জুমবাংলা ডেস্ক: দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনার ঈশ্বরদী ও মাগুরার ইছাখাদা এলাকার লিচুর পাশাপাশি ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার জাহাপুরের লিচুও জনপ্রিয় হচ্ছে। ক্রেতারা লুফে নিচ্ছেন জাহাপুরের লিচু। এ বছর উপজেলার ২৬ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে বলে জানা গেছে।
ফরিদপুরের বোয়ালমারী পৌরসভার ছোলনা এলাকার ফল ব্যাপারী মো. রাজু মোল্লা (৫১)। তার সঙ্গে কথা হয় মধুখালী উপজেলার জাহাপুর ইউনিয়নের জাহাপুর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুস সাত্তার শেখের (৭৫) লিচু বাগানে। এটিই এলাকার সবচেয়ে বড় লিচুর বাগান। গাছের সংখ্যা ১৩০টি। ওই এলাকায় লিচু চাষি হিসেবে আব্দুস সাত্তার শেখ প্রবীণ। লিচু চাষ লাভজনক হওয়ায় তার দেখাদেখি গাছ থেকে কলম করে অন্যরা লিচু বাগান করছেন।
বর্তমানে মধুখালীর জাহাপুর ইউনিয়নসহ পাশের বোয়ালমারীর সাতৈর, ফরিদপুর সদরের চাঁদপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরলে বেশ কয়েকটি লিচু বাগান চোখে পড়ে। লিচু গাছ নেই- এমন একটি বাড়িও যেন খুঁজে পাওয়া যাবে না ওই এলাকায়। বাড়িতে এক শতাংশ বাড়তি জমি থাকলেই সেখানে রোপণ করা হয়েছে লিচুর গাছ।
লিচুর ব্যাপারী মো. রাজু মোল্লা বলেন, দেশের যেসব জায়গায় লিচুর সবচেয়ে ভালো ফলন হয়, ওইসব জায়গার লিচু আমি বিক্রি করেছি। ক্রেতা ধরতে অনেক রকম গুণের কথাও আমরা বলে থাকি। তবে আমি মধুখালীর এই লিচু সম্পর্কে বলব, অন্য জায়গায় আরও বড় আকারের মিষ্টিযুক্ত লিচু পাওয়া গেলেও জাহাপুরের (মধুখালী) লিচুর বৈশিষ্ট ভিন্ন। এ লিচুর রঙ ভালো, মান ভালো, খেতে সুস্বাদু, দামও সহনশীল। বাড়তি সুবিধা হচ্ছে এ জায়গার লিচু পাকে আগে। গত ঈদুল ফিতরের সময় থেকেই বাজারজাত করা হচ্ছে জাহাপুরের লিচু।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাহাপুরে বেশ কয়েকজনের লিচুর বাগান রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মোজাফফরপুরী জাতের। কিছু বোম্বাই, , চায়না থ্রি, বেদানা ও ভেরি জাতের।
লিচু চাষিরা জানান, মোজাফফরপুরী জাতের লিচুর ফলন ভালো, বোম্বাই জাতও মানসম্মত। যদিও সব ফলই গাছে এক বছর বেশি ধরে পরের বছর কম। মোজাফফরপুরী ও বোম্বাইয়ের ফলন মোটামুটি ভালো। তবে চায়না জাতের লিচুর ওপর একেবারে ভরসা করা কঠিন। তাই লিচু চাষিদের মধ্যে মোজাফফরপুরী জাতের লিচুর পাশাপাশি বোম্বাই জাতের লিচুর প্রতি আগ্রহ বেশি। পাকার দিক থেকে মোজাফফরপুরী জাতের লিচু আগে পাকে, বোম্বায় পাকে তার চেয়ে ১০ থেকে ১৫ দিন পরে।
ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার জাহাপুর ইউনিয়নের জাহাপুর, দপ্তরদিয়া, টেংরাকন্দি, মনোহরদিয়া, চর মনোহরদিয়া, খাড়াকান্দি ও মির্জাকান্দি গ্রাম এবং পাশের ফরিদপুর সদরের চাঁদপুর ইউনিয়নের চাঁদপুর ও চতরবাজার কান্দি গ্রামে লিচুর আবাদ বেশি হয়।
ওই এলাকার প্রবীণ লিচু চাষি আব্দুস সাত্তার শেখের (৭৫) ভাষ্য মতে, জাহাপুরে অন্তত চারশ বছর আগে একজন জমিদার ছিলেন। ওই জমিদার পরিবারের উদ্যোগে প্রায় তিনশ বছর আগে ভারতের মাদ্রাজ থেকে লিচুর গাছ এনে জাহাপুরে একটি বাগান করা হয়। ১৯৩৬ সালে বাগানের লিচু গাছগুলো প্রায় কেটে ফেলা হয়। পরবর্তীতে জাহাপুর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুস সাত্তার শেখ ৫৪ বছর আগে জাহাপুরে লিচুর বাগান করেন। তার বাগানে অন্তত তিনশ বছরের পুরোনো মোজাফপরপুর জাতের একটি লিচু গাছ রয়েছে। পরের গাছগুলো ওই গাছ থেকে কলম করা।
সাত্তার শেখের দেখাদেখি এলাকার অনেকেই লিচু চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। অনেকে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব বাগান।
ফরিদপুরে বাণিজ্যিকভাবে লিচুর চাষ হয়ে আসছে গত প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে। তবে গত ১৪ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে লিচুর আবাদ অনেক বেড়েছে। এ ব্যাপারে লিচু বাগানের কয়েকজন মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যে সময়ে লিচু হয়, সে সময়ে বিভিন্ন ধরনের ডাল, গম, পাট ও ধানের চাষ করা হয়। শ্রমিকের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং লিচু চাষ লাভজনক হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে লিচু চাষের প্রতি চাষিরা আগ্রহী হচ্ছে।
শ্রমিকের দাম বেড়ে যাওয়া ও সংকটের বিষয়ে প্রবীণ লিচু চাষি আবদুস সাত্তার শেখ বলেন, আগে একজন শ্রমিককে সারা বছর বাড়িতে রেখে খাওয়া-দাওয়া দিয়ে বছর শেষে দুইশ টাকা দিলেই তিনি খুশি হতেন। এখন বছর শেষে এক লাখ টাকা দিলেও শ্রমিক পাওয়া যায় না। শ্রমিকের দাম বেড়ে যাওয়ায় অন্যান্য ফসল ছেড়ে জমিগুলোতে লিচু বাগান করা হয়েছে।
লিচু চাষি সুলতান আহমেদ জানান, আশ্বিন-কার্তিক মাসেই লিচু গাছের পরিচর্যা শুরু করতে হয়। সার দিতে হয়। সার ঠিকমতো মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার জন্য ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ দিতে হয়। কার্তিক থেকে শুরু করে বৈশাখের মাঝামাঝি লিচু পাকা পর্যন্ত অন্তত ছয়বার ওষুধ স্প্রে করতে হয় যাতে লিচুতে পোকা না ধরে। তাছাড়া লিচু পাকতে শুরু করলে কাঠ বিড়ালি, বাদুর, চামচিকার উপদ্রব তো আছেই। লিচু পাড়তে ও থোকা বানাতে শ্রমিকের সহযোগিতার প্রয়োজন।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি বছর লিচু চাষিরা প্রকৃতির বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন। প্রচণ্ড তাপদাহে লিচু ঝরে পড়েছে। আবার যখন লিচু পাকতে শুরু করেছে, গায়ে রঙ এসেছে তখন বৃষ্টিতে ক্ষতি হয়েছে। ফলে গাছে যে লিচু ধরেছিল, তার অর্ধেকও বাজারে বিক্রি করার মতো হয়নি।
ওই এলাকার গৃহবধূ রুবিয়া বেগম (৫২) বলেন, লিচুর বাগানে অনেক কাজ থাকে। পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরাও কাজ করি। এই সময়ে কাজ করতে আমাদেরও ভালো লাগে।
ওই বাগানে কাজ করা বজলু মল্লিক বলেন, জাহাপুরের লিচুর মান ভালো। সারাদেশেই এর কদর আছে। দিন দিন এই লিচুর কদর বেড়েই যাচ্ছে। একদিন আমরা লিচু চাষেও অনেক ভালো করব।
মধুখালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আলভীর রহমান বলেন, এ উপজেলায় এ বছর ২৬ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে। প্রতি হেক্টর জমিতে ৯ টন লিচু উৎপাদন হয়। এবার শুধু মধুখালী উপজেলায় প্রায় পাঁচ কোটি টাকার লিচু বিক্রি হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. হযরত আলী বলেন, জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে মধুখালী ছাড়াও বোয়ালমারী ও ফরিদপুর সদরে লিচুর বাণিজ্যিক আবাদ হচ্ছে। তবে জেলায় মোট কী পরিমাণ জমিতে লিচুর আবাদ এবং উৎপাদন হয় তার পরিসংখ্যান আমাদের হাতে নেই।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।