জুমবাংলা ডেস্ক : বৃষ্টির এই লাল রং নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কারও পরীক্ষাই ১০০ শতাংশ নিশ্চিত করতে পারছে না, ঠিক কী কারণে একমাত্র ওই অঞ্চলে এরকম বৃষ্টি হয়েছিল।
ঘটনা ১
২৫ জুলাই, ২০০১। তপ্ত গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা কেরলের কোট্টাম ও ইডুক্কি জেলার মানুষদের। অন্যান্য দিনের মতোই কাটছিল ওই দিনটাও। হঠাৎ শোনা গেল এক তীব্র, ভয়ংকর শব্দ আর তার সঙ্গে সঙ্গে আকাশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল উজ্জ্বল আলো। যে শব্দ তারা শুনতে পেয়েছিল, সেই শব্দ একমাত্র সুপারসনিক বিমান দ্বারাই তৈরি হওয়া সম্ভব। কিন্তু ভারতের বিমানবাহিনী থেকে জানানো হয়, ওইদিন কোনওরকমের বিমানের মহড়া তারা দেয়নি। তাহলে কী ছিল এই শব্দ? আর এত আলোই বা এল কীভাবে?
ঘটনা ২
ওই একই দিনে জোরালো শব্দ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরেই আকাশ ঢাকা পড়ে যায় মেঘের চাদরে। আর ঝেঁপে আসে বৃষ্টি। কিন্তু এই বৃষ্টি আর ৫টা সাধারণ বৃষ্টির মতো ছিল না। যা দেখে শুধু কেরলের মানুষই নয়, পুরো বিশ্ব ভয়ে কেঁপেছিল। কী ছিল এই বৃষ্টি? যা চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল সকলকে।
উপরোক্ত এই দু’টি ঘটনার সাথেই আমরা অল্পবিস্তর পরিচিত ছিলাম। ২০০১ সালে ঘটা এই ঘটনা আজও মানুষকে শিরশিরানির অনুভব দিতে পারে। বিজ্ঞানের সৌজন্যে আজ আমরা এমন অনেক জিনিসের ব্যাখ্যা পাই, যা হয়তো অনেকে অলৌকিক বলেই চালিয়ে দিয়েছেন। পরিবেশ আর প্রকৃতি মানুষের কাছে এক রহস্যের ভাণ্ডার। পরিবেশে হওয়া কিছু কিছু ঘটনা মানুষের চিন্তাভাবনাকে অন্য মাত্রা দেয়। আবার এমন অনেক ঘটনাও ঘটে, যার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে।
বর্ষাকালে বৃষ্টি হবে এটাই স্বাভাবিক। জন্মের পর থেকে আমরা এই নিয়ম দেখে আসছি। তার কোনও ব্যতিক্রম হয়নি। গরমের দাবদাহে যখন জনজীবন দুর্বিষহ আর প্রকৃতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, সেই সময় মানুষকে স্বস্তি দিতে বৃষ্টির আগমন। বৃষ্টির স্পর্শে প্রকৃতি যেন প্রাণ ফিরে পায়। কিন্তু সেই বৃষ্টি যখন মানুষের মনে ভীতি আর আশঙ্কার সৃষ্টি করে, তখন? আমরা সকলেই জানি, জল বর্ণহীন তাই বৃষ্টির জলেরও কোনও রং নেই। কিন্তু কেমন হবে যদি আকাশ থেকে নেমে আসে রক্তের মতো লাল রঙের বৃষ্টির ধারা?
কী এই লাল বৃষ্টি?
কেরলে ২০০১ সালের ২৫ জুলাই যে বৃষ্টি হয়, তা সাধারণ বৃষ্টির মতো বর্ণহীন ছিল না, বরং তার রং ছিল রক্তের মতো টকটকে লাল। এই ভারী বৃষ্টি কেরলবাসীর বাড়িতে শুকোতে দেওয়া কাপড়কেও রাঙিয়ে দিয়েছিল লাল রঙে। তবে অনেকের মতে, ২০০১ সালেই এই বৃষ্টির সূত্রপাত নয়, এর আগে ১৯৮৬ সালেও এই রকম বৃষ্টি হয়েছিল বলে জানা যায়।
আমরা হলুদ বা সবুজ রঙের বৃষ্টির কথা শুনেছি। তবে সেগুলি প্রধানত পরিবেশে অ্যাসিড বা বিভিন্ন কণিকার উপস্থিতির জন্য হয়েছে বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। কিন্তু কেরলের এই বৃষ্টি লাল কেন হলো, তা নিয়ে বিভিন্ন গবেষক আর বিজ্ঞানীদের ভিন্ন মত আছে। একটি মত হলো, বিজ্ঞানিরা এই লাল বৃষ্টির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষানিরীক্ষা চালালে দেখা যায় যে, এই বৃষ্টির প্রতি মিলিমিটার জলে প্রায় ৯ মিলিয়ন লাল রঙের কণিকা আছে। আরও গণনা করলে পাওয়া যায় যে, প্রতি লিটার জলে ১০০ গ্রাম কঠিন পদার্থ আছে। তাই কেরলে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছিল, তাতে সব মিলিয়ে প্রায় ৫০,০০০ লাল কণিকা মাটিতে পড়েছিল। এই কণিকাগুলির রঙ বাদামি লাল। এদের প্রায় ৯০ শতাংশ গোলাকার আর বাকি অংশ কোনও বস্তুর ধ্বংসাবশেষ বলে মনে হয়। মূলত লাল কণিকার উপস্থিতির জন্যই বৃষ্টির রং লাল বলে ধরা হয়েছিল।
অন্য মতানুসারে, কোথা থেকে এসেছিল এই লাল রঙের কণিকা আর শুধু কেরলের এই অঞ্চলেই এই বৃষ্টি হলো কেন? লাল বৃষ্টির মতো বিরল ঘটনার সাক্ষী থাকা কেরলবাসীদের মতে, যখন বৃষ্টির ধারা গাছের পাতায় পড়ে তখন পাতা ঝরে পড়ে আর পাতায় ধূসর রঙের পোড়া দাগ দেখা যায়। কয়েক কিমি অঞ্চলজুড়ে ১০-২০ মিনিটের জন্য হয়েছিল এই বৃষ্টি। সেন্টার ফর আর্থ সায়েন্স স্টাডিজ-এর বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বৃষ্টির পূর্বে হওয়া তীব্র আওয়াজের কারণে এই বৃষ্টি হয়। তারা মনে করেন উল্কাপিণ্ডের বিস্ফোরণ এই বৃষ্টির জন্য দায়ী। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, যদি সত্যি সত্যি উল্কাপিণ্ডের বিস্ফোরণ হয়, তাহলে শুধু কেন ওই জায়গার মধ্যেই কণাগুলো সীমাবদ্ধ থাকবে? তার তো অন্য জায়গাতেও ছড়িয়ে পড়ার কথা। সেখানেও তো লাল বৃষ্টি হওয়ার কথা। কিন্তু তেমন তো কিছু ঘটেনি। তাই লাল বৃষ্টির পিছনে এই কারণ যুক্তিযুক্ত ছিল না। কারণ স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের ওপর ছড়িয়ে পড়া উল্কাখণ্ড কখনওই বারবার একই জায়গায় বৃষ্টির সঙ্গে নেমে আসতে পারে না।
এরপর সেন্টার ফর আর্থ সায়েন্স স্টাডিজ-এর বিজ্ঞানীরা বৃষ্টির জলের নমুনা নিয়ে আরও পরীক্ষা শুরু করেন। সেই নমুনায় তারা কিছু স্পোর লক্ষ করেন। তাই তারা তদন্তের দায়িত্বভার তুলে দেয় ট্রপিক্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেন অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর হাতে। এবং এই পর্যবেক্ষণের পর ২০০১ সালের নভেম্বর মাসে ভারত সরকারের তরফ থেকে সেন্টার ফর আর্থ সায়েন্স স্টাডিজ এবং ট্রপিক্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেন অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। রিপোর্ট অনুযায়ী, বৃষ্টির লাল রঙের কারণ হিসেবে বৃষ্টিতে Trentepohlia প্রজাতির লাইকেনের অতিরিক্ত মাত্রায় উপস্থিতিকে দায়ী করা হয়। ২০১২ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী Milton Wainwright স্পোরগুলির মধ্যে ডিএনএ পর্যবেক্ষণ করেন ও ২০১৫ সালে অস্ট্রিয়া ও ভারতীয় কিছু বিজ্ঞানী স্পোরগুলিকে Trentepohlia annulata নামে শনাক্ত করেন। পরবর্তীকালে ওই এলাকায় ওই একই প্রজাতির লাইকেনের প্রাচুর্য লক্ষ করা যায়।
আজও বৃষ্টির এই লাল রং নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কারও পরীক্ষাই ১০০ শতাংশ নিশ্চিত করতে পারছে না, ঠিক কী কারণে একমাত্র ওই অঞ্চলে এরকম বৃষ্টি হয়েছিল। নানাবিধ প্রশ্নের মুখে পড়ে কোনও তত্ত্বই সঠিক জায়গা করে নিতে পারেনি, আবার অনেক তত্ত্ব ধোপেও টেকেনি। তাই কেরলের এই লাল বৃষ্টির রহস্য আজও রহস্যই রয়ে গেছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।