জুমবাংলা ডেস্ক : ঋণের নামের ব্যাংকের টাকা হরিলুটের দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে একাই ব্যাংক খাত থেকে ঋণের নামে প্রায় সাড়ে ৩৬ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ বের করে নিয়েছেন। তিনি ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, অনেক আগেই এসব ঋণ খেলাপিতে পরিণত হওয়ার কথা। কিন্তু ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে একাধিকবার পুনঃতফশিলের মাধ্যমে তার লুটপাটের ঋণের বেশির ভাগই অ-খেলাপির তালিকায় রাখা হয়।
শুধু তাই নয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে নেওয়া ইডিএফ (এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড) ঋণের ৬৫৫ কোটি টাকা (৫ কোটি ৬ লাখ মার্কিন ডলার) পরিশোধ করেননি।
বেক্সিমকো গ্রুপের কাছ থেকে এসব ডলারের ঋণ ফেরত আনতে না পারার কারণে ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ইডিএফ ঋণ সুবিধা দেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। ইডিএফ ঋণ দেওয়া হয় মূলত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে। এই ঋণ রপ্তানিকারকদের ৩ থেকে ৪ শতাংশ সুদহারে দেওয়া হয়। নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত বেক্সিমকো একটি সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য নয়টি নতুন কোম্পানি চালু করে। এর মধ্যে ২০২২ সালে মাত্র এক মাসে আটটি নতুন কোম্পানি তৈরি করে। পরে ওই সব কোম্পানির নামে ঋণ নেওয়া হয়।
সর্বশেষ হিসাবে সালমান এফ রহমানের ব্যাংক ঋণের অঙ্ক ৩৬ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি ব্যাংক আইএফআইসি থেকে একাই ১১ হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে বের করে নিয়েছেন। ওই ব্যাংকের শীর্ষ ৩০ বড় ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রায় দশটির মালিক সালমান এফ রহমান। তিনি আবার ব্যাংকটির চেয়ারম্যানও। বাকি অর্থ নিয়েছেন রাষ্ট্রায়ত্তসহ ছয়টি ব্যাংক থেকে। সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যাংকের টাকায় ফ্রিতে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনেছেন সালমান এফ রহমান।
গত মঙ্গলবার রাতে পালানোর সময় রাজধানীর সদরঘাট এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় সালমান এফ রহমানকে। তাকে দশ দিনের রিমান্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
ঋণখেলাপিদের নিয়ে ভাবনা জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন জানান, এখন ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোই প্রথম কাজ। ব্যাংকগুলো আগে পুরোপুরি চালু হোক। এরপর অন্য বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা হবে। ব্যাংক খাতের দুর্নীতি নিয়ে কয়েক বছর ধরে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ঋণের নামে টাকা বের করে সরকারি ও বেসরাকরি ব্যাংকগুলোর আমানতকারীদের হুমকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এসব কাজ যারা করেছেন তদের মধ্যে দ্বিতীয় বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান। যিনি সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ছিলেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের সাবেক এক কর্মকর্তা জানান, সালমান এফ রহমান ২০০৫ সালেও ঋণখেলাপি ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই ঋণখেলাপি সরকারের নীতিনির্ধারক বনে গেছেন। ফলে যা হওয়ার ব্যাংক খাতে তাই হয়েছে।
সূত্র মতে, সরকারি ব্যাংকগুলো থেকে নানা কৌশলে ঋণের নামে হাতিয়ে নিয়েছে ২৭ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি একটি ব্যাংকের বিতরণ করা ৯৮ হাজার কোটি টাকার ঋণের ২৫ দশমিক ৫১ শতাংশই বেক্সিমকোর মালিকাধীনা ৩০টি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। ওই ব্যাংকের ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। এতে ব্যাংকটি লোকসানের মুখে পড়ে। এছাড়া বেক্সিমকোর ৩০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৬টি একক ঋণগ্রহীতার এক্সপোজার সীমা লঙ্ঘন করেছে। ২০১৫ সালে বেক্সিমকো ও এর আওতাধীন প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৪৫ কোটি টাকা এবং ২০২০ সালে যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকায়। সর্বশেষ এ বছরের জুন শেষে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ২ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা, আইএফআইসি ব্যাংকে ৬ হাজার ৩১ কোটি টাকা (কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে ১১ হাজার কোটি টাকা) ও এবি ব্যাংক থেকে ৬০৫ কোটি টাকার ঋণ নেওয়া হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু আইএফআইসি ব্যাংকেই সালমান এফ রহমানের নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। ন্যাশনাল ব্যাংকে সালমান এফ রহমানের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠান ব্লুম সাকসেস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের ৮৩৬ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে।
দেশি ব্যাংকিং ব্যবস্থা ছাড়াও রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে (ইডিএফ) বেক্সিমকো গ্রুপ ৫৬ মিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়। বর্তমান দেশি মুদ্রায় এ অঙ্ক ৬৫৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে স্প্রিংফুল অ্যাপারেলসের কাছে ১২.২৫ মিলিয়ন ডলার, পিঙ্ক মেকার গার্মেন্টসের কাছে ৮.৫৩ মিলিয়ন ডলার, অটাম লুপ অ্যাপারেলসের কাছে ৪.৩৬ মিলিয়ন ডলার ও প্লাটিনাম গার্মেন্টসের কাছে ০.২৮ মিলিয়ন ডলার ইডিএফ ঋণের বকেয়া পাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা যিনি বিভিন্ন সময় ব্যাংক পরিদর্শন টিমের সঙ্গে কাজ করেছেন। তার মতে, ভিন্ন ভিন্ন নামে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যান থাকলেও ঋণগুলো আসলে বাগিয়ে নিয়েছেন সালমান এফ রহমান। তার বেনামি এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগের ঠিকানা গুলশান, বাড্ডা, রামপুরা এলাকায়। সরেজমিন গেলে এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো যথার্থ কার্যক্রম পাওয়া যায় না।
প্রসঙ্গত ২০১৪ সালের ৫ আগস্ট সালমান এফ রহমানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আওতায় বেক্সিমকো গ্রুপের ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ পুনর্গঠন করা হয়। এরপর থেকে খেলাপি হওয়া ঠেকাতে বেক্সিমকো গ্রুপকে বাড়তি সুবিধা দেওয়া শুরু করে ব্যাংকগুলো।
সূত্র : যুগান্তর
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।