জিয়াদুল ইসলাম : গ্রামের দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে চালু করা হয় এজেন্ট ব্যাংকিং। শাখাবিহীন এ সেবায় প্রতিদিনই বাড়ছে গ্রাহক ও লেনদেনের পরিমাণ। কিন্তু এ সেবার মাধ্যমে আমানত যে হারে বাড়ছে, ঋণ বিতরণ হচ্ছে তার চেয়ে অনেক কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত মার্চ পর্যন্ত হিসাবে গ্রাম থেকে আসা ৭৬ শতাংশ আমানতের বিপরীতে ঋণ বিতরণ হয়েছে মাত্র ৩১ শতাংশ। এর মানে সিংহভাগ আমানতের যারা জোগানদাতা, সেই গ্রামের মানুষই ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বেশি বঞ্চিত। এ সময়ে অন্তত ১১ ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিয়ের আওতায় এক টাকাও ঋণ বিতরণ করেনি। বিশ্লেষকরা বলছেন, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আমানত তুলে শহরে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে গ্রামের সম্পদ শহরে স্থানান্তর হচ্ছে। এতে পিছিয়ে পড়ছে গ্রামীণ অর্থনীতি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের নেতিবাচক দিক হলোÑ এর মাধ্যমে গ্রামের সম্পদ শহরে স্থানান্তর হচ্ছে। এটা অনেকটা অর্থ পাচারের মতো, যেন দেশ থেকে টাকাটা বিদেশে চলে যাচ্ছে। তিনি বলেন, গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো বিকল্প উপায় না পেয়ে তাদের কষ্টার্জিত সঞ্চয়ের টাকা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে আমানত জমা করছে। এতে ব্যাংকগুলোর আমানত ফুলে-ফেঁপে উঠছে। কিন্তু ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে শহরকেই প্রাধান্য দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। ফলে পিছিয়ে পড়ছে গ্রামীণ অর্থনীতি।
২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা সংক্রান্ত নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। নীতিমালায় প্রথমে শুধু পল্লী এলাকায় এজেন্ট ব্যাংকিং করার সুযোগ দেওয়া হলেও পরের বছর নীতিমালা কিছুটা সংশোধন করে পৌর ও শহর অঞ্চলেও এজেন্ট ব্যাংকিং চালুর সুযোগ দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত ৩১টি ব্যাংকে এজেন্ট ব্যাংকিং চালুর অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক; যার সবগুলোই কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের বিকল্প নেই। এর মাধ্যমে মানুষের দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবাকে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। এটা ব্যাংকের খরচও বাঁচিয়েছে। গ্রাহকরাও কম খরচে ও দ্রুত সময়ে ব্যাংকে না গিয়েও প্রায় সব সেবা পাচ্ছে এজেন্ট বুথে। এখন বাসাবাড়ির নিচে বা বাসাবাড়ি থেকে একটু দূরে স্থানীয় হাটবাজারে এজেন্ট আউটলেট বা বুথেই ব্যাংকের মতো প্রায় সব ধরনের সেবা পাওয়া যাচ্ছে। অ্যাকাউন্ট খোলার সুবিধা থেকে শুরু করে আমানতের টাকা জমা ও উত্তোলন, মোবাইল টপ-আপ, টাকা স্থানান্তর (দেশের ভেতর), রেমিট্যান্সের অর্থ উত্তোলন, ইউটিলিটি বিল এবং যানবাহনের লাইসেন্স ও ফিটনেস ফি গ্রহণ, বিভিন্ন ধরনের ঋণ বিতরণ ও আদায় এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সব ধরনের ভাতা এ সেবার মাধ্যমে সুবিধাভোগীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এ সেবায় বাড়তি কোনো চার্জও নেই। এছাড়া ডেবিট কার্ড, চেকবই ও ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের সুবিধাও নিতে পারেন এজেন্ট ব্যংকিংয়ের গ্রাহকরা। রয়েছে বায়োমেট্রিক বা হাতের আঙুলের স্পর্শের মাধ্যমে হিসাব পরিচালনা করার সুযোগও। ফলে এ সেবার জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতি ত্রৈমাসিকে এজেন্ট ব্যাংকিং নিয়ে একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সর্বশেষ ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ২০ হাজার ৭৩৬টি এজেন্ট বুথের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংকে ১ কোটি ৮৯ লাখ ৩৪ হাজার ১৫৩ গ্রাহক হিসাব খুলেছেন। একই সময়ে এজেন্ট ব্যাংকিয়ে আমানতের পরিমাণ ছিল ৩১ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ঋণ বিতরণ হয় মাত্র ১১ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ সময় পর্যন্ত আমানতের ৩৭ শতাংশেরও কম ঋণ বিতরণ হয়েছে। এ সময়ে গ্রাম থেকে আসা আমানতের পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা, যা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে সংগৃহীত মোট আমানতের ৭৬ দশমিক ২৭ শতাংশ। অন্যদিকে গত মার্চ পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আওতায় গ্রামে ঋণ বিতরণ হয়েছে ৭ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। এটি গ্রাম থেকে আসা আমানতের
মাত্র ৩১ শতাংশ। একই সময়ে শহরে ঋণ বিতরণ হয়েছে ৪ হাজার ৮০ কোটি টাকা, যা শহর থেকে আসা মোট আমানতের প্রায় ৫৪ শতাংশ। এর মানে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে শহর থেকে আমানত কম আসার পরও শহরেই বেশি ঋণ বিতরণ হয়েছে। এর বাইরে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে অব্যবহৃত আমানতের অধিকাংশই ব্যাংকের শাখার মাধ্যমে শহরেই বিনিয়োগ হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আওতায় ঋণ বিতরণ কম হওয়ার কারণ জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের এজেন্ট মো. আলমগীর হোসেন বলেন, একদিকে এজেন্টদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণের সীমা কম, অন্যদিকে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে এজেন্টদের নিকটস্থ ব্যাংকের মূল শাখা থেকে অনুমোদন নিতে হয়। এছাড়া ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সব ধরনের নিয়মাচার মানা ও ঋণ ফেরত আসবে কিনা প্রভৃতি বিষয় রয়েছে। এসব কিছু মানতে গিয়ে ঋণ বিতরণ কম হচ্ছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা চালুর পর অন্তত ১১ ব্যাংক এক টাকারও ঋণ বিতরণ করতে সক্ষম হয়নি। অথচ ব্যাংকগুলো এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আওতায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করেছে। এ তালিকায় আছে এনআরবিসি ব্যাংক, স্টান্ডার্ড ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক এবং সাউথ বাংলা এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক। এছাড়া সাউথইস্ট, মধুমতি, সোশ্যাল ইসলামি ও এবি ব্যাংকের ঋণ বিতরণ পরিস্থিতিও সন্তোষজনক নয়।
বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে ব্যাংক এশিয়া সর্বপ্রথম এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু শুরু করে। এ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী বলেন, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ঋণ দেওয়ার যে প্রক্রিয়া সেটা পরিপূর্ণভাবে রপ্ত করে উঠতে পারেনি ব্যাংকগুলো। এ কারণে এখনো নিজেদের শাখা-প্রশাখার মাধ্যমে ঋণ দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে তারা। তবে সামনের দিনে এ চিত্র অবশ্যই বদলাবে। তখন এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যত টাকার আমানত আসবে, তত টাকাই বিতরণ করতে হবে। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কৃষি ঋণ এজেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে নিজেদের চ্যানেলের মাধ্যমে বিতরণের জন্য ম্যানডেট করে দিচ্ছে।
এদিকে গত সপ্তাহে প্রকাশিত আরেক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত মে শেষে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে গ্রাহক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৯৫ লাখ ৭০ হাজার ৪৫২ জন। আর আমানত বেড়ে হয়েছে ৩২ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। সূত্র : আমাদের সময়
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।