিকির (স্মরণ) ও কুরআন চর্চা। নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত, তার অর্থ ও মর্মার্থ নিয়ে গভীর চিন্তা (তাদাব্বুর) এবং আল্লাহকে স্মরণ করা অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে, শান্তি দেয় এবং পাপ থেকে দূরে রাখে। পাশাপাশি খাঁটি তওবা ও নামাজের মাধ্যমে আত্মার সংযোগ অটুট রাখাও অপরিহার্য।
- প্রশ্ন: আত্মশুদ্ধির পথে বারবার পাপে জড়িয়ে পড়লে কী করব?
- উত্তর: আত্মশুদ্ধির পথ সরল নয়। পাপে পড়ে যাওয়া মানেই ব্যর্থতা নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো তাৎক্ষণিকভাবে আন্তরিক তওবা (ইস্তিগফার) করা, নিজের দুর্বলতা স্বীকার করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং আবারও সংকল্প নিয়ে দাঁড়ানো। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু। নবীজি (সা.) বলেছেন, “সব আদমসন্তানই ভুল করে, আর ভুলকারীদের মধ্যে উত্তম তারাই, যারা তওবা করে।” (তিরমিযী)। হতাশ না হয়ে ধৈর্য ধরে চেষ্টা চালিয়ে যান।
- প্রশ্ন: রুহানী মুক্তি লাভ করতে কতদিন লাগে?
- উত্তর: রুহানী মুক্তি কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমার বিষয় নয়; এটি একটি চলমান যাত্রা (সায়ের ইলাল্লাহ)। এটা দৌড়ের প্রতিযোগিতা নয়, বরং ধারাবাহিক প্রচেষ্টা ও উন্নতির প্রক্রিয়া। একদিনে বা এক সপ্তাহে এটি অর্জিত হয় না। প্রতিদিনের ছোট ছোট পদক্ষেপ, নিয়মিত ইবাদত, নেক আমল ও কুপ্রবৃত্তি দমনের চেষ্টাই ধীরে ধীরে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে এবং প্রকৃত মুক্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ধৈর্য ও স্থিরতা অপরিহার্য।
- প্রশ্ন: আত্মশুদ্ধির জন্য কি আলেম বা পীরের সাহচর্য্য আবশ্যক?
- উত্তর: সঠিক জ্ঞানী ও সৎ ব্যক্তির সাহচর্য্য আত্মশুদ্ধির পথে অত্যন্ত সহায়ক হতে পারে। তারা দিকনির্দেশনা দিতে পারেন, সংশোধন করতে পারেন। তবে কুরআন ও সহীহ সুন্নাহই হচ্ছে আত্মশুদ্ধির সর্বোচ্চ ও অবিকৃত মানদণ্ড। যে কেউ সরাসরি কুরআন-হাদিস অধ্যয়ন করে এবং সেগুলো বাস্তব জীবনে প্রয়োগের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির চেষ্টা করতে পারেন। গুরুত্বপূর্ণ হলো জ্ঞানের উৎস যেন কুরআন-সুন্নাহর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এবং ব্যক্তিপূজা বা বিদআত থেকে মুক্ত থাকে।
- প্রশ্ন: দুনিয়াবী কাজকর্মের মাঝে কিভাবে আত্মশুদ্ধির চর্চা করব?
- উত্তর: আত্মশুদ্ধি শুধু মসজিদে বা নির্জন কক্ষে সীমাবদ্ধ নয়। দুনিয়াবী প্রতিটি কাজই ইবাদতে পরিণত হতে পারে যদি নিয়ত (ইন্তেনশন) শুদ্ধ হয় এবং কাজটি আল্লাহর দেওয়া বিধি-বিধান (হালাল-হারাম) মেনে করা হয়। ব্যবসায় সততা, চাকরিতে আমানতদারী, পরিবারে দায়িত্বশীল আচরণ, প্রতিবেশীর হক আদায় – এসবই আত্মশুদ্ধির অংশ। আল্লাহকে স্মরণ রাখা (যিকর), ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা, প্রতিটি কাজ শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা এবং শেষে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলা – এসবই দৈনন্দিন জীবনে আত্মাকে সজীব রাখে।
এই মহান সংগ্রামে কখনোই একা নন আপনি। প্রতিটি সৎ সংকল্প, প্রতিটি ক্ষমা প্রার্থনা, প্রতিটি ভালো কাজ, প্রতিটি কুরআনের আয়াত পাঠ – সবই আপনার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার দিকে একেকটি মজবুত পদক্ষেপ। কুরআনের আলোকে আত্মশুদ্ধি শুধু একটি ধর্মীয় তত্ত্ব নয়; এটি আপনার হৃদয়ে প্রজ্বলিত আলোর সন্ধান, যে আলোয় ভেসে যায় সকল অন্ধকার, সকল সংশয়। এই আলোকিত পথেই নিহিত রয়েছে সেই অনির্বচনীয় শান্তি ও প্রকৃত রুহানী মুক্তি, যা দুনিয়ার কোন ধন-সম্পদ দিতে পারে না। আজই শুরু করুন আপনার আত্মার সাথে এই মধুর আলাপ, এই গভীর সংলাপ। আল্লাহর দিকে এক ধাপ এগিয়ে যান। তিনি আপনার দিকে ছুটে আসবেন দৌড়ে। এই যাত্রা শুধু মৃত্যু পর্যন্ত নয়, বরং অনন্ত জীবনের সফলতার সূচনা। আপনার হাতেই আছে সেই চাবি – কুরআনের আলোকে আত্মশুদ্ধির চাবি। আজই ব্যবহার করুন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।