লাইফস্টাইল ডেস্ক : লাল টুসটুসে রসাল ও মিষ্টি লিচুর স্বাদ এই গরমে আরাম দেয়। জিভে জল আনা এই ফল স্বাদগ্রন্থিতে উদ্দীপিত করে তা নয়, স্বাস্থ্যের জন্যও রয়েছে প্রচুর পুষ্টিগুণ। স্বাদ ও গন্ধের জন্য লিচু অনেকের কাছেই প্রিয়। রোগ প্রতিরোধ থেকে শুরু করে ত্বকের সুরক্ষাতেও লিচু দারুণ কার্যকর। গ্রীষ্মকালীন এই রসালো ফল খুব কম সময়ের জন্য আসে। আবার কয়দিন পরেই লিচুর মৌসুম শেষ হয়ে যাবে। গ্রীষ্মকালীন এই রসালো ফল শুধু স্বাদই ভরপুর নয়, পুষ্টিগুণও আছে যথেষ্ট পরিমাণ। এ রসাল ফলে রয়েছে প্রচুর মিনারেল। এর বাইরে এতে প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেট থাকে খুব অল্প পরিমাণে। ফ্যাট না থাকায় সবার জন্য উপকারি একটি ফল। পাশপাশি এতে ক্যালরিও কম, তাই সবার জন্যে উপযুক্ত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গরমকালে শরীরকে চাঙ্গা ও সুস্থ রাখতে প্রতিদিন ডায়েটে রাখবেন এই ফল। অনেকে মনে করেন, লিচু বেশি খেলে পেটে ব্যথা শুরু হয়। কথাটি সত্য। তবে সঠিক নির্দেশিকা মেনে লিচু খেলে এই ফলের বিকল্প কিছু হয় না।
লিচু দক্ষিণ-পূর্ব চীনের কুয়াংতুং এবং ফুচিয়েন প্রদেশের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের স্থানীয় উদ্ভিদ। লিচুর ইংরেজি নাম লিচি। লিচুর বৈজ্ঞানিক নাম লিচি চাইনেন্সিস। বাংলাদেশ ছাড়াও এশিয়া মহাদেশের চীন, ইন্দোচীন, থাইল্যান্ড, জাপান, ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ, ভারত, ভিয়েতনাম ও সিঙ্গাপুর এবং অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল ও আমেরিকার ফ্লোরিডাতে লিচু চাষ হয়।
বাংলাদেশে রাজশাহী, যশোর, দিনাজপুর, রংপুর, কুষ্টিয়া, পাবনা, ময়মনসিংহ, ঢাকার সোনারগাঁ, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রামসহ আরো কয়েকটি জেলায় লিচুর চাষ হয়।
লিচু গাছ একটি লম্বা চিরহরিৎ গাছ। এই গাছ থেকে রসাল শাঁসযুক্ত ছোট ছোট ফল পাওয়া যায়। ফলটির বহিরাবরণ অমসৃণ ও লালচে গোলাপি বর্ণের; যা খাওয়া যায় না। আবরণটির ভেতরে থাকে সুমিষ্ট রসাল শাঁস। বিভিন্ন মিষ্টিজাতীয় খাবারের সাথে এটি পরিবেশন করা হয়।
বিজ্ঞানীরা নানা জাতের লিচু উদ্ভাবন করেছেন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটও বের করেছে লিচুর তিনটি জাত। এ দেশে যেসব জাতের লিচু পাওয়া যায় সেগুলো হলো বোম্বাই, মাদ্রাজি, চায়না-৩, মঙ্গলবাড়ি, মোজাফ্ফরপুরী, বেদানা লিচু, বারি লিচু-১, বারি লিচু-২, বারি লিচু-৩ ইত্যাদি। বোম্বাই লিচু টকটকে লাল, মাদ্রাজি আগাম জাত, সবচেয়ে ভালো জাত চায়না-৩। এই জাতের গাছে প্রতি বছরই ভালো ফল ধরে।
১০০ গ্রাম লিচুতে ৬৬ গ্রাম ক্যালোরি, ০.৪ গ্রাম প্রোটিন, ১.৩ গ্রাম ফাইবার, ১৫.২ গ্রাম চিনি, ০.৩ গ্রাম ফ্য়াট, ১৬.৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন সি, কপার, পটাসিয়াম। রসালো ফল লিচুর ফাইবার, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট ও চিনির মাত্রার সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত খেলে কীভাবে শরীরকে সুস্থ রাখে, তা একঝলকে দেখে নিন…
কাছে ঘেঁষবে না ক্যানসার
ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে। আর একবার এই রোগের ফাঁদে পড়লে কিন্তু জীবনে কষ্টের শেষ থাকবে না। তাই যেন তেন প্রকারেণ এই রোগের থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে নিতে হবে। আর এই কাজে আপনার হাতের পাঁচ হতে পারে লিচু। কারণ এই ফলে রয়েছে কার্যকরী কিছু অ্যান্টিক্যানসারাস উপাদান। আর এসব উপাদান কিন্তু ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি আটকে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তাই তো বিশেষজ্ঞরা নিয়মিত এই ফল খেয়ে রসনাবিলাস করার পরামর্শ দেন।
বাড়বে ইমিউনিটি
মানুষের শরীরের আশপাশে বসবাস করে একাধিক ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস। আর এসব জীবাণু কিন্তু একটু জায়গা পেলেই শরীরের উপর আক্রমণ শানাতে পারে। তাই বিপদের ফাঁদ এড়িয়ে চলতে চাইলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেই হবে। আর সেই কাজে আপনাকে সাহায্য করবে লিচু। কারণ এই ফলে রয়েছে ভিটামিন সি-এর ভাণ্ডার। নির্দিষ্ট করে বললে, ১০০ গ্রাম লিচু থেকে প্রায় ৭১.৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি পাওয়া যায়। আর এতটা ভিটামিন সি কিন্তু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর কাজে সিদ্ধহস্ত। তাই তো বিশেষজ্ঞরা নিয়মিত লিচু খাওয়ার পরামর্শ দেন।
ওজন কমাতে সাহায্য করে
যারা ওজন কমাতে চান তাদের জন্য কার্যকরী একটি খাবার হতে পারে লিচু। এতে ক্যালোরি থাকে খুব কম। যে কারণে ওজন বাড়ার ভয় থাকে না। আঁশযুক্ত হওয়ার কারণে লিচু খেলে তা দীর্ঘ সময় পেট ভরিয়ে রাখে। নিয়মিত লিচু খেলে হজমশক্তি উন্নত হয়। বেশি পরিমাণে চিনি এবং কার্বোহাইড্রেট থাকা সত্ত্বেও, নিয়মিত লিচু খাওয়া ক্লান্তি এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। ওয়ার্কআউটের পরে এবং পেটের জেদি চর্বিও কমাতে পারে।
কিডনির জন্য উপকারী
কিডনি ভালো রাখতে খাবারের দিকে নজর রাখা জরুরি। লিচুতে পর্যাপ্ত পানি এবং পটাসিয়াম থাকার কারণে তা কিডনিতে জমে থাকা দূষিত পদার্থ বের করে দিতে সাহায্য করে। এই ফল ইউরিক অ্যাসিডের ঘনত্বও কমায়। যে কারণে কমে কিডনির ক্ষতির ঝুঁকি।
লিভার থাকবে সুস্থ-সবল
শরীর থেকে টক্সিন বের করে দেওয়া, হজমে সাহায্য করা সহ একাধিক জরুরি কাজ একা হাতে সামলায় লিভার। কিন্তু আমাদের আধুনিক জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসের অভিশাপের দরুন ভুগছে যকৃত। এই অঙ্গে বাসা বাঁধছে কিছু গুরুতর অসুখ। তাই বিপদ ঘটার আগেই আপনাকে লিভারের হাল ফেরাতে হবে। আর এই কাজে সাফল্য পেতে চাইলে সবার প্রথমে ফাস্টফুড এবং মদের থেকে দূরত্ব বাড়ান। তার বদলে নিয়মিত সেবন করুন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ লিচু। আশা করছি, তাতেই উপকার মিলবে হাতেনাতে।
ত্বক থাকবে সুস্থ-সবল
গরমে ত্বকের হাল বেহাল হতে সময় লাগে না। তাই এই সময় স্কিন কেয়ারে একটু বেশি মনোযোগ দিতে হবে। আর এই কাজে সাফল্য পেতে চাইলে আজই হাত ধরুন লিচুর। কারণ এই ফলে রয়েছে ভিটামিন সি-এর ভাণ্ডার। আর এই ভিটামিন কিন্তু সূর্যের প্রখর রোদ থেকে ত্বককে বাঁচায়। এমনকী এই ভিটামিনের গুণে ত্বকের ক্ষতও দ্রুত সেরে যায়। তাই আর সময় নষ্ট না করে আজ থেকেই লিচু খাওয়া শুরু করে দিন। আশা করছি, তাতেই উপকার পাবেন হাতেনাতে।
গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ রাখে
লিচুতে রয়েছে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৫০, যার ফলে ধীরে ধীরে রক্তের মধ্যে সুগার প্রবেশ করে। আর গ্লাইসেমিক লোডের পরিমাণ ৭.৬, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য নিরাপদ। যাদের শরীরে রক্তের মধ্যে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত হয়ে গেছে, তারা প্রতিষেধক হিসেবে লিচু গ্রহণ করতে পারেন। লিচুর মধ্যে থাকা ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আমাদের শরীরের রক্তের মধ্যে গ্লুকোজের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে।
হার্ট ভালো রাখে
হার্ট ভালো রাখার পক্ষে সহায়ক একটি ফল হলো লিচু। এতে থাকে অলিগোনল, যা নাইট্রিক অক্সাইড তৈরি করতে সাহায্য করে। আমাদের শরীরে রক্ত চলাচলে সাহায্য করে এই নাইট্রিক অক্সাইড। এতে থাকা ফ্ল্যাভোনয়েড ভাসকুলার ফাংশন উন্নত করে। ফলে হৃদরোগ প্রতিরোধ করা সহজ হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত লিচু খেলে হার্টের অসুখের ঝুঁকি কমে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে
যাদের শরীরে রক্ত নালীতে রক্তচাপ বেড়ে যায় বা প্রেশার বারবার উঠানামা করে, তারা খাবারের তালিকায় নিয়মিত লিচু রাখার চেষ্টা করবেন। কারণ লিচুর রসের মধ্যে থাকা পটাশিয়াম আমাদের শরীরের রক্ত পরিষ্কার করতে কাজ করে। ফলে রক্তচাপ কমিয়ে আপনার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে।
চোখের ছানি পড়া দূর করে
লিচু আপনার চোখ জোড়াও যত্ন নিবে। এটি খেলে চোখের ছানি পড়ার সমস্যা থেকেও মুক্তি পাবেন। লিচুতে রয়েছে বিশেষ ফাইটোকেমিক্যাল।যা অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট ও চোখের সুরক্ষার জন্য দরকারী। যা চোখে ছানি পড়াও আটকাতে সাহায্য করে।
বছর জুড়ে সংরক্ষণের উপায়
কয়দিন পরেই লিচুর মৌসুম শেষ হয়ে যাবে। তখন লিচু কীভাবে খাবেন? এজন্য আগে থেকেই লিচু কিনে তা সংরক্ষণ করে রাখুন। যাতে দীর্ঘদিন ধরে লিচু খেতে পারবেন।
অনেকেই ভাবেন, লিচু সংরক্ষণ করে রাখলে কি আর তাজা লিচুর মতো স্বাদ থাকবে? অবশ্যই থাকবে। ভালো বাবে সংরক্ষণ করলে তাজা লিচুর মতো স্বাদ পাবেন। জেনে নিন তাজা লিচু চিনবেন কীভাবে এবং লিচু যেভাবে রাখলে বেশিদিন তাজা থাকবে-
লিচু ধরে যদি দেখেন খুব বেশি শক্ত লাগছে, তা হলে বুঝবেন সেই লিচু কাঁচা। কাঁচা লিচু খেলে কিন্তু পেটে ব্যথা হতে পারে।
লিচুর গায়ে যদি ভেজা ভাব দেখতে পান, তা হলে বুঝবেন লিচুতে পচন ধরতে শুরু করেছে।
লিচুর বোঁটা যদি ফলের সঙ্গে শক্ত ভাবে লেগে থাকে, তা হলে বুঝবেন সেই লিচু যথেষ্ট তাজা।
লিচুর গায়ে যদি কালো ছোপ দেখেন, তা হলে সেই ফল মোটেই কিনবেন না। সাধারণত ফলনের সময়ে রাসায়নিক ব্যবহার করলে এমনটা হয়।
অনেকেই বাজার থেকে লিচু কিনে এনে বাইরের ঘরে তাপমাত্রায় রেখে দেন। এতে কিন্তু লিচু তাড়াতাড়ি পচে যেতে পারে। ফ্রিজে রাখলে লিচু চার থেকে পাঁচ দিন ভাল থাকে আর বাইরে রাখলে দুই থেকে তিন দিন। লিচু বোঁটাগুলো কেটে নিন। এ বার একটি এয়ারটাইট বাক্সে টিস্যু পেপার রেখে তার মধ্যে লিচু ভরে ফ্রিজে রাখুন। দেখবেন অনেক দিন তাজা থাকবে!
নরমাল ফ্রিজে আপনি লিচু সংরক্ষণ করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে ১৫-১০ দিন সংরক্ষণ করতে পারবেন। এজন্য তাজা লাল টুকটুকে লিচু বেছে নিন। সেগুলোকে ডাল পাতাসহ খবরের কাগজে মুড়িয়ে নিন। ফ্রিজের নরমালে রেখে দিন এবার। প্রতিবার লিচু বের করে খাওয়ার পর আবার সুন্দর করে কাগজে জড়িয়ে তবেই রেখে দিন। তাহলে ভালো থাকবে লিচু।
কাপড়ের শপিং ব্যাগ বাদে আপনি খবরের কাগজে মুড়িয়ে অতঃপর একটি প্লাস্টিকের বক্সেও সংরক্ষণ করতে পারেন পাকা লিচু।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।