জুমবাংলা ডেস্ক: ‘ভান্ডার এগ্রো ফার্ম’ উত্তরাঞ্চলের জনপ্রিয় গরুর খামার। খামারটির উদ্যোক্তা বগুড়ার কাহালুর তৌহিদ পারভেজ বিপ্লব। প্রাণিখাদ্যের আগুনদাম, পরিবহনের বাড়তি খরচ আর অস্থিতিশীল বাজার- নেতিবাচক এই ত্রিফলায় বিদ্ধ হয়ে এবার বিপ্লব হারিয়েছেন কোরবানির পশু প্রস্তুতির উৎসাহ। গেলবারের চেয়ে এবার তিনি ২০ শতাংশ গরু উৎপাদন কমিয়েছেন। দৈনিক সমকালের প্রতিবেদক লিমন বাসার-এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বিস্তারিত।
বিপ্লবের খামারে বাণিজ্যিকভাবে একটি মাঝারি গরু তৈরি করতে আগে প্রতি কেজিতে খরচ পড়ত ৩৭৫ থেকে ৩৮০ টাকা। এবার সেই খরচ বেড়ে হয়েছে ৫৩২ থেকে ৫৫০ টাকা। বেশি দামের কারণে এবার অনেক ক্রেতা পশু কিনতে আগ্রহ হারাবেন বলে মনে করেন তিনি।
ধারণা করা হচ্ছে, এবার উত্তরাঞ্চলের অন্তত ৩০ শতাংশ পশু রাজধানী ঢাকায় পাঠাবেন না খামারিরা। রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের হাটে সবচেয়ে বেশি পশু যায় উত্তরাঞ্চলের সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থেকে। এখানে আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজা করা হয় টেপরি ও পুরান টেপরি গ্রামে। এ ছাড়া শাহজাদপুরের অর্ধশতাধিক গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে করা হয় গরু মোটাতাজা। তবে এবারের ছবি একটু অন্য রকম। প্রতিটি গ্রামের খামারে গরু নিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় আছেন, তবে গরু কেনার খরিদদার নেই। খামারিরা বলছেন, বাজার খারাপ। এ কারণে হাটে নয়, বাড়িতেই গরু বিক্রি করতে চান তাঁরা। স্থানীয় প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্য বলছে, গত বছর সিরাজগঞ্জ থেকে এক লাখের বেশি গরু ঢাকার হাটে পাঠানো হয়েছিল। খামারিদের ধারণা, এই সংখ্যা এবার অনেক কমে যাবে।
খামারিরা জানান, আগে ১৮ হাজার টাকার একটি গরু ৬ থেকে ১০ মাস পালন করে অনায়াসে ৫৪ হাজার থেকে ৭৪ হাজার টাকায় বিক্রি করা যেত। ৫০-৫৫ হাজার টাকার একটি ষাঁড় ছয় মাস থেকে এক বছর পালন করে লাখ টাকার ওপরে বেচা যেত। নানা কারণে এবার উৎপাদন খরচ বাড়লেও গরুর দাম পাওয়া যাবে কিনা, তা নিয়ে সংশয়ে আছেন খামারিরা।
শাহজাদপুরের পুরান টেপরি গ্রামের খামারি মুকুল শেখ, গোলাম মওলা, কাদের মেম্বার, জহুরুল হকসহ অনেকেই জানান, এবার তাঁদের গরুর সংখ্যা অনেক কম। প্রাণিখাদ্যের দাম আকাশচুম্বী, পরিবহন খরচও বেড়েছে। এগুলো ঢাকায় পাঠালে দামের সঙ্গে গরুপ্রতি অতিরিক্ত আরও পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা যোগ হবে। তাই রাজধানীর হাটে না পাঠিয়ে এসব গরু এলাকায় বিক্রি করবেন। ফলে এবার ৩০ শতাংশের মতো গরু ঢাকায় কম যাবে।
লালমনিরহাটের হাতিবান্ধার খামারি মিনহাজ মিয়া জানান, এখান থেকে ঢাকায় গরু পাঠানো বেশ ব্যয়বহুল। গত বছর ট্রাকে করে ১৭৫টি গরু ঢাকার বিভিন্ন হাটে পাঠিয়েছিলাম। এবার গরু প্রস্তুত করেছি মাত্র ৫৫টি। এগুলো ঢাকায় পাঠাব না। পাইকাররা এলে এখানেই বিক্রি করে দেব। হতাশ কণ্ঠে তিনি বলেন, পশুবাজারের যে অস্থিরতা, আগামীতে আর পশু পালনই করব না।
এদিকে, এই সময়টাতে খামার থেকেই যে সংখ্যক কোরবানির পশু বিক্রি হওয়ার কথা, সেটা হয়নি বলে জানালেন বগুড়ার কাহালুর ‘সুরা এগ্রো’র মালিক রাকিবুল ইসলাম। গত বছর কোরবানির এক মাস আগে অনলাইন ও অফলাইন মিলিয়ে তিনি শতাধিক গরু বিক্রি করেছিলেন। এবার এখনও একটি গরু বিক্রি দূরে থাক, বিক্রয় চুক্তি পর্যন্ত হয়নি। রাকিব বলেন, ‘গরু পালন করি লাভের জন্য। হঠাৎ অস্থিতিশীল বাজার এই খাতকে শুধু ক্ষতিগ্রস্তই নয়, চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।’
২৮ বছর ধরে গরুর ব্যবসা কুড়িগ্রামের আফজাল হোসেনের। কোরবানি ঘিরে কয়েক মাস ধরে তিনি চরাঞ্চলে ঘুরে ঘুরে গরু কিনছেন। ঈদের আগে তিন-চার মাস খাইয়ে হূষ্টপুষ্ট করে বিক্রি করবেন লাভে। এরই মধ্যে তিনি কিনেছেন দেড় শতাধিক গরু। আফজাল বলেন, এবার দামটা একটু বেশি পড়বে। গত বছর কোরবানিতে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা কেজি মাংস দরে গরু কিনেছি। এবার সেটা বেড়ে ৬০০ টাকায় ঠেকেছে। মাংসের দাম হয়তো আরও বাড়বে। কেজিতে যদি ২০০ টাকা করে বাড়ে, তাহলে মণপ্রতি বাড়ছে আট হাজার টাকা। চার মণ ওজনের একটি গরুর দাম ৩২-৩৪ হাজার টাকা এবার বেশি পড়বে।
রাজশাহীর বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ দপ্তরের পরিচালক ড. নজরুল ইসলাম বলেন, পশুর দাম কিছুটা বাড়লেও বেচাকেনা ঠিকঠাক থাকবে।
রংপুরের বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ দপ্তরের পরিচালক ওয়ালিউর রহমান আকন্দ বলেন, আশা করছি, খামারিরা লোকসানে পড়বে না। আবার ক্রেতাও ন্যায্যমূল্যে পশু কিনতে পারবে। তিনি দাবি করেন, দাম বাড়ার কারণে পশু পালন কমেনি।
বন্ধ হচ্ছে খামার: জয়পুরহাটের কালাইয়ের রাব্বি ডেইরির মালিক ফররুখ আহম্মেদ বলেন, এভাবে চলতে থাকলে কোরবানির পর নতুন করে আর গরু কিনে খামারের চিন্তা করব না। বাজার থমকে আছে। একই এলাকার নান্নু মিয়া তাঁর খামার লোকসানের কারণে বন্ধ করে দিয়েছেন।
রংপুর নগরীর নীলকণ্ঠ এলাকার খামারি রেজাউল করিম বলেন, গো-খাদ্যের দাম যে হারে বেড়েছে, গরু পালন দুস্কর হয়ে পড়েছে। এলাকার অনেক খামার বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
রংপুর জেলা ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি লতিফুর রহমান মিলন বলেন, যেভাবে প্রাণিখাদ্যের দাম বাড়ছে, এভাবে গরু পালন করা কষ্টকর। আগে খামারে দেশি ও সংকর জাতের অর্ধশত গরু থাকলেও গেল ছয় মাসের ব্যবধানে তা অর্ধেকে নেমেছে।
বেড়েছে পরিবহন খরচ: ট্রাকভর্তি গরু নিয়ে দিনাজপুরের আমবাড়িহাট থেকে পরিবহন ব্যবসায়ী মাজেদুর রহমান যাচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার। ২০ ফুটের ওই ট্রাকের ভাড়া ধরা হয়েছে ২২ হাজার টাকা। গরুবোঝাই আরও দুটি ট্রাক ১৮ হাজার টাকায় কুষ্টিয়া ও ৩৫ হাজার টাকায় চট্টগ্রাম যাচ্ছে। মাজেদুর রহমান বলেন, গত বছরের চেয়ে এবার ট্রাকভাড়া পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা বেশি। এ ছাড়া পথের বাড়তি টাকা (চাঁদা, ঘুষ, সেলামি) পাইকারদের দিতে হয়। সব মিলিয়ে গরুপ্রতি গড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা বেড়ে যায়।
অনলাইন পশুর হাট: পশু খামারিরা বলছেন, এবার অনলাইন পশুর হাটে এখনও তেমন সাড়া নেই। তাঁরা এলাকার বাইরে গরু নিয়ে যেতে শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন। হাটে গরু নিতে পথে পথে চাঁদা দিতে হয়। এ পরিস্থিতিতে উত্তরাঞ্চল থেকে বিশেষ ট্রেনের মাধ্যমে ঢাকাসহ অন্য জেলায় গরু পাঠানোর ব্যবস্থা করা গেলে সুবিধা হতো।
অনলাইন ও ডিজিটাল হাটের আয়োজক এবং অংশীদাররা বলছেন, গত বছর এ সময়ে দুই লাখের বেশি পশু অনলাইন ও ডিজিটাল হাটের মাধ্যমে বিক্রি হয়েছে। এবার এই সংখ্যা ১০ শতাংশের নিচে রয়েছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।