স্পোর্টস ডেস্ক : লিওনেল আন্দ্রেস লিও মেসি। কারো কাছে তিনি ফুটবলের জাদুকর, কারো কাছে আবার লাতিন ফুটবলের ত্রাতা। তবে আর্জেন্টিনার সমর্থকরা মনে করেন, মেসিই সর্বকালের সেরা ফুটবলার।
সবশেষ ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে মেসির কাঁধে ভর করেই ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তোলে আর্জেন্টিনা। দলকে তিনি এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যে শিরোপার জন্য ম্যারাডোনার উত্তরসূরিরা বহু বছর অপেক্ষায় ছিলো।
সাবেক এই বার্সেলোনা তারকা বর্তমানে ফরাসি ফুটবল ক্লাব পিএসজিতে খেলছেন। ক্লাব পর্যায়ে এবং আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের হয়ে, উভয় মঞ্চেই তিনি এখন জীবন্ত কিংবদন্তী। বিশ্বের অন্যতম প্রতিভাবান এ ফরোয়ার্ড ফুটবলে রেকর্ড গোল ও এ্যাসিস্ট করেছেন।
‘লা পুলগা’ নামে পরিচিত এই অন্যতম প্রতিভা সম্পর্কে আমরা কতটা জানি, এখানে চেষ্টা করা হয়েছে মেসি ভক্তদের সেই তথ্য ক্ষুদা নিবারণের।
পিএসজির সঙ্গে লিওনেল মেসির চুক্তি এবং বেতন
টানা ১৭ মৌসুম স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনার হয়ে মাঠ কাঁপিয়েছেন মেসি। খুব কম বয়সেই ক্লাবটিতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি এবং পরবর্তীকালে তার হাত ধরেই অসংখ্য ট্রফি জিতেছে বার্সেলোনা।
২০২১ সালের গ্রীষ্মে যখন বার্সেলোনার সঙ্গে তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়, তখন তিনি ক্লাবটি ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ক্লাবের আর্থিক অব্যবস্থাপনার কারণে তিনি বিনামূল্যে পিএসজিতে যোগ দেন এবং তার প্রথম মৌসুমেই ফরাসি লিগ শিরোপা জয় করে পিএসজি।
ফ্রান্সের রাজধানীতে আসার পর, মেসি দুই বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। ২০২৪ সালের গ্রীষ্ম পর্যন্ত পিএসজির জার্সিতেই মাঠে নামবেন এ তারকা ফুটবলার।
ফরাসি প্রকাশনা লা ইকুইপের প্রতিবেদন অনুসারে, পিএসজিতে মেসি তিন বছরে ১১০ মিলিয়ন ইউরো আয় করবেন। প্রথম মৌসুমে মেসির আয় ৩০ মিলিয়ন ইউরো এবং পরবর্তী মৌসুমে যা হবে ৪০ মিলিয়ন। মেসির চুক্তির আর্থিক দিক তার ব্রাজিলিয়ান সতীর্থ নেইমারের মতোই।
পিএসজি মেসির চুক্তি বাড়ানোর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এমন গুঞ্জনও উঠেছে। গত বিশ্বকাপে তার দুর্দান্ত পারফর্ম এই গুঞ্জনকে আরও জোড়ালো করেছে। তবে মেসি অন্য কোথাও যাওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন এবং মৌখিকভাবে পিএসজিতে চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে রাজি হয়েছেন। নতুন চুক্তি নিয়ে ক্লাবের সাথে তার আলোচনাও চলছে।
লিওনেল মেসির যতো শিরোপা
লিওনেল মেসি তার উজ্জ্বল ক্যারিয়ারে অগণিত ট্রফি জিতেছেন। তবে কাতারে তার সাফল্য তাকে কিংবদন্তী পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
২০২১ সালের গ্রীষ্মে ক্লাব ছাড়ার আগে তিনি বার্সেলোনার হয়ে ১০টি লা লিগা শিরোপা, সাতটি স্প্যানিশ কোপা দেল রে মুকুট এবং চারটি উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জিতেছেন।
মেসি পিএসজির সাথে তার প্রথম মৌসুমে ফ্রেঞ্চ লিগ ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয় করেন। ফ্রেঞ্চ কাপ (কুপ দো ফঁসে) এখনও লা প্যারিসিয়ানদের তালিকায় রয়েছে।
লা লিগার সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন আট মৌসুমে। লিগের বর্ষসেরা হয়েছেন ছয় বার। ফিফা ক্লাব কাপ জিতেছেন তিন বার। উয়েফা সুপার কাপ তিনবার জিতেছেন। ইউরোপে শীর্ষ স্কোরার হয়েছেন ছয় মৌসুমে। ব্যালন ডি ‘অর জিতেছেন রেকর্ড সাতবার। ফিফার বর্ষসেরা হয়েছেন দুইবার। আর্জেন্টিনার হয়ে কোপা আমেরিকার পার জিতেছেন বিশ্বকাপও।
মেসি ফিফা বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল জিতেছেন দুইবার ২০১৪ ও ২০২২ সালে। ২০০৮ সালে জিতেছেন অলিম্পিক স্বর্ণপদক। নিজ দেশে বর্ষসেরা হয়েছেন চারবার।
মেসির বার্সেলোনা ও পিএসজি ক্লাব ক্যারিয়ার
মেসি তার বাল্যকালের ক্লাব নোয়েলস ওল্ড বয়েজের হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। পরে তিনি ২০০০ সালে ১৩ বছর বয়সে বার্সেলোনার বিখ্যাত লা মাসিয়া যুব একাডেমিতে যোগ দেন। এ সময় স্পেনে তিনি গ্রোথ হরমোন ডিসঅর্ডারের জন্য চিকিৎসাও গ্রহণ করেন।
মেসি ২০০৪ সালে ১৮ বছর বয়সে বার্সেলোনার হয়ে তার পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু করেন। একই বছরের ১৬ অক্টোবর ডার্বি প্রতিদ্বন্দ্বী এস্পানিওলের বিরুদ্ধে শেষ আট মিনিটের জন্য মাঠে নামেন তিনি। সেই মৌসুমে পরে তিনি তার প্রথম পেশাদার গোলটিও করেছিলেন। তার পিঠে ভর করেই ১মে, ২০১৫-এ আলবাসেতেকে ২-০ গোলে হারিয়েছিল বার্সোলনা।
সেখান থেকে মেসি দ্রুত প্রথম দলের খেলোয়াড় এবং পরের মৌসুমে নিয়মিত স্টার্টার হয়ে ওঠেন। দ্রুত তিনি বার্সেলোনার কিংবদন্তি হয়ে উঠেন। কাতালান ক্লাবের হয়ে মোট ৭৭৮টি ম্যাচে ৬৭২টি গোল করেছেন। পাশপাশি ৩০৩টি গোল এ্যাসিস্টও করেন। তিনি চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা, ১০টি লা লিগা চ্যাম্পিয়নশিপ এবং সাতটি কোপা দেল রে শিরোপা জিতেছেন, যেখানে তিনি আটবার স্প্যানিশ শীর্ষ ফ্লাইটের শীর্ষস্থানীয় গোলদাতা হয়েছেন।
২০২১ সালের গ্রীষ্মে মেসির বার্সেলোনার চুক্তির মেয়াদ শেষ হবার সঙ্গে মঙ্গে ক্লাবটি উল্লেখযোগ্য আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়। ফলে স্প্যানিশ লিগের দ্বারা নির্ধারিত খেলোয়াড়ের মজুরি সীমা পূরণ করতে মেসিকে বিনামূল্যে যেতে দিতে বাধ্য হয়েছিল ক্লাবটি। তবে ক্যারিয়েয়ারের ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে এটি কঠিন কিন্তু, মেসির জন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত ছিলো।
পিএসজির কাতারি মালিকানা গোষ্ঠী সেই সুযোগটাই নিয়েছিল। ক্লাবটি মেসির সাথে তিন বছরের চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এই আশায় যে, এ কিংবদন্তি ফরোয়ার্ড ক্লাবটিকে বছরের পর বছর ধরে তাড়া করা অধরা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের মুকুটটি সুরক্ষিত করতে সহায়তা করবে।
আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে লিওনেল মেসি
অবশেষে ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপে মেসি জাতীয় দল ও তার ক্যারিয়ারকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান। তিনি বার্সেলোনায় নিজেকে একজন বিশ্ব সুপারস্টার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। যদিও ২০২২ সালের আগে মেসির আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ অর্জনই ছিলো ক্লাবে। ২০২১ সালে কোপা আমেরিকায় আর্জেন্টিনা দলের সাথে প্রথম বড় ট্রফি জিতেছিলেন তিনি।
২০০৬ সালের বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনা জার্মানির কাছে ১-০ গোলে হেরে যাওয়ার সময় মেসি সাইডলাইন থেকে তা দেখেছিলেন। ইউরোপীয় দেশ আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ধারাবাহিক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলো, মেসির প্রথম চারটি বিশ্বকাপের তিনটি থেকেই তারা বাদ পড়ে। ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে সেই হেড টু হেড ম্যাচগুলোর মধ্যে একটি হয়েছিল, যেখানে জার্মানি শিরোপা জয়ের জন্য অতিরিক্ত সময়ে একমাত্র গোলটি করেছিল। মেসি সে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের জন্য গোল্ডেন বল জিতেছিলেন।
বিশ্বকাপ হতাশা ছাড়াও, কোপা আমেরিকাও ছিলো হৃদয়বিদারক। আর্জেন্টিনা ২০০৭-২০১৬ সালের মধ্যে চারটি টুর্নামেন্টের তিনটিতে ফাইনালে পৌঁছালেও চিলির কাছে দুটি পেনাল্টি কিকসহ তিনটিই হেরেছিলো।
কিন্তু মেসির মুহূর্তটি অবশেষে ২০২১ সালের কোপা আমেরিকায় এসেছিল, যেখানে তিনি তার দলকে জয়ের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। দলের সিনিয়র খেলোয়াড়দের সাথে তিনি তার প্রথম আন্তর্জাতিক ট্রফি হাতে তুলেছিলেন। মেসি চারটি গোল করেন এবং পাঁচটিতে সহায়তা করেন, ফাইনালে ব্রাজিলকে ১-০ ব্যবধানে পরাজিত করেছিল আর্জেন্টিনা।
সাম্প্রতিক স্মৃতিতে সেই জয়ের সাথে তিনি ২০২২ সালের জুনে ফিনালিসিমার প্রথম সংস্করণে ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়ন ইতালির বিরুদ্ধে ৩-০ ব্যবধানে জয় তুলে আনেন। মেসি এবং তার দল আর্জেন্টিনা টানা ৩৬ ম্যাচের অপরাজিত থেকে ২০২২ সালের ফিফা বিশ্বকাপে মাঠে নামে।
মেসি নিশ্চিত করেছিলেন যে, বিশ্বকাপে গ্রুপ-পর্যায় থেকে বাদ পড়ার কোনো শঙ্কা নেই আর্জেন্টিনার। এবং তিনি টুর্নামেন্টের প্রতিটি ম্যাচেই গোলের জন্য মরিয়া ছিলেন। শেষ পর্যন্ত আর্জেন্টিনা ফাইনালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে একটি চাঞ্চল্যকর জয় পায়।
লিওনেল মেসির মোট সম্পদ
ইনসাইডার ও ফোর্বসের মতে, মেসি ২০২১-২২ মৌসুমে সর্বোচ্চ বেতনভুগী ক্রীড়াবিদ ছিলেন। বেতন, স্পনসরশীপ ও অন্যান্য আয় মিলিয়ে ২০০১ সালের মে থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মেসি ১৩০ মিলিয়ন ডলার আয় করেছেন।
আনুমানিক ৭৫ মিলিয়ন ডলার আসে পিএসজির সঙ্গে চুক্তি থেকে। যার মধ্যে ৩৫ মিলিয়ন ডলার বেতন হিসেবে এবং ২৫ মিলিয়ন ডলার সাইনিং বোনাস হিসেবে। এছাড়াও ছবি এবং ভিডিও’র স্বত্ত্ব এবং বোনাস থেকে প্রচুর আয় করেন মেসি।
সোসিওস, পেপসি, অ্যাডিডাস, বাডওয়েজার এবং হার্ড রকের মতো সংস্থাগুলোর সাথে মেসির কোটি কোটি ডলারের চুক্তি রয়েছে। উদ্যোক্তা ও আর্থিক ট্র্যাকিং ব্লগ অয়েলথি গরিলা অনুসারে, লিওনেল মেসির মোট সম্পদ ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত ৬০০ মিলিয়ন ডলারের ওপরে।
২০২২ সালের জুনের ফোর্বস রিপোর্ট বলছে, মেসির কেরিয়ারের আয় প্রায় এক দশমিক এক বিলিয়ন ডলার। বিশ্বকাপ জয়ের পরে তার আয় আরও বাড়তে পারে।
লিওনেল মেসির স্ত্রী ও পরিবার
মেসি ৩৪ বছর বয়সী আর্জেন্টাইন মডেল আন্তোনেলা রোকুজ্জোকে বিয়ে করেছেন, যিনি তার নিজের শহর রোজারিও’র বাসিন্দা। কথিত আছে যে, তারা পাঁচ বছর বয়স থেকে একে অপরকে চিনতেন এবং ২০০৯ সালে মেসি মাত্র ২২ বছর বয়সে প্রকাশ্যে ডেটিং শুরু করেন। তারা ২০১৭ সালে বিয়ে করেন এবং তাদের তিন ছেলে রয়েছে- থিয়াগো (২ নভেম্বর, ২০১২), মাতেও (১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫) এবং সিরো (১০ মার্চ, ২০১৮)।
মেসির বাবা হোর্হে মেসি তার পুরো ক্যারিয়ারে ছেলের এজেন্ট হিসেবেই কাজ করেছেন। যা শুরু হয়েছিল যখন লিও ১৩ বছর বয়সে রোজারিও থেকে কাতালোনিয়ায় পাড়ি জমান। সে সময় মেসি তার বার্সেলোনার ভবিষ্যত সুরক্ষিত করেছিলেন এবং একই সাথে তার গ্রোথ হরমোন ডিসঅর্ডার রোগের চিকিৎসার জন্য ক্লাব থেকে আর্থিক সাহায্য পেয়েছিলেন। বার্সেলোনায় মেসির প্রথম চুক্তি একটি ন্যাপকিনে সই করা হয়েছিল!
লিও ছিলে মা-বাবার চার সন্তানের মধ্যে তৃতীয়, তার তিন ভাইবোন রয়েছে। দুই বড় ভাই হলেন, রদ্রিগো এবং মাতিয়াস এবং ছোট বোন মারিয়া সোল।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।