ফারহানা রিক্তা : চলতি বছর পদার্থবিজ্ঞানে অবদান রাখার জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী জন জে হপফিল্ড ও কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী জিওফ্রে ই হিন্টন। ‘কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মেশিন লার্নিংয়ের ভিত্তি স্থাপনে মৌলিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের’ জন্য গত ৮ অক্টোবর তাদেরকে মনোনীত করে নোবেল কমিটি।
এ দুই বিজ্ঞানীর নাম ঘোষণার পর থেকেই এ নিয়ে আগ্রহী মহলে শুরু হয় নানা আলোচনা সমালোচনা। অবশ্য এ সিদ্ধান্তটি বেশ অপ্রত্যাশিতই ছিলো বটে। কারণ হপফিল্ড ও হিনটনের কাজ সরাসরি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে নয়। তাদের কাজ মূলত কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে মেশিন লার্নিং, এলএলএম এবং এআই নিয়ে। তবে এই দুই বিজ্ঞানী পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন টুল ব্যবহার করেই এমন পদ্ধতি তৈরি করেছেন যা আজকের শক্তিশালী মেশিন লার্নিংয়ের ভিত গড়ে দিয়েছে। চলেন দেখা যাক, কীভাবে পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারণা ও পদ্ধতি এইসব গবেষণায় ব্যবহৃত হয়েছে।
দুই বিজ্ঞানীর একাডেমিক ও কর্মজীবন
জন হপফিল্ড একজন মার্কিন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ এবং জীববিজ্ঞানী তিনি নিউরাল নেটওয়ার্ক এবং থিওরিটিক্যাল নিউরোসায়েন্সের জন্য পরিচিত। ১৯৫৮ সালে তিনি কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি (ক্যালটেক)-সহ বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। কর্মজীবনে হপফিল্ড তার অবদানের অনেক পুরস্কার পেয়েছেন, যার মধ্যে ২০০১ সালে ডিরাক মেডেল অন্যতম।
আর জিওফ্রি হিন্টন একজন ব্রিটিশ-কানাডিয়ান কগনিটিভ সাইকোলজিস্ট এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানী, যাকে ‘ডিপ লার্নিং’-এর অন্যতম পথিকৃৎ বলা হয়। হিন্টন ১৯৭৮ সালে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় এবং গুগলে শীর্ষস্থানীয় একাডেমিক অবস্থানে কাজ করেছেন। এআইয়ের জগতে সেসকল গ্রাউন্ড ব্রেকিং কাজের জন্য ২০১৮ সালে, ইয়ান লেকুন এবং ইয়োশুয়া বেনজিওর সঙ্গে তিনি টুরিং অ্যাওয়ার্ড পান।
কীভাবে ব্যবহার করেন পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন থিওরি ও টুলস
১৯৮০-এর দশকের শুরুতে, জন হপফিল্ড কম্পিউটার সায়েন্সে একটি বিপ্লবের সূচনা করেন। তার লক্ষ্য ছিল কম্পিউটারকে মানুষের মতো করে তথ্য প্রক্রিকরন ‘শেখানো’। সেই সময়ে, এটি ছিল একেবারে নতুন এবং অপ্রচলিত একটি ধারণা। কম্পিউটার তখনও খুব দ্রুত গাণিতিক কাজ করতে পারত, কিন্তু মানুষের ব্রেইনের মতো বিভিন্ন তথ্য গ্রহন করে সেখান থেকে বিশ্লেষণ করে নতুন কিছু শেখা এবং কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহনের এর সামর্থ্য কম্পিউটারের ছিল না। হপফিল্ডের গবেষণা সেই ধারণাকেই বাস্তবায়িত করেছে।আমরা সবাই জানি যে কম্পিউটার খুব দ্রুত হিসাব করতে পারে। কিন্তু আজকাল কম্পিউটার আরও অনেক কিছু করছে- ছবি চিনছে, ভাষা বুঝছে, এমনকি গান লিখছে! এই সব কীভাবে সম্ভব হচ্ছে? এর পিছনে রয়েছে এই ‘মেশিন লার্নিং’ নামক প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তিরই জন্ম দিয়েছেন জন হপফিল্ড।১৯৮২ সালে, জন হপফিল্ড একটি আবিষ্কার করেন যা পরবর্তীতে আর্টিফিশিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্কের ভিত্তি স্থাপন করে।আমরা যখন কিছু শিখি, তখন আমাদের মস্তিষ্কের নিউরন নামক কোষগুলোোর মধ্যে নতুন নতুন সংযোগ তৈরি হয়। হপফিল্ড এই ধারণাকেই কম্পিউটারে প্রয়োগ করেছেন।তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে মস্তিষ্কের নিউরনগুলো অনেকটা চুম্বকের মতো আচরণ করে, অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট উপায়ে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হয় এবং তথ্য আদান-প্রদান করে। এই ধারণা থেকেই তিনি তৈরি করেন ‘হপফিল্ড নেটওয়ার্ক’। এটি এমন একটি সিস্টেম যেখানে কম্পিউটারের মধ্যে থাকা ‘কৃত্রিম নিউরনগুলো’ পরস্পরের সাথে সংযোগ স্থাপন করে এবং সংগ্রহ করা তথ্য থেকে আমাদের মস্তিষ্কের মতো করেই বিভিন্ন জিনিস শিখতে পারে।
এই মডেলটি পদার্থবিজ্ঞানের ‘স্পিন গ্লাস মডেল’ কে অনুসরণ করে বানানো। স্পিন গ্লাস হল এমন একটি ম্যাগনেটিক সিস্টেম যেখানে অ্যাটমগুলির স্পিন এলোমেলোভাবে সাজানো থাকে এবং নিজেদের স্পিনের পরিবর্তন করতে পারে হপফিল্ড নেটওয়ার্কেও,কৃত্রিম নিউরনগুলি পরস্পরের সাথে সংযুক্ত থাকে এবং তাদের অবস্থা পরিবর্তন করতে পারে, ঠিক যেমন স্পিন গ্লাসে অ্যাটমগুলির স্পিন পরিবর্তন হয়।এই আচরণকে অনুসরণ করেই হপফিল্ড দেখিয়েছিলেন, কীভাবে কৃত্রিম নিউরনের নেটওয়ার্ক তৈরি করা যায় যা তথ্য সংরক্ষণ ও প্রয়োজনে পুনরুদ্ধার করতে পারে। এটি আর্টিফিশিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্কের প্রথম সফল প্রয়োগ।’হপফিল্ড মডেল’ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং কম্পিউটেশনাল নিউরোসায়েন্সের বিকাশে একটি মাইলফলক ছিল।
প্রায় কাছাকাছি সময়ে, জেফ্রি হিনটন মেশিন লার্নিংয়ে ‘এনার্জি ল্যান্ডস্কেপ’ তত্ত্বের প্রয়োগ নিয়ে কাজ করছিলেন। এই তত্ত্বটি পদার্থবিজ্ঞানের একটি ধারণার উপর ভিত্তি করে, যেখানে বলা হয় যে কোনো সিস্টেম সবসময় তার সবচেয়ে কম এনার্জির অবস্থায় থাকতে চায়। হিনটন দেখালেন যে, কম্পিউটার সিস্টেমও এনার্জি কমিয়ে এনে তথ্য শেখার প্রক্রিয়ায় উন্নতি করতে পারে। একটু জটিল লাগছে ব্যাপারটা,তাই না?চলুন কিছুটা সহজ করে বোঝা যাক।কল্পনা করুন একটা বল পাহাড়ের চূড়া থেকে গড়িয়ে পড়ছে। বলটি সবসময় নিচের দিকে যাবে, তাই না? হিনটন এই ধারণা ব্যবহার করে কম্পিউটারকে শেখালেন কীভাবে ‘সঠিক’ উত্তরের দিকে যেতে হয়। কম্পিউটার বারবার চেষ্টা করে ‘নিচের’ দিকে যায়, যেখানে সবচেয়ে কম ‘ভুল’ থাকে। এই পদ্ধতিটি পদার্থবিজ্ঞানের ‘এনার্জি ল্যান্ডস্কেপ থিওরি’র উপর ভিত্তি করেই তৈরি। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৫ সালে, তিনি ‘ব্যাক-প্রপাগেশন’ নামে একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করলেন। এই পদ্ধতি কম্পিউটারের নিউরাল নেটওয়ার্ককে তার ভুলগুলো ঠিক করতে সাহায্য করে, এবং প্রতিটি ভুল থেকে শিখে আরও সঠিকভাবে তথ্য বিশ্লেষণ করতে শেখায়।
হিনটন তার গবেষণায় স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেকানিক্সের ধারণাও ব্যবহার করেছেন। স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেকানিক্স হল পদার্থবিজ্ঞানের একটি শাখা যা বড় সংখ্যক কণার আচরণ বিশ্লেষণ করে। হিনটন এই শাখার ব্যবহার করে ‘বোল্টজম্যান মেশিন’ নামে একটি স্টোকাস্টিক নিউরাল নেটওয়ার্ক তৈরি করেন।
বোল্টজম্যান মেশিনে থার্মোডাইনামিক্সের ধারণাও ব্যবহৃত হয়েছে।হিনটনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ছিল ‘সিমুলেটেড অ্যানিলিং’ পদ্ধতি, যা থার্মোডাইনামিক্সের একটি ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি। যখন ধাতব পদার্থকে আস্তে আস্তে ঠান্ডা করা হয়, তখন তার অণুগুলো একটি স্থিতিশীল অবস্থানে চলে আসে এবং একটি সুন্দর, সুষম কাঠামো তৈরি করে।বোল্টজম্যান মেশিনে নেটওয়ার্কের প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়াকে একটি থার্মোডাইনামিক্স সিস্টেমের সাথে তুলনা করা যায়। সিমুলেটেড অ্যানিলিং পদ্ধতিতে, নেটওয়ার্কের ‘তাপমাত্রা’ ধীরে ধীরে কমানো হয়, যা একটি ধাতব পদার্থকে ধীরে ধীরে ঠান্ডা করার প্রক্রিয়ার মতোই। হিনটন থার্মোডাইনামিক্সের এই ধারণাটি কম্পিউটারে প্রয়োগ করেন এবং দেখান যে কম্পিউটারকে আস্তে আস্তে শেখানো সম্ভব, যাতে তথ্যের সঠিক বিশ্লেষণ করা যায়। ১৯৮৬ সালে হিনটন বোল্টজম্যান মেশিনের উপর একটি পেপার লিখেছিলেন, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় গভীর প্রভাব ফেলে।
১৯৯০-এর দশকে হিনটন বোল্টজম্যান মেশিনে ‘স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেকানিক্সের’ অধিকতর প্রয়োগের মাধ্যমে এই নিউরাল নেটওয়ার্ককে আরও উন্নত করেন। স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেকানিক্স পদার্থের আচরণ সম্পর্কে যে ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী করে, তা ব্যবহার করে হিনটন দেখান কীভাবে নিউরাল নেটওয়ার্কগুলো বড় পরিমাণ তথ্য থেকে প্যাটার্ন খুঁজে বের করতে পারে। সহজ করে বললে আপনি যদি একটি ঘরে অনেক মানুষকে হাঁটতে দেখেন, তাদের প্রত্যেকের গতিপথ আলাদা হলেও সামগ্রিকভাবে একটি প্যাটার্ন থাকে। হিনটন এই ধারণা ব্যবহার করে কম্পিউটারকে বড় পরিমাণ তথ্য থেকে প্যাটার্ন খুঁজে বের করতে শেখালেন। ২০০০ সালের পর থেকে, কম্পিউটারের প্রক্রিয়াকরন ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে, হপফিল্ড এবং হিনটনের আবিষ্কারগুলোর কার্যকারিতা আরও বৃদ্ধি পায়। তাদের তৈরি করা নিউরাল নেটওয়ার্ক এবং মেশিন লার্নিং মডেলগুলো এখন আরও শক্তিশালী এবং দ্রুতগতিতে কাজ করতে সক্ষম।যার ফলাফল হিসেবে আমরা দেখতে পাচ্ছি কীভাবে এই প্রযুক্তি এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রবেশ করছে। স্মার্টফোনে ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট, সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি চেনার সিস্টেম, ইমেইলে স্প্যাম ফিল্টার থেকে শুরু করে হালের চ্যাট জিপিটি – এসব কিছুর পিছনেই রয়েছে হপফিল্ড এবং হিনটনের সেই প্রাথমিক গবেষণা।
তাই বলা যায় যে, হপফিল্ড ও হিলটন নিসন্দেহে যোগ্য নোবেল লরিয়েট। কিন্তু এক্ষেত্রে পিওর ন্যাচারাল সায়েন্সের তাত্ত্বিক গবেষক অনুসারীদের অসন্তোষও অযৌক্তিক না আসলে সায়েন্টিফিক রেভ্যুলেশন হিসেবে কোন বিষয় গুলো কখন ফ্রন্টলাইনে আসবে, কোন বিষয় গুলো ফান্ড পাবে এগুলোর ওপর যে নানানভাবে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব বিস্তার করে ব্যাপারটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
দুর্গাপূজা দেখতে গিয়ে নিখোঁজ, ৯ ঘণ্টা পর নদী থেকে মরদেহ উদ্ধার
তবে এবারের এই বিতর্ক নোবেল পুরষ্কারের গত শতকের পুরনো কাঠামোকে আবারও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করল। আমরা হয়তো ভবিষ্যতে ইকোনমিকসের ‘The Sveriges Riksbank Prize in Economic Sciences in Memory of Alfred Nobel’- এর মতো ইনফরমেশন সায়েন্সের নতুন কোনো পুরষ্কারের শাখা তৈরি হতে দেখবো। দেখা যাক, কি হতে চলেছে অদূর ভবিষ্যতে…।
লেখক: পদার্থবিজ্ঞানের স্নাতক। বিজ্ঞান,মনস্তত্ত্ব ও দর্শন নিয়ে পড়াশোনা ও লেখালেখি করেন। জটিল বিষয়গুলো সহজভাবে উপস্থাপন করতে পছন্দ করেন; বিশেষত বিজ্ঞান ও মনস্তত্ত্বের অন্তর্নিহিত দিক উঠে আসে তার লেখায়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।