জুমবাংলা ডেস্ক : ঝিনাইদহের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের লাশের টুকরোর খোঁজে কলকাতার খাল-নর্দমা চষে বেড়াচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের সিআইডিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গ্রেপ্তার খুনিদের নিয়ে করানো হয়েছে টিআই প্যারেড। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তিন কর্মকর্তা।
তবে ১৪ দিনেও উদ্ধার হয়নি মরদেহের কোনো অংশ। ফলে এমপি আনারের লাশ পাওয়া নিয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মধ্যেই দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। অন্যদিকে, লাশ না পেলেও পর্যাপ্ত ডিজিটাল ও ফরেনসিক প্রমাণ হাজির করতে পারলে খুনিদের শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে বলে জানিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তবে আনারকে বাংলাদেশ থেকে অপহরণ করার যে অভিযোগে ঢাকায় মামলা দায়ের করা হয়েছে, তার আইনগত ভিত্তিকে দুর্বল বলছেন তারা।
ভারতের আইন অনুযায়ী, এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের লাশ বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাওয়া না গেলে তাকে মৃত ঘোষণা করা যাবে না। শেষ পর্যন্ত লাশ বা এর খণ্ডাংশ উদ্ধার না হলে তাকে মৃত ঘোষণা করতে হলেও কমপক্ষে সাত বছর অপেক্ষা করতে হবে ভারতীয় পুলিশকে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ঘটনার ১৪ দিন পার হয়ে যাওয়ায় লাশের টুকরো উদ্ধার করা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় তদন্ত কর্মকর্তাদের এখন সাক্ষী, খুনিদের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, ডিজিটাল ও ফরেনসিক তথ্যপ্রমাণের ওপর নির্ভর করতে হবে বলে জানিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জিবা গার্ডেনের ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হওয়া চুল, রক্ত ও পোশাকের ডিএনএ টেস্টের ওপর নির্ভর করে প্রমাণ করতে হবে সেখানে ভুক্তভোগী গিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে তার মোবাইলের অবস্থানও সেখানে ছিল। সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ। ফুটেজে তাকে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করতে দেখা গেলেও বের হতে দেখা যায়নি। এ ছাড়া যে গাড়িতে আনারকে ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং লাশের টুকরোর ব্যাগ যে গাড়িতে করে বের করা হয়েছে, তার চালকদের সাক্ষ্যও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
জানা গেছে, গতকাল বেলার শুরুতেই হত্যা মামলার গ্রেপ্তার আসামি কসাই জিহাদ হাওলাদারকে সঞ্জিবা গার্ডেনের ফ্ল্যাটে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কীভাবে তাকে হত্যা করা হয়, অজ্ঞান করার পর লাশ টুকরো টুকরো করা হয়, তার পুনর্দৃশায়ন (টিআই প্যারেড) করা হয়। লাশের কিছু অংশ কিমা করে কীভাবে কমোডে ফেলে ফ্ল্যাশ করা হয়েছে তার দৃশ্যায়নও করা হয়েছে। সেখান থেকে কসাই জিহাদকে লাশ ফেলার জন্য সেই খালে নিয়ে যায় ডিবি পুলিশ। সেখানে কোথায় কীভাবে লাশ ফেলা হয়েছে তার দৃশ্যায়ন করা হয়। তবে লাশের পচনশীল অংশ কমোডে ফেলে ফ্ল্যাশ করা হয় এবং খালে ফেলা হয়। লাশের মুখের ও দাঁতের একটি অংশ ফেলা হয়েছিল কলকাতার যশোর রোডের আশপাশের একটি এলাকায়। সেটি উদ্ধারের বিষয়ে ডিবি আশাবাদী। বিকালে পশ্চিমবঙ্গের সিআইডি কার্যালয় ভবানী ভবনে যান ডিবি কর্মকর্তারা। সেখানে সিআইডির সঙ্গে তারা আলোচনা করেন।
গতকাল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ বলেন, ভারতের পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার কসাই জিহাদ হাওলাদারকে নিয়ে সোমবার কলকাতার বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি চালানো হয়েছে। আমরা দুবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। অভিযুক্ত জিহাদকে টিআই প্যারেডের জন্য ঘটনাস্থলে নিয়ে গেছি। জিহাদকে বাগজোলা খালে নিয়ে যাওয়া হয়। এই খালেই এমপি আনোয়ারুল আজিমের লাশ ফেলা হয়েছিল বলে আসামিরা জানিয়েছে।
অন্যদিকে, এমপিকে ঢাকার শেরেবাংলা নগর থেকে অপহরণ করার বিষয়ে যে মামলা করা হয়েছে তার ভিত্তি দুর্বল বলছেন আইনজ্ঞরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমপি আনোয়ারুল আজিম ইমিগ্রেশন পার হয়ে পাশের দেশ ভারতে গিয়েছেন। ইমিগ্রেশন দিয়ে তো কাউকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া যায় না। আবার ভারতে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে কথাও বলেছেন। ভারত থেকে নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে তার দীর্ঘদিনের বন্ধু গোপাল বিশ্বাস থানায় জিডিও করেছেন। তাই বাংলাদেশ থেকে তাকে অপহরণ হওয়ার কোনো ভিত্তিও নেই।
তবে লাশ পাওয়া কিংবা না পাওয়ার বিষয়ের ওপর খুনিদের শাস্তি নির্ভর করবে না বলে জানিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাঈদ আহমেদ রাজা গতকাল সন্ধ্যায় আমাদের সময়কে বলেন, লাশের টুকরো পাওয়া, না পাওয়ার মধ্যে শাস্তির কোনো কিছু নির্ভর করবে না। এখন বিষয়টি হচ্ছে একটা হত্যা হওয়ার জন্য যে উপাদান, সেই উপাদানগুলো আছে কিনা এবং যারা হত্যা করেছে তারা আছে কিনা। যারা খুন করেছে এবং লাশ গুম করার ব্যাপারে সহায়তা করেছে, সেটা প্রমাণ হলে আইন অনুযায়ী বিচার হবে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নর্থইস্ট নিউজ জানিয়েছে, এমপি আনারের লাশ বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাওয়া না গেলে ময়নাতদন্ত করা যাবে না, যার অর্থ হলো তার আত্মীয়দের কাছেও মৃত্যুসনদ হস্তান্তর করা যাবে না। ডেথ সার্টিফিকেট বা মৃত্যুসনদ জারি করার আগে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডিকে কমপক্ষে সাত বছর অপেক্ষা করতে হবে।
কলকাতার প্রবীণ আইনজীবী নবকুমার ঘোষ বলেন, মৃত কোনো ব্যক্তির লাশ পাওয়া না গেলে মৃত্যুসনদ জারি করতে সাত বছর অপেক্ষা বাধ্যতামূলক। সাত বছর শেষে সিআইডিকে ভারতীয় সংবিধানের ২২৬ ধারার অধীনে কলকাতা হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করতে হবে। এরপর উচ্চ আদালত বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিতে পারে। সেই তদন্ত শেষ হলে উচ্চ আদালত আদেশ জারি করতে পারেন, যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মৃত্যুসনদের সমতুল্য হবে।
এদিকে এমপি আনোয়ারুল আজিমের সংসদীয় আসন শূন্য ঘোষণা করা না হলেও জাতীয় সংসদের ওয়েবসাইটে ঝিনাইদহ-৪ আসনসংক্রান্ত তথ্য সরিয়ে ফেলা হয়েছিল গত রবিবার। তবে গতকাল সোমবার আবার তা পুনর্বহাল করা হয়। ওয়েবসাইটে দেখা যায়, সংসদ সদস্যদের তালিকাক্রমে ৮৪ নম্বরে আনোয়ারুল আজিম আনারের নাম ও ছবি পুনরায় যুক্ত করা হয়েছে।
কোনো সংসদ সদস্যের মৃত্যু হলে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) জানায় সংসদ সচিবালয়। এরপর কমিশন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে ওই আসনে উপনির্বাচনের আয়োজন করে। গত রবিবার জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, অতীতে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। এ জন্য তারা আরও অপেক্ষা করবেন।
প্রসঙ্গত, গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যান এমপি আনার। ১৩ মে কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনের একটি ফ্ল্যাটে এমপি আনারকে খুন করা হয়েছে বলে জানায় ঢাকা ও কলকাতার পুলিশ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।