হাসান জাকির : দেশের মোট জনগোষ্ঠীর বড় অংশ এখনও রয়েছে কম্পিউটার ডিভাইসের আওতার বাইরে। ২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে, বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর হাতে কম্পিউটার থাকা জরুরি। কিন্তু দামের কারণে সবার জন্য কম্পিউটার কেনা সত্যিই কষ্টসাধ্য। এ অবস্থা সমাধান দিতে দুই তরুণের স্বপ্নের প্রকল্প ‘জাদুপিসি’।
জাদুপিসি হচ্ছে সাশ্রয়ী দামের ডেস্কটপ কম্পিউটার। লিনাক্সনির্ভর কাস্টমাইজড অপারেটিং সিস্টেম ‘স্বপ্ন ওএস’ চালিত এ পিসি শিশু শিক্ষার্থীসহ কম্পিউটার কেনার যাদের সামর্থ্য নেই, তাদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে। প্রচলিত কম্পিউটারে যা যা করা যায়, এ পিসিতেও তার সবাই করা সম্ভব। এর মধ্যে ওয়েব ব্রাউজিং, পেইন্টিং, ওয়ার্ড ফাইলে লেখালেখি থেকে শুরু করে প্রোগ্রামিং কিংবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবটিকসনির্ভর কাজ অনায়াসে করা যাবে ডিভাইসটিতে।
জাদুপিসি বৃত্তান্ত
জাদুপিসি মিনি ও জাদুপিসি ডেস্কটপ সংস্করণে এখন মিলবে কম্পিউটারটি। জাদুর বাক্স নামে জাদুপিসিতে আইওটি এবং রোবটিকস শেখার জন্য রয়েছে বিশেষ প্যাকেজ। এআরএমভিত্তিক সিঙ্গেল বোর্ড এ কম্পিউটারে রয়েছে কোয়াড কোর প্রসেসর। ১.৮ গিগাহার্টজ গতির কোর্টেক্স এ৫৩ প্রসেসর চালিত কম্পিউটারটিতে রয়েছে তিনটি ইউএসবি পোর্ট, একটি এইচডিএমআই পোর্ট, একটি মাইক্রো এসডি স্লট এবং একটি ল্যান পোর্ট। পিসিটে ১৯ ইঞ্চি টিএফটি এলইডি মনিটরের সঙ্গে যুক্ত হয়, যার রেজ্যুলেশন ১৩৬৬ বাই ৭৮৬ পিক্সেল। লিনাক্সনির্ভর স্বপ্ন ওএস চালিত পিসিটিতে রয়েছে প্রিইনস্টল শিক্ষামূলক সফটওয়্যার। ডিভাইসটিতে পাবেন ৪ জিবি ডিডিআরথ্রি র্যাম, ৩২/৬৪ জিবি স্টোরেজ, যা এক টেরাবাইট পর্যন্ত বাড়ানো যায়। এটি কিবোর্ড, মাউস, সাউন্ড কার্ড, হেডফোন সমর্থন করে। ওয়াই-ফাই সমর্থিত সাশ্রয়ী দামের এ কম্পিউটারটি অল-ইন-ওয়ান সংস্করণ আনার ঘোষণা দিয়েছেন নির্মাতারা। মূল জাদুপিসির দাম ৫ হাজার টাকা। মনিটর, মাউস, কিবোর্ড তথা পূর্ণাঙ্গ সেটআপসহ ডিভাইসটি কিনতে খরচ পড়বে মাত্র ১২ হাজার থেকে ১৩ হাজার টাকা।
ব্যর্থ হতে হতে সাফল্যের খোঁজ
২০১৪ সালে জাদুপিসির যাত্রা শুরু হয়। স্কুল-সংক্রান্ত প্রকল্পের কাজে স্পেকট্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কনসোর্টিয়ামের পরিচালক খন্দকার আসিফ হাসানের সঙ্গে দেখা করেন জাদুপিসির প্রতিষ্ঠাতা মাসরুর হান্নান। তিনি দেখেন ‘অ্যান্ড্রয়েড ডঙ্গল’ ডিভাইসে স্কুল ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যার পিএইচপিতে বানিয়ে ইনস্টলের চেষ্টা করছেন আসিফ হাসান। তবে অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইস হওয়ায় পিএইচপি ইনস্টলে ঝামেলা হচ্ছিল। মাসরুর বলেন, যন্ত্রটি আমি আসিফ ভাইয়ের কাছ থেকে বাসায় এনে টিভিতে যুক্ত করে বুঝতে পারি, এটি দিয়ে কম্পিউটার বানানো সম্ভব। তখনই আমার মাথায় গেড়ে বসে জাদুপিসি। তবে ডিভাইসটি দিয়ে কম্পিউটার বানানোর কাজ মোটেও সহজ ছিল না। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করি, আশাভঙ্গ হয় আমার। আমি এটা বাদ দিই। এর পর আমি পড়াশোনার জন্য যুক্তরাজ্যে যাই। এবার যুক্তরাজ্যে গিয়ে আমি ফের জাদুপিসি নিয়ে চেষ্টা করি, কিন্তু কিছুই হয় না। মায়ের অসুস্থতাজনিত কারণে ২০১৮ সালে দেশে ফিরি।
দেশে ফিরে জাদুপিসি নিয়ে আবার আমার উন্মাদনা শুরু হয়। জাদুপিসির জন্য অ্যান্ড্রয়েডের মতো একটি অপারেটিং সিস্টেম দাঁড় করানোর চেষ্টা করি। দুই বছর চেষ্টা করে ফের ব্যর্থতা। কিন্তু ২০২২ সালে জাদুপিসির মোড় ঘুরে যায়। বাংলাদেশে বসে মাসরুর হান্নান যখন বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন, তখন দক্ষিণ আফ্রিকায় বসে একই কাজ সফলতার সঙ্গেই করছেন আরেক বাংলাদেশি রাগীব এহসান। তরুণ এ উদ্ভাবক আফ্রিকার পিছিয়ে পড়া শিশুদের প্রযুক্তি সুবিধা পৌঁছে দিতে কাজ করছেন। তিনি লিনাক্সনির্ভর ‘স্বপ্নওএস’ নামে চমৎকার একটি অপারেটিং সিস্টেম দাঁড় করিয়েছেন। খোঁজ পাওয়ার পর মাসরুর হান্নান তাঁদের ডিভাইসটি রাগীবকে পাঠান। আমন্ত্রণ জানান জাদুপিসির টিমে যোগ দিতে। মাসরুর বলেন, রাগীবের স্বপ্ন আমাদের স্বপ্নের সঙ্গে যুক্ত হয়।
রাগীবের যোগ দেওয়ার আগে অ্যান্ড্রয়েডকে ঠিকমতো কাস্টমাইজ না করতে পারায় ৫০০ ইউনিট জাদুপিসি ধ্বংস করতে বাধ্য হন মাসরুর। তবে রাগীব যুক্ত হওয়ার পর ঘুরে দাঁড়ায় জাদুপিসি। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান নাভিদ মাহবুব ও মাসরুর হান্নানের অর্থায়নে ভালোভাবে এগিয়ে চলছে জাদুপিসি। এ ছাড়া সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা রাগীব এহসানের স্বপ্ন তো আছেই, সঙ্গে প্রধান পণ্য কর্মকর্তা তাহমিদ আবির। আগামী মাসেই ডেভেলপারদের জন্য ১ হাজার জাদুপিসি বাজারে আনতে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। একই সঙ্গে একটি পরীক্ষামূলক স্ক্র্যাচ প্রোগ্রামিং, রোবটিকস নিয়ে ৫০টিরও বেশি স্কুলে কাজ করার কথা জানান তিনি। জাদুপিসির সঙ্গে রয়েছে একটা করে জাদুর বাক্স রোবটিকস কিট, যার মাধ্যমে শিশুরা রোবটিকসও শিখতে পারবে।
লক্ষ্য স্মার্ট বাংলাদেশ
চলতি বছর কোম্পানিটি ১০ হাজার ইউনিট জাদুপিসি বিক্রি করতে চায়। ২০২৬ সালের মধ্যে এক কোটি মানুষের হাতে জাদুপিসি পৌঁছে দিতে চায় তারা। মাসরুর হান্নান বলেন, দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনও কম্পিউটার সুবিধার বাইরে। অথচ ২০৪১ সালে যে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে নতুন প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের হাতে কম্পিউটার তুলে দেওয়ার বিকল্প নেই। আমাদের চাওয়া, প্রত্যেকটি শিশু স্কুলে যাক, তাদের হাতে বইয়ের পাশাপাশি থাকুক কম্পিউটার ডিভাইস। আর সেই কম্পিউটার ডিভাইস হোক জাদুপিসি। জাদুপিসির স্ক্রিনে তারা বিশ্বকে আবিষ্কার করুক। স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট প্রজন্ম দেশকে তুলে ধরুক নতুন উচ্চতায়। সূত্র : সমকাল
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।