জুমবাংলা ডেস্ক : দাম বাড়ছে সোনার। ভাঙছে একের পর এক রেকর্ড। মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে সোনা। সোনার ভরি এখন লাখ ছুঁতে চলেছে। ক্রেতাকে এক ভরি ভালো মানের সোনা কিনতে গুনতে হয় ৯৩ হাজার ৪২৯ টাকা। যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দর। অথচ ৫ বছর আগেও এই দাম ছিল অর্ধ লাখের নিচে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টাকার অবমূল্যায়নের কারণে দেশে সোনার দাম বেড়েই চলছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৩ সালের মধ্যেই লাখ ছুঁয়ে যেতে পারে সোনার ভরি।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ৫ বছর আগেও অর্ধ লাখের নিচে ছিল সোনার দাম। ২০১৮ সালের ৯ই জানুয়ারি পর্যন্ত প্রতি ভরি ভালো মানের (২২ ক্যারেট) সোনা বিক্রি হয়েছিল ৪৯ হাজার ৩৩৮ টাকায়।
এরপরই অর্ধ লাখ ছুঁয়ে যায় সোনার দাম। ওই বছর ১০ই জানুয়ারি থেকে ৫০ হাজার ৭৩৮ টাকাতে বিক্রি হয় এক ভরি সোনা। এরপর কয়েক দফায় দরের ওঠা-নামা করে ২০২০ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৬০ হাজার ৩৬১ টাকায় বিক্রি হয়েছিল ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনা। দেশে করোনার আঘাত হানার আগেও সোনার দাম ছিল ৬১ হাজার ৫২৭ টাকা। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে সোনার রেকর্ড পরিমাণ দাম বেড়েই চলছে। বর্তমানে সবচেয়ে ভালো মানের সোনা বিক্রি হচ্ছে ৯৩ হাজার ৪২৯ টাকা। গত ১৫ই জানুয়ারি থেকে নতুন এই দর নির্ধারণ করে দেয় বাজুস। গত ৫ বছরে এক ভরি ভালো মানের সোনায় দাম বেড়েছে ৪৪ হাজার ৯১ টাকা।
বিশ্বে সোনার দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও সামাজিক অবস্থাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, করোনার আঘাত আসার পর বিশ্বের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থায় বিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এতে বড় বড় অর্থনীতির দেশে ধস নামার শঙ্কা তৈরি হয়। যাদের পুঁজি বেশি ছিল, ব্যাংক-শেয়ারবাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ করতো তারা স্বর্ণের রিজার্ভ বৃদ্ধি করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এতে স্বর্ণের চাহিদাও আকাশচুম্বি হয়। কিন্তু সে অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় দাম বেড়ে যায়। বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলেও অনেকে স্বর্ণ রিজার্ভ করছে। এতে স্বর্ণের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সংকটও তৈরি হয়েছে।
বাজুসের ভাইস প্রেসিডেন্ট আনোয়ার হোসেন বলেন, করেনার কারণে বিশ্ব অর্থনীতি চাপে পড়ে। অনেকের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। এতে খনি থেকে স্বর্ণ তোলাও হতো কম। নিষ্কাশন হতো না। কিন্তু সোনার চাহিদা বেশি ছিল। করোনাকালীন ২০২০ সালের মাঝামাঝিতে প্রতি আউন্স সর্বোচ্চ ২০৭০ ডলার উঠে সোনার দাম। তবে যখন করোনা কমে এলো তখন আবার এই দাম ৪০০-৪৫০ ডলার কমে আসে। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ফের সোনার দামে প্রভাব পড়ে। পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়া, চায়না জোটের জন্য তেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। আর যারা তেল বিক্রি করে তাদের পুঁজিও বেড়ে যায়। তখন তারা ইউরোপের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপের দিকে যাওয়ার আশঙ্কা করে ফের স্বর্ণ রিজার্ভ শুরু করে। চায়নাও প্রচুর স্বর্ণ রিজার্ভ করছে। তাদের বিভিন্ন পণ্য যেমন- নতুন ড্রোন, মিসাইল, কম্পিউটার ও মোবাইলের মতো পণ্যগুলোতে স্বর্ণের প্লেটিং করতে হয় সঠিক ইলেক্ট্রনের জন্য। এতে একদিকে সোনার রিজার্ভ ও বহুবিধ ব্যবহারের ফলে ফের সোনার সংকট তৈরি হয়। এজন্য স্বর্ণ নিষ্কাশন কম হচ্ছে আবার গভীর খনি থেকে সোনা তুলতে খরচও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে দামও বাড়ছে। তবে বিশ্বে এখন রেকর্ড দরে নেই সোনা।
এদিকে গত মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক বেঞ্চমার্ক স্বর্ণের স্পট মূল্য শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ কমেছে। এতে প্রতি আউন্সের দাম দাঁড়িয়েছে ১৯০৪ ডলার ৮৭ সেন্টে। যা আগেরদিন পর্যন্ত ছিল ১৯১৮ ডলার ৬৬ সেন্ট। মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের বেঞ্চমার্ক স্বর্ণের সরবরাহ মূল্য কমেছে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। আউন্সপ্রতি দাম নিষ্পত্তি হয়েছে ১৯০৯ ডলার ৯ সেন্টে। গত সোমবার যা ছিল ১৯২৩ ডলার ২০ সেন্ট। এ সময়ে ইউএস ডলার সূচক বেড়েছে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ। ফলে অন্য মুদ্রা ধারণকারীর কাছে স্বর্ণ ব্যয়বহুল হয়ে গেছে। তাতে দামি ধাতুটির মূল্য নিম্নমুখী হয়েছে।
বিদেশে রেকর্ড দরে না থাকলেও বাংলাদেশে সোনার রেকর্ড দরের প্রসঙ্গে আনোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের দেশে সোনার দাম বেড়ে যাচ্ছে টাকার অবমূল্যায়নের জন্য। আমাদের এখানে ব্যাংকিং পদ্ধতিতে সোনা ইস্যু হয় না। এখানে আসে চোরাই পথে। চোরাই পথে যেগুলো আসে তা পেমেন্ট করতে হয় হুন্ডির মাধ্যমে। খুব উচ্চমূল্যে ডলার কিনতে হয়। আর এখন ব্যাংকেও পর্যাপ্ত ডলার পাওয়া যায় না। এজন্য বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানে টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। স্বর্ণের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আজকে বিশ্বে স্বর্ণের দর হলো ১৯১০ ডলার প্রতি আউন্স। সে হিসেবে বিশ্বে রেকর্ড হয়নি। কিন্তু আমাদের দেশে রেকর্ড হয়ে গেছে। যেথানে প্রতি আউন্স ২০৭০ ছিল সেখানে এখন ১৯১০ ডলার আছে। বাংলাদেশে যদি টাকার অবমূল্যায়ন না হতো তাহলে দেখা যেত আগে স্বর্ণের দাম যা ছিল এখন তাই থাকতো।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিশ্ববাজারে সোনার দাম বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ আর আমাদের এক্সচেঞ্জ রেট কমে গেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। আমাদের দেশে সোনা আসে কার্ব মার্কেট থেকে। সেখানে ডলারে দাম ১১৩-১১৫ টাকা। তাই এতে আরও বেশি খরচ হয়। তাই টাকার অবমূল্যায়নটাই সবচেয়ে বড় কারণ। আগামীতে সোনার দাম আরও বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি। যদি বিশ্বে ডলারের দাম কমে যায় তাহলে সোনার দাম বাড়বে। আবার যদি টাকার অবমূল্যায়ন হয় তাহলে আমাদের দেশে সোনার দাম আরও বাড়বে।
এদিকে বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকার সোনা অবৈধভাবে চোরাচালানের মাধ্যমে আসছে বলে সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বাজুস জানিয়েছে। বাজুসের ধারণা, প্রবাসী শ্রমিকদের রক্ত ঘামে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার অপব্যবহার করে সারা দেশের জল, স্থল ও আকাশ পথে প্রতিদিন কমপক্ষে প্রায় ২শ’ কোটি টাকার অবৈধ সোনার অলংকার ও বার চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসে। যা বার্ষিক হিসাবে দাঁড়ায় প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সোনা চোরাচালান জুয়েলারি শিল্পের বড় ধরনের সংকট ও চ্যালেঞ্জ। এটি দুর্নীতিকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংকটও বাড়াচ্ছে।
সূত্র : মানবজমিন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।