আন্তর্জাতিক ডেস্ক : গাজা উপত্যকায় হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে, এমন সম্ভাবনার কথা শুরু থেকেই বরে আসছিলেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। সময়ের সঙ্গে সেই সম্ভাবনা জোরালো হচ্ছে। এরইমধ্যে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল হিজবুল্লাহকে দমনে লেবাননে সর্বাত্মক হামলা করার ঘোষণা দিয়েছে। এনিয়ে তীব্র হুমকিও দিয়েছে হিজবুল্লাহ। পাল্টাপাল্টি হুমকির পর জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, যদি ইসরাইল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয় তাহলে সেটা হবে আরেকটি ‘বিপর্যয়’।
লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর প্রধান সাঈদ হাসান নাসরুল্লাহ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, লেবাননের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি তাদের ভীত করে না এবং তাদের ভয় পাওয়া উচিতও নয়। কারণ, শত্রু ভালো করেই জানে যে, হিজবুল্লাহ কঠিনতম পরিস্থিতির জন্য নিজেদের প্রস্তুত রেখেছে। সেই সঙ্গে আগ্রাসন চালালে তার কপালে কী আছে- সেটাও সে জানে। লেবাননে হামলা চালালে ইসরাইল মানচিত্র থেকে মুছে যাবে।
গত বুধবার ইসরাইলি হামলায় নিহত হিজবুল্লাহর ফিল্ড কমান্ডার তালেব সামি আব্দুল্লাহ ওরফে আবু তালেব স্মরণ উপলক্ষে এক টেলিভিশন ভাষণে এ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন নাসরুল্লাহ। আর এতেই বোঝা যায়, গাজায় বর্বরতা চালানোর জেরে হামাসের পর এবার ইসরাইলের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে লেবাননের রাজনৈতিক ও সশস্ত্র দল হিজবুল্লাহ।
এমন পরিস্থিতিতে পূর্ণ মাত্রায় যুদ্ধ শুরু হলে সংগঠনটির পাশে দাঁড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের ইরান সমর্থিত অন্যান্য দেশের সশস্ত্র সংগঠনগুলো। এমনকি তালেবান যোদ্ধারাও নাকি হিজবুল্লাহর হয়ে যুদ্ধে যেতে রাজি। তবে, সমমনা ওই সব সংগঠনকে ধন্যবাদ জানিয়ে নিজেদের এক লাখ যোদ্ধা নিয়েই আপাতত ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়াই করার ঘোষণা দিয়েছেন হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতা হাসান সাঈদ নাসরাল্লাহ।
হিজবুল্লাহ নেতা বলেন, ইরান, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন ও অন্যান্য দেশের সমমনা নেতারা এর আগে হিজবুল্লাহকে সহায়তা করার জন্য হাজার হাজার যোদ্ধা পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। নাসরাল্লাহ বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে হিজবুল্লাহর জনশক্তির একটি অংশই শুধু ব্যবহার করা হচ্ছে। যারা মূলত ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন নিক্ষেপকারী বিশেষ যোদ্ধা। তবে সর্বাত্মক যুদ্ধের ক্ষেত্রে তা পরিবর্তন হতে পারে।’
ইরান সমর্থিত লেবানিজ ও ইরাকি গোষ্ঠীর কর্মকর্তারা বলছেন, লেবানন-ইসরায়েল সীমান্তে যুদ্ধ শুরু হলে আশপাশের অঞ্চল থেকে যোদ্ধারা যোগ দেবেন। এমন হাজার হাজার যোদ্ধা ইতোমধ্যেই সিরিয়ায় মোতায়েন রয়েছেন। তারা সহজেই গোপনে সীমান্ত দিয়ে লেবাননে পৌঁছে যেতে পারেন। ইরাকে ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে তারা হিজবুল্লাহর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করব।
অবশ্য হিজবুল্লাহর বিশেষজ্ঞ কাসিম কাসির বলেন, বর্তমানের যুদ্ধের বড় অংশই উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর, যেমন– ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা। আর এর জন্য বিপুল সংখ্যক যোদ্ধার প্রয়োজন নেই। তবে পূর্ণ মাত্রায় যুদ্ধ শুরু হলে এবং তা দীর্ঘ সময় ধরে চললে হিজবুল্লাহকে লেবাননের বাইরে থেকে সমর্থনের প্রয়োজন হতে পারে।
বিদেশি যোদ্ধারা যোগ দিলে ইসরাইলের বিরুদ্ধে আরও শক্তিশালী যুদ্ধ হবে বলেই ধারণা করা যায় অনায়াসে।
লেবাননে অন্য দেশ থেকে যোদ্ধা আসতে পারে, সে ব্যাপারে ইসরাইলও সতর্ক রয়েছে। হিজবুল্লাহর ডেপুটি লিডার নাইম কাসেম গত সপ্তাহে বলেন, এই যুদ্ধ ইসরাইলের ব্যাপক ক্ষতির কারণ হবে। যদি বিদেশি যোদ্ধা যোগ দেয়, তাহলে তা হবে ইতিবাচক। এর আগে ইসরাইল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে সর্বশেষ বড় আকারের সংঘাত হয়েছিল ২০০৬ সালে। তখন ইসরাইলেকে নাজেহাল বানিয়ে ছাড়ে হিজবুল্লাহ।
এরইমধ্যে ইসরাইলি বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ স্পর্শকাতর বিভিন্ন স্থাপনার ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে হিজবুল্লাহ। ইসরাইল সরকার যখন হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে ঠিক তখনি হিজবুল্লাহর সামরিক গণমাধ্যম বিভাগ এই ফুটেজ প্রকাশ করলো। এসব ফুটেজে যেসব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাকে চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে নেগেভ মরুভূমিতে অবস্থিত ইসরাইলের দিমোনা পরমাণু চুল্লি, তেল আবিবের বেন গুরিয়ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং নেভাতিম বিমানঘাঁটি।
এর বাইরে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে যার মধ্যে রয়েছে হাকিরিয়া কমপ্লেক্স। সেখানে রয়েছে ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর জেনারেল স্টাফ এবং অনেক শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের আবাসস্থল। এছাড়া রয়েছে রামাত ডেভিড বিমান ঘাঁটি এবং লেবানন উপকূলের কারিশ গ্যাসক্ষেত্রও।
এতেই প্রমাণিত হয়, আটঘাট বেধেই রণক্ষেত্রে নেমেছে হিজবুল্লাহ। হিজবুল্লাহ নেতার ওই হুঁশিয়ারির পর আরব বিশ্বের প্রখ্যাত রাজনৈতিক ভাষ্যকার আব্দুল বারি আতওয়ান বলেছেন, ইসরাইল লেবাননের বিরুদ্ধে কোনো রকম কাপুরুষতা দেখানোর চেষ্টা করলে হিজবুল্লাহ তার দাঁতভাঙা জবাব দেবে।
ইসরাইল ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মার্কিন সাংবাদিক থমাস ফ্রাইডম্যানের স্বীকারোক্তির বিষয়ে আতওয়ান লিখেছেন, নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক ফ্রাইডম্যান একথা স্বীকার করেছেন যে, ইসরাইলকে এখন গাজা, লেবানন ও পশ্চিম তীর- এই তিন ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। যে ইসরাইলকে আমরা এতদিন চিনতাম, তা পতনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এই ইসরাইল এখন ইরান নামক একটি বড় শক্তির মুখোমুখি, যে শক্তি মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রক্সি ও সামরিক সক্ষমতাগুলো ব্যবহার করে ইসরাইলকে ধ্বংস করে দিতে চায়।
আতওয়ান তার নিবন্ধে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আসলে যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যে একটি বড় ধরনের যুদ্ধে জড়াতে চান। তবে এই যুদ্ধে মূলত লাভের ফসল ঘরে তুলবে রাশিয়া ও চীন। কী বুঝলেন, যুদ্ধ হবে মধ্যপ্রাচ্যে আর তাতে লাভবান হবে বিশ্বের পরাশক্তিরা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।