জাফর ইকবাল : সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাধিক নামে আইডি। মাহদীয়া জান্নাত নীরা, নীরা জান্নাত কিংবা জান্নাত নীলা। এসব আইডি দিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্নজনকে টার্গেট করতেন। বিছাতেন প্রেমের জাল। ফাঁদে ফেলতে নিজেকে এতিম-অসহায় দাবি করে শুরু করতেন বন্ধুত্ব। এরপর ধীরে ধীরে প্রেম। সম্পর্ক গভীর হলে বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে যেতেন। গোপনে সংগ্রহ করে রাখতেন সব কাগজপত্র। তারপর সুযোগ বুঝে সেই প্রমাণাদি দিয়ে শুরু করতেন ব্ল্যাকমেইল। দাবি করতেন মোটা অঙ্কের টাকা। আবার কারও কারও সঙ্গে প্রেমের সে সম্পর্ক গড়িয়েছেন বিয়ে পর্যন্ত। পরে সাংসারিক ঝামেলার অজুহাতে চাইতেন ডিভোর্স। এভাবে দেনমোহরের নামে হাতিয়ে নিতেন লাখ লাখ টাকা। এ ধরনের অন্তত চারটি ঘটনার তথ্যপ্রমাণ এসেছে এই প্রতিবেদকের হাতে। এমন উচ্ছৃঙ্খল স্বভাবের কারণে তাকে ত্যাজ্য করেছেন বাবা। এমনই এক ভয়ংকর প্রতারকের নাম মাহদীয়া জান্নাত মাহী ওরফে মানছুরা শুকরা। বিয়ে কিংবা প্রেমের সম্পর্ক করে অর্থ হাতানোই যার একমাত্র পেশা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ থানার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের খাড়িয়ালা গ্রামের মো. সিদ্দিকুর রহমানের মেয়ে এ মানছুরা শুকরা। নিজেকে পরিচয় দেন রাজধানীর উত্তর বাড্ডার মাদ্রাসা শিক্ষিকা হিসেবে। এরই মধ্যে একাধিক বিয়ে করেছেন। তবে তার উচ্ছৃঙ্খল চলাফেরার কারণে কোনো সংসারই টেকেনি। বিয়ের পরপরই স্বামীকে তালাক দিয়ে দেনমোহরের টাকাসহ নানা কৌশলে অর্থ হাতিয়ে নেওয়াই তার পেশা। কেউ স্বেচ্ছায় না দিতে চাইলে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন। মামলা দিয়ে করেন হয়রানি। এমনকি স্ত্রীর স্বীকৃতির দাবিতে অনশন এরপর মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে মীমাংসা। এসব নজিরও আছে এই তরুণীর বিরুদ্ধে।
মাহীর প্রথম বিয়ে হয় ২০১১/১২ সালের দিকে। তখন অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন বলে দাবি তার। মা ফরিদা বেগমের দ্বিতীয় স্বামীর প্রথম স্ত্রীর ছেলে জুম্মানের অর্থাৎ সৎভাইয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। কিছুদিন পরই স্বামীকে ছেড়ে দেন মাহী। কিন্তু নানা কৌশলে দেনমোহরসহ হাতিয়ে নেন ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ ঘটনার পর মেয়ের নানা অসামাজিক কার্যকলাপে অতিষ্ঠ হয়ে বাবা ত্যাজ্য ঘোষণা করেন।
এতে তার প্রতারণা ব্যবসার দ্বার খুলে যায়। নিজেকে অসহায় দাবি করে মাহী আশ্রয় নেন রাজধানীর বাড্ডায়। সেখানে কয়েক বছর থাকার পর ২০২০ সালে মার্চ মাসের দিকে দোকান কর্মচারী সাজেদুল ইসলামকে ফাঁসিয়ে গড়ে তোলেন গভীর প্রেমের সম্পর্ক। নিজেকে অবিবাহিত দাবি করে তাকে বিয়েও করেন। কিন্তু ৩ মাসের মাথায় ফের ছাড়াছাড়ি। তবে এবারও খালি হাতে ফেরেননি। মাহীর হাতে আসে আড়াই লাখ টাকা। ২০২২ সালে উত্তর বাড্ডার মো. আজাদ মিয়ার ছেলে মো. রাহাত মিয়ার সঙ্গে প্রথমে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। সেখান থেকে প্রেম। শেষ পর্যন্ত যা গড়ায় শারীরিক সম্পর্কে। এরপর বিভিন্নভাবে রাহাত মিয়াকে ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করেন। ওই বছর ১৫ জুলাই উত্তর বাড্ডা থানায় ওই যুবকের নামে নামে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলাও করেন। বছর না যেতেই ২০২৩ সালে জুলাই মাসে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে কোর্টের মাধ্যমে আপস করে উঠিয়ে নেন মামলা। রাহাত মিয়ার আইনজীবী পলাশ হোসেন টাকার মাধ্যমে মিটমাটের বিষয়টি স্বীকার করলেও টাকার পরিমাণ সম্পর্কে বলতে চাননি।
গত বছর এপ্রিল মাসে মাহীর চতুর্থ শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. আশিকুর রহমান। কিশোরগঞ্জ জেলার আকবর আলীর ছেলে তিনি। তার নামেও মাহী করেন ধর্ষণ মামলা। বর্তমানে সেটি তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। ব্ল্যাকমেইল ও নানা হয়রানি মাধ্যমে ওই ঢাবি শিক্ষার্থীর কাছ থেকেও হাতিয়ে নেন সাড়ে ৫ লাখ টাকা। তবে এখনো মামলা তুলে নেননি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই ঢাকা মেট্রো দক্ষিণের পরিদর্শক মো. রওশন আলী বলেন, তদন্ত প্রায় শেষের দিকে। শিগগিরই আদালতে প্রতিবেদন দেব। তবে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এদিকে ত্যাজ্য করা অঙ্গীকারনামায় বাবা সিদ্দিকুর রহমান উল্লেখ করেছেন, আমার কন্যা মানছুরা চরম উচ্ছৃঙ্খল ও তার নৈতিক চরিত্রের অধঃপতন ঘটিয়ে বেপরোয়া চলাফেরা করে। তার অসামাজিক চলাফেরার কারণে আপন ভাই, গোষ্ঠীর লোকজন আমার সঙ্গে চলাফেরা বন্ধ করে দিয়েছে। আমি তার কারণে সমাজে মুখ দেখাতে পারছি না। সে আমার মানসম্মান ধুলায় মিশিয়ে দিছে। আমি তাকে শত উপদেশ দিয়েও সংশোধন করতে পারিনি। আরেকটি অঙ্গীকারনামায় তিনি দাবি করেন, মাহদীয়া জান্নাত মাহী আমার ঔরসজাত সন্তান। তার স্বভাব চরিত্র ভালো না। আমার সঙ্গে থাকা অবস্থায় সে বাড়ি থেকে প্রায়ই কোথায় যেন চলে যেত। দুই-চার দিন আসত। জিজ্ঞাস করলে নিশ্চুপ থাকত। সে প্রায়ই উঠতি বয়সী ছেলেদের সঙ্গে চলাফেরা করে। সে অনেক ছেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক করে ব্ল্যাকমেইল করে টাকাপয়সা নিছে। ২০২২ সালে মো. রাহাত মিয়া নামে এক ছেলের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা করে মোটা অঙ্গের টাকার বিনিময়ে মীমাংসা করেছে। সে আরও অনেক ছেলেকে এ ধরনের মামলায় ফাঁসাতে পারে বলে আমার ধারণা।
এ বিষয়ে মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, অনেক আদরের মেয়ে মানছুরা শুকরা। অথচ আমার দেওয়া নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম রেখেছে মাহদীয়া জান্নাত মাহী। আমার কোনো কথা শোনে না। চরম অবাধ্য। উচ্ছৃঙ্খল চলাফেরা করে। আমি তাকে কোনোভাবেই মানাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ত্যাজ্য করেছি। তার জন্য আমি সমাজে মুখ দেখাতে পারি না। ত্যাজ্য করার সময় ভরণপোষণ বাবদ আমার কাছ থেকেও দেড় লাখ টাকা নিছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রতিবেদকের কথা হয় মাহদীয়া জান্নাত মাহী ওরফে মানছুরা শুকরার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাবার চরিত্র খারাপ। তিনি চারটা বিয়ে করেছেন। আমার মায়ের সঙ্গে ডিভোর্স হওয়ার পরে অনেক কষ্টে জীবন কেটেছে। সৎভাইয়ের সঙ্গে প্রথম বিয়ে টেকেনি। এরপর ২০২০ সালে সাজেদুলকে বিয়ে করি। সে স্বামীর কাছ থেকে ২ লাখ ৪৪ হাজার টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করলেও পরবর্তী সময়ে ফেরত দিয়েছেন বলে দাবি করেন।
মাহী আরও জানান, রাহাতের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সে আমাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। কিন্তু বিয়েতে অস্বীকৃতি জানায়। সেজন্য মামলা করি। রাহাতের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা নেওয়ার কথা মাহীর স্বীকার করেন। এরপর শুভর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক থেকে শারীরিক সম্পর্ক। স্ত্রীর স্বীকৃতি দিতে না চাওয়ায় তার বিরুদ্ধে মামলা করার কথাও অকপটে জানান। শুভর কাছ থেকে নিয়েছেন সাড়ে ৫ লাখ টাকা। তবে সে টাকা ফেরত দিতে চান বলেও জানান এই প্রতারক।
মাহী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার জীবনটা এমন হওয়ার জন্য মা-বাবা দায়ী। আমি বাঁচতে চাই, সম্মান ও ভালোবাসা চাই। কিন্তু কেউ আমার দায়িত্ব নেয়নি। তাই নিজের দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হয়েছে।’ সূত্র : কালবেলা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।